জামেয়া ওয়েবসাইট

শুক্রবার-২৯শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মহানবী (সা.)-এর বরকতময় জীবনধারা

মহানবী (সা.)-এর বরকতময় জীবনধারা

মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাঈল বুখারী

নবীজি হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন উন্নত চরিত্রের অধিকারী। উত্তম স্বভাবের ধারকবাহক। সবসময় খোশমেজাজে থাকতেন, তবে হাসাহাসি করতেন না। ভাবগম্ভীর ছিলেন, তবে বিষন্ন ও মলিন চেহারার ছিলেন না। যারপরনাই বিনয়ী ছিলেন, কিন্তু অনুদার ও অসামাজিক ছিলেন না। সীমাহীন গম্ভীর ছিলেন, কিন্তু কঠোর ছিলেন না। দানশীল ছিলেন, কিন্তু অপব্যয় করতেন না। সবার প্রতি দয়া করতেন। কারো কিছুর প্রতি কখনো লোভ করতেন না। সারাক্ষণ মাথা নিচু করে রাখতেন।

ইমামুল হিন্দ আল্লামা শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) বলেন, যে কোনো ব্যক্তিই রসুলে করীম (সা.)-এর সামনে হঠাৎ করে আসলে সে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ত। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তিই নবীজির নিকট এসে বসত, সে একেবারে তার একান্ত ভক্ত হয়ে যেত। আত্মীয়স্বজন ও সেবকদের প্রতি নবীজি (সা.) বড়ই অনুগ্রহশীল ছিলেন।

হযরত আনাস (রাযি.) দীর্ঘ ১০ বছর প্রিয়নবীর খেদমত করেছেন। এ দীর্ঘ সময়ে হযরত নবী করীম (সা.) কখনো তাঁকে উহ শব্দ পর্যন্ত বলেননি। মহানবীর পবিত্র জবানে কখনো কোনো নোংরা কথা বা গালি উচ্চারিত হতো না। কাউকে কখনো অভিশাপ দিতেন না। কেউ কষ্ট দিলে সবর করতেন। আল্লাহর সকল সৃষ্টির প্রতি নবীজি করুণা প্রদর্শন করতেন। হাত ও মুখ মোবারক দ্বারা কখনো কাউকে কষ্ট দেননি। পরিবার-পরিজনের সংশোধন ও জাতি-গোষ্ঠীর পরিশুদ্ধির প্রতি খুবই মনোযোগ নিবদ্ধ করতেন। প্রত্যেক ব্যক্তি এবং প্রতিটি বস্তুর মানমর্যাদা সম্পর্কে সম্যক সচেতন ছিলেন। সর্বদা আসমানি বাদশাহর প্রতি নির্ভরশীল ছিলেন।

সহীহ বুখারী শরীফে আছে, মহানবী (সা.) আল্লাহর অনুগত ব্যক্তিকে সুসংবাদ দিতেন। আর আল্লাহর নাফরমান ব্যক্তিকে ভয় প্রদর্শন করতেন। তিনি ছিলেন অসতর্ক ও অলসদের আশ্রয় স্থল। তিনি ছিলেন আল্লাহর বান্দা ও রসুল। সকল বিষয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করতেন। তিনি কটুভাষী ছিলেন না। ছিলেন না কঠোর ও রূঢ় স্বভাবের। উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতেন না। অন্যায়ের বদলা অন্যায় দ্বারা নিতেন না। ক্ষমাপ্রার্থীকে ক্ষমা করতেন। অপরাধীকে মার্জনা করে দিতেন।

নবী করীম (সা.)-এর কাজ ছিল বিভিন্ন ধর্মের ভুলগুলোকে সংশোধন করে দেওয়া। তাঁর শিক্ষা অন্ধদের চোখ খুলে দিত। বধিরদের শ্রবণশক্তি ফিরিয়ে দিত। আর আলস্যের চাদর মুড়িয়ে থাকা অন্তরসমূহের পর্দা সরিয়ে দিত।

রসুলে করীম (সা.) ছিলেন যাবতীয় সৌন্দর্যে সজ্জিত। সর্বপ্রকারের উত্তম বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। প্রশান্তি ছিল তাঁর পোশাক। কল্যাণ ছিল তাঁর প্রতীক। তাকওয়া ছিল তাঁর ভেদ ও রহস্য। হেকমত ছিল তাঁর কথা। আর আদল তথা ন্যায়পরায়ণতা ছিল তাঁর সীরাত ও বৈশিষ্ট্য। তাঁর শরীয়ত আপাদমস্তক সত্য। তাঁর মিল্লাত হলো ইসলাম। হিদায়েত হচ্ছে তাঁর রাহনুমা, পথপ্রদর্শক। তিনি তো হলেন গোমরাহি ও পথভ্রষ্টতা দূরীভূতকারী। দীন-হীনদের উচ্চে অধিষ্ঠানকারী। অখ্যাতকে খ্যাতি প্রদানকারী। স্বল্পতাকে প্রাচুর্য দানকারী। আর সংকীর্ণতাকে ধনাঢ্যতায় রূপান্তরকারী। (রহমাতুল্লিল আলামীন)

আম্মাজান হযরত আয়েশা (রাযি.)-কে তাঁর ছাত্র হযরত আসওয়াদ (রহ.)-এর একটি প্রশ্ন মহানবী (সা.) স্বীয় ঘরে কী করতেন, এর উত্তরে বলেছিলেন, নবীজি (সা.) গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত থাকতেন। যেমন- হাফিয ইবনুল কাইয়িম (রহ.) লিখেন, মহানবী (সা.) ছেঁড়া জামা-কাপড়ে তালি লাগাতেন। ছেঁড়া জুতাও নিজে সেলাই করে নিতেন। পশুর দুধ দোহন করতেন। ফাটা বালতি জোড়া লাগাতেন। ক্ষুধার তাড়নায় কখনো কখনো স্বীয় পেটে পাথার বাঁধতেন। পাথর বাঁধলে কোমর শক্ত থাকে। বাঁকা হয় না। নিজেই ঝাড়ু দিতেন।

নবী করীম (সা.) নিজে মেহমান হয়েছেন। আবার মেজবানও হয়েছেন। মেজবান তথা হোস্টের দায়িত্বও পালন করেছেন। নবীজি (সা.) স্বীয় পূত-পবিত্র সত্তার পরও দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। কুস্তি লড়েছেন। যেমন- রুকানা ও আবু আসাদ জুমাহীর সঙ্গে নবীজি কুস্তি লড়েছেন।

নবীজি শ্রমের কাজও করেছেন। যেমন- নবী করীম (সা.) বকরি চরিয়েছেন। আর হযরত খাদীজা (রাযি.)-এর ধন-সম্পদ নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া গমন করেছেন।

বকরি চরানো একটা অতি মামুলি কাজ, কিন্তু নবুওয়তের ইতিহাসে এর বিরাট গুরুত্ব রয়েছে। তাই প্রিয়নবীর পবিত্র জীবনে তার উপস্থিতিটাও খুবই জরুরি ছিল। এর অর্থ এ নয় যে, বকরি চরানোটা নবুওয়তের এমন আবশ্যকীয় বিষয়, যা পাওয়া গেলেই যে কেউ নিজেকে নবী দাবি করতে পারবে। তাহলে তো প্রত্যেক রাখালই নিজেকে নবী দাবি করতে পারবে; বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো এই যে, যিনিই নবী হয়েছেন তাঁর জীবনে এ বিচ্ছিন্ন ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে। যেন একটি গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট জাতির চিত্র অনুধাবনের জন্যে, যারা এমন কোনো ময়দানে বের হয়েছে যেখানে পানাহারের কোনো সামগ্রি নেই। পাশাপাশি তাদেরকে আবার চোর-ডাকাত চতুর্দিক থেকে ঘিরে রেখেছে। তাদের চিত্র ও দৃশ্যপট অঙ্কনের জন্যে বকরি পালের চেয়ে যুৎসই আর কোনো জিনিস নেই। (তরজুমানুস সুন্নাহ)

প্রিয়নবী হযরত রসুলে করীম (সা.)-এর শৈশবকালে কাবাঘরের নির্মাণ কাজ চলছিল। তখন পাথরসমূহ উঠিয়ে উঠিয়ে নবীজি রাজমিস্ত্রিদের নিকট আনতেন। মসজিদে কুবা ও মসজিদে নববীর নির্মাণ কাজে এবং খন্দক খোঁড়ার সময় মহানবী (সা.) সাধারণ শ্রমিকদের ন্যায় কাজ করেছেন। স্বয়ং নিজ হাতে পাথর তুলে দিয়েছেন। নিজ হাতে মাটি খুঁড়েছেন—এসব তো দিবালোকের চেয়েও অধিক সত্য।

সরওয়ারে কায়েনাত নবী মুহাম্মদ (সা.) কখনো কখনো হাস্য-রসিকতাও করতেন। তবে এই হাসি-রসিকতার সময়ও রসুলে করীম (সা.) সত্য বৈ বলতেন না। যেমন- একদিন রসুলে পাকের নিকট একজন বৃদ্ধ মহিলা এসেছিল। মুহাদ্দিসীনে কেরাম বলেন, ইনি ছিলেন হযরতের ফুফী যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রাযি.)-এর মাতা হযরত সাফিয়া (রাযি.)। এ সময় কথা প্রসঙ্গে হযরত বললেন, কোনো মহিলা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তখন মহিলা বললেন, ইয়া রসুলাল্লাহ (সা.)! কোন জিনিসটি তাদের জান্নাতে প্রবেশের পথে প্রতিবন্ধক? অথচ আল্লাহ তাআলার প্রতিশ্রুতির মধ্যে তো মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী উভয়ে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। জবাবে হযরত নবী করীম (সা.) বললেন, আপনি কি পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করেন না? আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন,

اِنَّاۤ اَنْشَاْنٰهُنَّ اِنْشَآءًۙ۰۰۳۵ فَجَعَلْنٰهُنَّ اَبْكَارًاۙ۰۰۳۶

‘আমি জান্নাতী রমণীগণকে বিশেষরূপে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তাদেরকে করেছি চিরকুমারী।’[1]

হযরত রসুলে করীম (সা.) কৌশলী বাক্য ব্যবহার করতেন। উদাহরণস্বরূপ: নবীজি কোথাও গমনের ইচ্ছা করলে মাঝে মাঝে তার বিপরীত দিক সম্পর্কে জানতে চাইতেন—এর রাস্তা কেমন? কোন দিকে? বা তার পানির অবস্থা কেমন? ইত্যাদি।

আল্লাহর রসুল (সা.) রোগীর সেবা-শুশ্রুষা করতেন। তাদের খোঁজখবর নিতেন। আবদুল কুদ্দুস নামের এক ইহুদি ছেলে। রসুল (সা.)-এর সেবা করতো। একবার সে অসুস্থ হয়ে পড়লে নবীজি তাকে দেখতে যান। গিয়েই তার শিয়রে বসে পড়েন। এ সময় মহানবী (সা.) বললেন, তুমি ইসলাম গ্রহণ করো। এ সময় সেখানে তার পিতা উপস্থিত ছিল। সে তার পিতার দিকে তাকালো। তখন তার পিতা বলে উঠল, তুমি আবুল কাসিম (সা.)-এর কথা মেনে নাও। একথা শুনে সে ইসলামে দীক্ষিত হয়ে গেল। নবী করীম (সা.) সেখান থেকে একথা বলতে বলতে ফিরে আসলেন,

«الْـحَمْدُ لِلهِ الَّذِيْ أَنْقَذَهُ مِنَ النَّارِ».

‘সকল প্রশংসা সে মহান আল্লাহর জন্যে নিবেদিত, যিনি তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দিয়েছেন।’ পরে নবীজি তার জানাযার নামাজে শরীক হন।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিধবা, দাসী, এতিম-মিসকিন ও দুর্বলদের সঙ্গে উঠাবসা করতেন। তাদের প্রয়োজনাদি পূরণ করতেন। আদী ইবনে হাতেম ছিলেন ‘তায়ী’ গোত্রের প্রধান এবং বিখ্যাত হাতেম তায়ীর বংশধর। তিনি ছিলেন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। আদী ইবনে হাতেম হুযুর (সা.)-এর দরবারে আসা-যাওয়া করতেন। হুযুর (সা.)-এর প্রতি সাহাবীগণের ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখে এবং জিহাদের সাজ-সরঞ্জাম প্রত্যক্ষ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন না যে, তিনি (হযরত মুহাম্মদ সা.) বাদশাহ নাকি পয়গাম্বর?

আদী দেখেন, হঠাৎ করে মদীনা মুনাওয়ারার একজন দাসী এসে দাঁড়িয়ে যায়। সে বলে, আপনার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। আর আল্লাহর নবী বলেন, মদীনার যে গলিতেই বল না কেন, আমি তোমার কথা শুনতে রাজি আছি! একথা বলেই হযরত দাঁড়িয়ে যান!! এভাবেই নবীজি (সা.) একজন দাসীর প্রয়োজন পূরণ করেন।

বাহ্যিক শৌর্যবীর্যের আড়ালে এমন বিনয় ও নম্রতা দেখে আদীর চক্ষু খুলে যায়। এবার তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যে, নিশ্চিত এটা পয়গাম্বরের শান। সাথে সাথে তিনি গলা থেকে ক্রুশ খুলে ফেলেন। আর স্বীয় গলায় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর আনুগত্যের বেড়ি পরে নেন। (খুতবাতে মাদরাস)

বুখারী শরীফে আছে,

«إِنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ لَـمْ يَكُنْ فَاحِشًا وَلَا مُتَفَحِّشًا».

হযরত নবী করীম (সা.) স্বভাবগতভাবে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে কখনো কারো সঙ্গে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ কথা বলেননি; বরং নবীজি (সা.) কুমারী রমণীদের চেয়েও বেশি লজ্জাশীল ছিলেন। আর মহানবীর প্রতিটি আচার-আচরণে লজ্জা ও শরমের ছাপ প্রকাশ পেত। মজলিসে কোনো বিষয় অপছন্দ হলে ভদ্রতার কারণে কোনো কিছু বলতেন না; কিন্তু চেহারার প্রভাবে তা প্রকাশ পেয়ে যেত। এতে হযরাতে সাহাবায়ে কেরাম সতর্ক হয়ে যেতেন। লেনদেনের ব্যাপারে হযরত নবী করীম (সা.) খুবই স্বচ্ছ ছিলেন। স্বচ্ছ লেনদেনের প্রতি মহানবী (সা.) সীমাহীন গুরুত্বারোপ করতেন।

হুযুর (সা.) কারো কাছ থেকে টাকা-পয়সা ধার নিলে তাকে তার চেয়ে ভালো ও অধিক প্রদান করতেন। একবার রসুলুল্লাহ (সা.) জনৈক ব্যক্তির কাছ থেকে 40 সা (এক সা আনুমানিক সাড়ে তিন সের বা তার চেয়ে একটু বেশি) ধার নিয়েছিলেন। অতঃপর লোকটির প্রয়োজন হলে সে নবীজির নিকট আসে আর পাওনা ফেরত চায়। তখন আল্লাহর রসুল (সা.) লোকটিকে বললেন, এখনও পর্যন্ত আমার কাছে কোনো টাকা-পয়সা আসেনি। একথা শুনে লোকটি কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল, ঠিক এমন সময় নবীজি তাকে বললেন, দেখো! ভালো ছাড়া মন্দ কিছু বলো না। অতঃপর আল্লাহর নবী (সা.) তাকে ধার করা 40 সা সাথে আরও 40 সা অতিরিক্ত মোট আশি সা প্রদান করেন।

একবার মহানবী (সা.) জনৈক ইহুদির কাছ থেকে বাকিতে কিছু একটা খরিদ করেছিলেন। নির্ধারিত সময়ের আগে এসেই সেই ব্যক্তি টাকা চাইতে লাগল। তখন রসুলে করীম (সা.) বললেন, এখনও তো নির্ধারিত সময় আসেনি। জবাবে সেই ব্যক্তি বলতে লাগল, হে আবদুল মুত্তালিবের বংশধর! তোমরা তো অহেতুক টালবাহানা করে থাক। লোকটির একথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম যারপরনাই ক্ষুদ্ধ হলেন। তারা এর প্রতিশোধ নিতে চাইলেন এবং কঠোর শাস্তি দিতে উদ্যত হলেন। তখন নবী করীম (সা.) তাৎক্ষণিকভাবে তাদেরকে বাধা প্রদান করলেন। তার কথায় মোটেই মন খারাপ করলেন না; বরং ধৈর্যধারণ করলেন। মহানবী (সা.)-এর এমন অভূতপূর্ব ব্যবহারে ইহুদি চিৎকার করে উঠল। সে বলতে লাগল, নবুওয়তের আলামতসমূহের মধ্য থেকে কেবল এই একটি আলামত সম্পর্কে আমি জানতে পারিনি। তাই এ আলামতটি সম্পর্কে আমি জানতে চাইছিলাম। অর্থাৎ জাহেল ও মূর্খদের কষ্টের বিপরীতে তিনি সীমাহীন ধৈর্যধারণ করবেন। এরপর সে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। সে মুসলমান হয়ে যায়।

মহানবী (সা.)-এর বিরাম ও বিশ্রাম

প্রিয়নবী (সা.) মাটিতে বসতেন। কখনো কখনো বিছানায় বসতেন। বিছানায় আরাম করতেন। কখনো মাদুরে আরাম করতেন। আবার কখনো কখনো মাটিতে আরাম করতেন। মাঝে মাঝে চামড়াতেও আরাম করতেন।

রাতের প্রথম প্রহরে আরাম করতেন। আর শেষ প্রহরে জেগে উঠতেন। রসুলে করীম (সা.) যখন আরাম করতেন, তখন সাহাবায়ে কেরাম নবীজিকে জাগাতেন না; হতে পারে, এ সময় অহীর আগমন হচ্ছে। কেননা নবী-রসুলগণের অন্তর সবসময় জাগ্রত থাকে।

মহানবী (সা.)-এর হাঁটাচলা

রসুলুল্লাহ (সা.) একাকীও চলতেন, আবার সাহাবায়ে কেরামগণকে সঙ্গে নিয়েও চলতেন। রসুলে পাকের হাঁটাচলা ছিল যেমন সুন্দর তেমনি সুস্থির। চলার সময় মনে হতো উঁচু থেকে নিচের দিকে অবতরণ করছেন। তবে তিনি দ্রুতগতিতে হাঁটতেন। চলার সময় অন্য কোনো দিকে তাকাতেন না, না ডানদিকে না বাম দিকে। সাহসী, বীর-বাহাদুর ও আত্মপ্রত্যয়ীদের হাঁটাচলা এমনই হয়ে থাকে।

মহানবী (সা.)-এর সওয়ারি

হযরত (সা.) ঘোড়ার ওপর সওয়ার হয়েছেন, আবার উট, খচ্ছর, গাধা ইত্যাদির ওপরও সওয়ার হয়েছেন। ঘোড়ার ওপর কখনো কখনো জীন বা গদি ছাড়াও সওয়ার হয়েছেন। কখনো কখনো জীনসহ সওয়ার হয়েছেন। প্রায়ই একাকী সওয়ার হতেন। মাঝেমধ্যে উটের ওপর পিছনে অন্য কাউকে বসাতেন। আবার কখনো কখনো আগে-পিছেও কাউকে বসাতেন। এভাবে তখন তিনজন হয়ে যেতেন। কখনো কখনো পুরুষদের মধ্য থেকে কাউকে নিতেন। আর মাঝে মাঝে আযওয়াজে মুতাহহারাত তথা উম্মুল মুমিনীনদের মধ্য থেকে কাউকে নিতেন। অধিকাংশ সময় ঘোড়া ও উটই ব্যবহার করতেন। তবে ঘোড়ায় সওয়ার হওয়ার মধ্যেই প্রিয়তম রসুল (সা.) অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। আরবে খচ্চর হতো না। তবে কোনো এক রাজা-বাদশাহ নবীজিকে খচ্ছর হাদিয়া দিয়েছিলেন। আর সেটাই হচ্ছে ‘দুলদুল’।

মহানবী (সা.)-এর পানাহার

মহানবী (সা.)-এর ঘরে দুই দুই মাস পর্যন্ত চুলায় আগুন জ্বলত না। শুধু খেজুর ও পানি খেয়ে দিন কাটাতেন। সুস্বাদু ও কৃত্রিম খাবার থেকে সবসময় দূরে থাকতেন। পাতলা রুটির ছবিও কোনোদিন দেখেননি। কোনো খাবারের দোষ বের করতেন না। পছন্দ হলে খেয়ে নিতেন; নতুবা রেখে দিতেন। টেক লাগিয়ে খানা খেতেন না। নবীজি বলতেন, খাবারের বরকত হলো খাওয়ার আগে ও খাওয়ার শেষে হাত ধোয়ার পরে। রসুল (সা.) বাম হাতে খানা খেতে নিষেধ করতেন। নবীজি (সা.) বলতেন, শয়তান বাম হাতে পানাহার করে থাকে। আল্লাহর নবী (সা.) খানা শুরু করার আগে ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে, খানা শেষ করার আগে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলতে এবং নিজের সামনে থেকে আহার করতে নির্দেশ দিতেন। হ্যাঁ, সমস্ত খাবার একই রকমের হলে যেদিক থেকেই ইচ্ছা ভক্ষণের অনুমতি প্রদান করতেন।

নবীজি (সা.) পশুর বাহুর গোশত খুবই পছন্দ করতেন। কেননা তা মজাদারও হয় আবার তাড়াতাড়ি গলেও যায়। পাশাপাশি সেটা নাপাক থেকেও মুক্ত থাকে।

প্রিয়নবী (সা.) হালুয়া এবং মধু খুব পছন্দ করতেন। নবীজি তিন আঙুলে খাবার গ্রহণ করতেন। আর খানা শেষে আঙুল চেটে খেতেন। একটি বড় পেয়ালা ছিল। এটা উঠাতে চারজন লোক লাগত। মাঝে মাঝে সবার সাথে মিলে তাতে আহার করতেন। আর দু’জানু হয়ে বসতেন। একবার জনৈক বেদুইন বলল, এটা কেমন বৈঠক? তখন প্রিয়নবী (সা.) বললেন, আল্লাহ তাআলা আমাকে বিনয়ী ও ভদ্র বানিয়েছেন। অহংকারী ও উদ্ধত বানাননি।

আল্লাহর নবী (সা.) স্বল্প আহার গ্রহণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। আবার পেটে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতেও নিষেধ করতেন। কারণ এ দুটি তাড়াতাড়ি বার্ধক্য ডেকে আনে। মহানবী (সা.) রাতে খানা খাওয়ার পর সাথে সাথে ঘুমাতেও বারণ করতেন। তাইতো কোনো কোনো মুসলিম চিকিৎসাবিদ খানা খাওয়ার পরে 40 কদম হাঁটার কথা বলেছেন, অথবা নামাজ পড়ার অসিয়ত করেছেন। যাতে করে পাকস্থলিতে খাদ্য স্থির হয়ে সহজে হজম হতে পারে।

রসুলে করীম (সা.) কখনো বিশেষ কোনো খাবারে নিজেকে অভ্যস্ত করেননি। কেননা এটা স্বাস্থের জন্যে ক্ষতিকর; বরং আরবদের অভ্যাস অনুযায়ী গোশত, ফল, রুটি, খেজুর ইত্যাদি সবকিছু আহার করতেন। যে সময় যেটা হাজির হতো, সেটাই আহার করতেন। লাউ তরকারি হলে আঙুল দ্বারা পেয়ালায় তার ফালি ও টুকরা তালাশ করতেন। অনেক সময় খেজুরের সাথে তরমুজ খেয়েছেন। যেন ঠাণ্ডা ও গরম মিলে মাঝামাঝি অবস্থা তৈরি হয়। হালকা-পাতলা ক্ষীরা ও শশাও প্রিয়নবী (সা.) পছন্দ করতেন। কোনো কোনো সময় রুটির সাথে খেজুরও আহার করেছেন।

ঠাণ্ডা পানি রসুলে পাক (সা.)-এর অনেক প্রিয় ছিল। প্রায় সময় মহানবী (সা.) বসে বসেই পানি পান করতেন। এটাই ছিল নবীজির নিয়মিত অভ্যাস। দাঁড়িয়ে পানি পান করতে তিনি নিষেধ করতেন। শুধু তা-ই নয়; বরং কখনো কখনো দাঁড়িয়ে পানি পানকারীকে বমি করে দেওয়ার নির্দেশ পর্যন্ত দিয়েছেন। দাঁড়িয়ে পানি পান করলে তৃষ্ণা নিবারণ হয় না। পাকস্থলিতে তা স্থির হয় না। তবে কখনো কখনো ওজরের কারণে দাঁড়িয়েও পানি পান করেছেন। তিন শ্বাসে পানি পান করতেন। অর্থাৎ প্রত্যেক বার পাত্র থেকে মুখ মোবারক আলাদা করতেন। আর নিঃশ্বাস নিতেন। কেননা এটা সুস্বাদু ও তৃষ্ণা নিবারণকারী। ভাঙা পাত্র দ্বারা বা পাত্রের ভাঙা দিক দিয়ে পানি পান করতে নবী করীম (সা.) নিষেধ করেছেন। কারণ এর দ্বারা আঘাত পেতে পারে।

দুধ কখনো কখনো সরাসরি পান করতেন। আবার কখনো কখনো তাতে পানি মিশিয়ে পান করতেন। কিশমিশ, খেজুর, আঙুর ইত্যাদি পানিতে ভিজাতেন। কিছুক্ষণ পরে সেই পানি পান করতেন। খাবারের পাত্রে লাকড়ির একটি পেয়ালা ছিল। এটা লোহার তার দ্বারা বাঁধা ছিল। রেওয়ায়াত দ্বারা এটুকু জানা যায়। অনুমান করা হয় যে, এটা হয়তো ভাঙা ছিল। এজন্যে তার দিয়ে তা বাঁধা হয়েছিল। সোনা-রুপার পাত্র ব্যবহার করতে নবীজি নিষেধ করেছেন। সাথে সাথে রাতে পাত্র ঢেকে রাখারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

মহানবী (সা.)-এর পোশাক-পরিচ্ছদ

পায়জামা হযরত নবী করীম (সা.)-এর খুবই পছন্দনীয় ছিল। কেননা এতে পর্দা বেশি হয়ে থাকে। পরতেও সুবিধা। আর পরিধানকারীও বিনয়ী হয়ে থাকে। কাপড়-চোপড় ডান দিক থেকে পরিধান করতেন। আস্তিন হাতের কবজি অতিক্রম করতো না। তবে জুব্বা, আবা প্রভৃতির আস্তিন আঙুলের মাথা অতিক্রম করে যেত। নবীজি (সা.) বলেছেন, মুসলমানের কাপড় নিসফে সাক তথা অর্ধ গোড়ালি পর্যন্ত হবে। আর টাখনু পর্যন্ত হলেও ভালো। এর নিচে গেলে তা জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে।

সাদা পোশাক মহানবীর খুবই পছন্দের ছিল। কারণ এতে কোনো দাগ বা চিহ্ন লাগলে সাথে সাথে প্রকাশ পেয়ে যায়। এটা তার জন্মগত রঙের ওপরই বহাল থাকে। এজন্যে নবী করীম (সা.) বলেছেন, তোমরা নিজে সাদা কাপড় পরো আর মৃতদেরও সাদা কাপড় পরাও। অর্থাৎ সাদা কাপড়ে কাফন দাও। নবীজি পাগড়ি ছাড়া টুপি পরেছেন আবার টুপি ছাড়াও পাগড়ি পরেছেন। কিন্তু হাফেয ইবনুল কাইয়িম (রহ.) লিখেছেন, এক রেওয়ায়াতে আছে, নবী করীম (সা.) বলেছেন, আমাদের ও মুশরিকদের মাঝে পার্থক্য হলো, আমরা টুপির ওপর পাগড়ি পরে থাকি। (সীরাতুন্নবী, খ. ২)

প্রিয়তম নবী (সা.) লাল রঙের পোশাক অপছন্দ করতেন। নবীজি কখনো লাল কাপড় পরিধান করেননি। অবশ্য ইয়েমেনি চাদর যা লাল ডোরাকাটা ছিল, তা ব্যবহার করেছেন।

একবার হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাযি.) লাল কাপড় পরে রসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে হাজির হন। তখন নবীজি (সা.) বললেন, এটা কেমন পোশাক!? তখন হযরত আবদুল্লাহ (রাযি.) ঘরে গিয়ে জামাটি আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন। এ সংবাদ দয়ার নবী (সা.) শুনে বললেন, জ্বালিয়ে ফেলার কী প্রয়োজন ছিল? কোনো মহিলাকে দিয়ে দিলেই পারতে।

প্রিয়নবী হযরত রসুলে করীম (সা.) কখনো উঁচা টুপি ব্যবহার করেননি। আল্লাহর নবী পায়জামা খরিদ করেছেন। এতে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি সেটা ব্যবহার করার জন্যেই খরিদ করেছেন। হযরাতে সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) মহানবীর অনুমতিক্রমে পায়জামা ব্যবহার করতেন।

হযরতের নিকট সবচেয়ে পছন্দের কাপড় ছিল ইয়েমেনি ডোরাকাটা চাদর। মাঝেমধ্যে সিরীয় আবাও ব্যবহার করেছেন। এর আস্তিন এতই সংকীর্ণ ছিল যে, অজু করার সময় তা সহজে গুটানো যেত না। হাতই আস্তিন থেকে বের করতে হতো। নবীজি শেরওয়ানি ও ক্বাবা ব্যবহার করেছেন। এর পকেট ও আস্তিনে রেশমি কাপড়ের ঝালর ছিল।

মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পরে হযরত আয়েশা (রাযি.) একটি কম্বল বের করে দেখান, যাতে তালি লাগানো ছিল। আর এক টুকরা মোটা কাপড় বের করে দেখান। এই কাপড়ের মধ্যেই প্রিয়নবী (সা.) ইন্তেকাল করেছেন।

বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায় যে, রসুলে করীম (সা.) কালো, লাল (ডোরাকাটা), সবুজ, জাফরানি ইত্যাদি সব রঙের কাপড় ব্যবহার করেছেন। (সীরাতুন্নবী)

মহানবী (সা.)-এর কথাবার্তা

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কথাবার্তা অত্যন্ত সুমধুর ও হৃদয়গ্রাহী ছিল। হুযুর (সা.) থেমে থেমে ধীরে ধীরে কথা বলতেন। নবীজির প্রত্যেক কথা পৃথক পৃথক বোঝা যেত। ফলে শ্রোতাদের তা মুখস্থ হয়ে যেত। নবীজির নিয়ম ছিল, প্রতিটি কথা তিনি তিনবার করে বলতেন। যে কথার ওপর নবী করীম (সা.) জোর দিতেন, সে কথা বারবার পুনরাবৃত্তি করতেন। কথা বলার সময় প্রায়ই আসমানের দিকে তাকাতেন। উঁচু বা স্পষ্ট আওয়াজে কথা বলতেন।

হযরত উম্মে হানী (রাযি.) থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, আল্লাহর নবী কাবাঘরে কুরআন মজীদ তেলাওয়াত করতেন। আমরা সেটা ঘরের পালংকে বসে বসে শুনতাম। (সীরাতুন্নবী)

মহানবী (সা.)-এর বিনয় ও নম্রতা

বিনয় ও নম্রতা ছিল মহানবী (সা.)-এর চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য। আবশ্যকীয় গুণ। এ মহৎ গুণ নবীজির পবিত্র সত্তা থেকে কখনো আলাদা হতো না। এ বিনয়-নম্রতার কারণেই তো দয়ার নবী, মায়ার ছবি প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.) গরিব-মিসকিনদের সবসময় খোঁজখবর রাখতেন। দীন-হীনদের সঙ্গে বসতেন। সাহাবীগণের সঙ্গে মিলেমিশে বসে পড়তেন। নিজের বসার জন্যে কোনো ধরনের স্পেশাল আসন ও চেয়ারের প্রয়োজন অনুভব করতেন না। নিজের আলাদা কোনো শান ও মান প্রকাশ করতেন না। খাদেম ও সেবকদের সঙ্গে বসেই খানা খেয়ে নিতেন। বাজার থেকে সদাই কিনে নিজেই বহন করে নিয়ে আসতেন। নিজের পশুদেরকে নিজেই খাবার দিতেন। উটকে নিজেই বসিয়ে দিতেন। এমনিভাবে ঘরের ছোট ছোট কাজকর্ম নিজেই সেরে ফেলতেন। এ জাতীয় খেদমতসমূহ আঞ্জাম দেওয়াকে নিজেদের জন্যে সৌভাগ্য মনে করতেন। অথচ এমন হাজারো জানবায সাহাবী নবীজির খেদমতে সদা প্রস্তুত ছিলেন। তাঁরা আল্লাহর রসুলের জন্যে জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলেন।

রসুলে পাকের বিনয় ও নম্রতার অবস্থা তো এমন ছিল যে, তিনি নিজের সম্পর্কে সম্মানসূচক কোনো শব্দও পছন্দ করতেন না। একবার এক ব্যক্তি রসুলুল্লাহ (সা.)-কে এসব শব্দে সম্বোধন করে, ‘হে আমাদের সর্দার! ওহে আমাদের সর্দারের সন্তান!! ওগো আমাদের মধ্যকার সবচেয়ে উত্তম ও সর্বোত্তম লোকের সন্তান!!!’

একথা শুনে আল্লাহর নবী বললেন, হে লোক সকল! তোমরা পরহেজগারি অবলম্বন করো। শয়তান যেন তোমাদেরকে ধোঁকায় ফেলে না দেয়, ধ্বংস না করে দেয়। আমি তো আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ (সা.)। আমি আল্লাহর বান্দা। আল্লাহর রসুল। আল্লাহ তাআলা আমাকে যে মর্যাদা প্রদান করেছেন, তার চেয়ে বেশি কিছু তোমরা আমার ক্ষেত্রে বল—সেটা আমি পছন্দ করি না।

হযরত মাখরামা (রাযি.) নামে একজন সাহাবী ছিলেন। একবার হযরত মাখরামা (রাযি.) স্বীয় পুত্র মিসওয়ারকে বললেন, নবীজির কাছে কোথাও থেকে চাদর এসেছে। আল্লাহর রসুল (সা.) সেগুলো বিলিবণ্টন করছেন। এসো, আমরাও যাই। অতঃপর তারা আসলেন। এ সময় হযরত রসুলে করীম (সা.) অন্দর মহলে উম্মুল মুমিনীনের কাছে তশরীফ নিয়েছিলেন। হযরত মাখরামা (রাযি.) ছেলেকে বললেন, আওয়াজ দাও। নবীজিকে ডাক দাও। মিসওয়ার বললেন, মহানবীকে ডাক দেব—সেই মর্যাদা আমার কোথায়? তখন হযরত মাখরামা বললেন, মুহাম্মদ (সা.) জালেম নন। পিতার উৎসাহে পুত্র নবীজিকে ডাক দিলেন। সাথে সাথেই আল্লাহর নবী বের হয়ে আসলেন। আর তাকে রেশমি কাপড়ের ক্বাবা দান করলেন। তাতে সুতির কারুকাজ করা স্বর্ণের ঝালর ছিল।

মানুষ তখনই গর্ব ও অহংকার করে থাকে, যখন তার ডানে-বামে হাজারো মানুষের ভিড় দেখে। যারা তার সামান্য ইশারাতেই জীবনবাজি রাখতে প্রস্তুত হয়ে যায়। বিশেষ করে যখন সে অমিত সাহসী ও তেজোদীপ্ত একটি বাহিনী নিয়ে কোনো শহরে প্রবেশ করে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে মহানবী (সা.)-এর বিনয় ও নম্রতার দৃশ্য আরও বেশি পরিস্ফূট হতো। মক্কা বিজয়ের সময় যখন রসুলে করীম (সা.) শহরে প্রবেশ করেন, তখন নবীজি বিনয় প্রদর্শন করতে গিয়ে স্বীয় মাথা মোবারক এত বেশি নত করেছেন যে, তা হাওদার সাথে লেগে যায়।

রসুল (সা.) যখন খায়বার রণাঙ্গনে প্রবেশ করেন, তখন নবী করীম (সা.) একটি গাধার ওপর সওয়ার ছিলেন। তাতে লাগামের স্থানে খেজুর পাতার ছাল বাঁধা ছিল। সেটা ছিল সীমাহীন অভাবনীয় ও অকল্পনীয় এক দৃশ্য। সাইয়েদুল কাওনাইন তথা উভয় জগতের সম্রাট নবী মুহাম্মদ (সা.) যখন লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে ইসলামের বিজয়বার্তা ঘোষণা করছিলেন, তখন তাঁর রাজসিংহাসনের হাওদার মূল্য এক টাকার বেশি মূল্যমানের বেশি ছিল না।

মহানবী (সা.)-এর ক্ষমা ও দয়া

ক্ষমা ও মার্জনার বিষয়টি তখনই সাব্যস্ত হয়, যখন অপরাধ প্রমাণিত হয়। সাথে সাথে শাস্তি প্রদানের সামর্থ্যও বিদ্যমান থাকে। অর্থাৎ প্রতিশোধ গ্রহণের শক্তিসামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ গ্রহণ না করলে তার নাম হয় ক্ষমা ও মার্জনা।

বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফে হযরত আনাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত আছে, একবার একজন বেদুইন লোক এসে বলল, হে মুহাম্মদ! আমার এ দুটি উট রয়েছে। এ দুটি উটের বোঝা সমান কিছু সামগ্রী আমাকে দিন। কেননা আপনার কাছে যে মাল রয়েছে, তা না আপনার আর না আপনার বাপের! বেদুইনের একথা শুনে দয়ার নবী করুণার ছবি হিদায়েতের রবি মুহাম্মদ (সা.) নীরব হয়ে গেলেন। অতঃপর বললেন, মাল তো আল্লাহ পাকের। আর আমি হলাম তাঁর গোলাম বা দাস। এরপর নবীজি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছ, এ ব্যাপারে কি তুমি কোনো আশঙ্কা কর? বেদুইন জবাব দিল, না। নবীজি ফের জিজ্ঞাসা করলেন, কেন? বেদুইন জবাব দিল, আমি ভালো করেই জানি যে, আপনি মন্দের বদলা মন্দ দ্বারা কখনো নেন না। তার একথা শুনে প্রিয়নবী (সা.) হেসে দিলেন। আর নির্দেশ দিলেন, তাকে একটি উটের বোঝা সমান যব আর একটি উটের বোঝা সমান খেজুর প্রদান করা হোক।

কুরাইশ গোত্র আল্লাহর নবীকে গালি দিয়েছে। তাঁকে প্রহারের হুমকি দিয়েছে। রাস্তায় কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছে। তাঁর পবিত্র শরীর মোবারকে নাপাক বস্তু নিক্ষেপ করেছে। গলায় রশি পেঁচিয়ে টেনেছে। এমনি করে নানাভাবে তাঁর সাথে বেয়াদবি করেছে। নাঊযুবিল্লাহ! কখনো তাঁকে জাদুকর বলেছে। কখনো পাগল বলেছে। আবার কখনো তাঁকে কবি বলেছে। কিন্তু এতসব জঘন্য আচরণের পরও নবীজি (সা.) কখনো রাগান্বিত হননি।

একজন দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর লোককেও যখন কোনো মজলিসে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হয়, তখন সে রাগে-ক্ষোভে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে। জেদের বশে কাঁপতে থাকে।

এক ব্যক্তি হুযুর (সা.)-কে যুল-মাজাযের বাজারে লোকদের দাওয়াত দিতে দেখেছেন। তিনি বর্ণনা করেন, নবীজি এ সময় বলছিলেন, হে লোক সকল! তোমরা বলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ! আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো মাবুদ নেই, আর কোনো ইলাহ নেই, আর কোনো উপাস্য নেই; তাহলে তোমরা সফলকাম হয়ে যাবে। মুক্তি পেয়ে যাবে। এমন সময় নবীজির পেছনে আবু জাহল ছিল। সে নবীজির শরীর মোবারকে ধুলাবালি ছিটিয়ে ছিটিয়ে বলছিল, লোক সকল! এই লোকের কোনো কথা যেন তোমাদেরকে স্বীয় ধর্ম থেকে বিমুখ না করে। এ লোক চায়, তোমরা তোমাদের দেবতা লাত-উযযাকে পরিত্যাগ কর। বর্ণনাকারী বলেন, এ কঠিন পরিস্থিতিতে মহানবী (সা.) তার দিকে ফিরেও তাকাননি।

হযরত আনাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, ‘তানঈম’ পাহাড় থেকে আশি জন লোক এ অভিপ্রায়ে নেমে আসে যে, তারা আল্লাহর রসুলকে হত্যা করবে! নাঊযু বিল্লাহ!! নবী করীম (সা.) পাহাড়ের পাদদেশে অবতরণ করেছিলেন। তারা এই গর্হিত ও অপকর্ম সম্পাদনের জন্যে ফজর নামাজের সময় বেছে নেয়। যেহেতু এ নামাজে আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) দীর্ঘ কেরাত পড়ে থাকেন। তারা উক্ত জঘন্য কার্য সংঘটিত করার জন্যে আসলো। আর সকলেই গ্রেফতার হলো। পরবর্তীকালে পেয়ারা নবী (সা.) এদের সবাইকে মুক্ত করে দেন।

মহানবী (সা.)-এর ইনসাফ ও ন্যায়বিচার

কোনো ব্যক্তি জগৎ-সংসার ত্যাগ করে নির্জনবাস অবলম্বন করলে তার জন্যে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার অবলম্বন করা খুবই সহজ। কিন্তু প্রিয়নবী হযরত রসুলে করীম (সা.) এমন ছিলেন না। নবীজির সঙ্গে আরবের অসংখ্য গোত্র ও বংশের সম্পর্ক ছিল। তারা প্রত্যেকেই পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন ছিল। একজনের পক্ষে ফয়সলা করলে অন্যজন বৈরীভাবাপন্ন হয়ে যেত। ইসলামের প্রচার-প্রসারের স্বার্থে নবী করীম (সা.)-এর তাদের প্রত্যেকের মন রক্ষা করতে হতো। এমন সব জটিলতা ও কুটিলতার মধ্যেও আদল ও ইনসাফের পাল্লা কখনো কারো দিকে ঝুঁকে পড়েনি। নবীজির এমন ইনসাফ ও ন্যায়পরায়ণতার ফলাফল এই হলো যে, মুসলমানদের কথা না হয় বাদই দিলাম, প্রিয়নবীর ঘোরতর শত্রু ইহুদিরা পর্যন্ত নিজেদের মামলা- মকদ্দমা দরবারে নববীতে নিয়ে আসত। প্রিয়নবী (সা.) তাদের শরীয়ত মতো তার ফয়সলা করে দিতেন।

আদল ও ইনসাফের ক্ষেত্রে সবচেয়ে স্পর্শকাতর দিক হলো, নিজের বিরুদ্ধে গেলেও হকের বন্ধন ছিন্ন করা যাবে না।

একবার হযরত মুহাম্মদ (সা.) গনিমতের মাল বণ্টন করছিলেন। এ সময় মানুষের প্রচণ্ড ভিড় ছিল। এরই মধ্যে এক ব্যক্তি এসে নবীজির সামনে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করতে লাগল। মহানবীর হাতে পাতলা একটি লাকড়ি ছিল। নবীজি তা দিয়ে তাকে খোঁচা মারলেন। ঘটনাক্রমে লাকড়ির মাথা তার মুখে ঢুকে পড়ল। এতে লোকটি আঘাত পেল। তখন রসুল (সা.) বললেন, আমার কাছ থেকে বদলা নিয়ে নাও। জবাবে লোকটি বলল, হে আল্লাহর রসুল! আমি আপনাকে মাফ করে দিলাম।

মৃত্যুর আগে অসুস্থাবস্থায় রসুলে করীম (সা.) সবার সম্মুখে ঘোষণা করলেন, আমার ঘাড়ে যদি কারো ধার-কর্জ থাকে, আমি যদি কারো জান-মাল ও ইজ্জত-আব্রুর ক্ষতি করে থাকি, তাহলে আমার জান, মাল ও ইজ্জত-আব্রু এই তো উপস্থিত। ইহকালে যেন সে আমার থেকে প্রতিশোধ নিয়ে নেয়। একথা শুনার পরে মজলিসে মাত্র এক ব্যক্তি কিছু দিরহাম পাওয়ার দাবি করে; যা তাকে দিয়ে দেওয়া হয়।

মহানবী (সা.)-এর দানশীলতা

দানশীলতা ও বদান্যতা ছিল মহানবী (সা.)-এর প্রকৃতিগত স্বভাব। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.)-এর বর্ণনা করেন, রহমাতুল্লিল আলামীন (সা.) সবচেয়ে বড় দানশীল ছিলেন। বিশেষ করে মাহে রমজান আসলে নবীজি আরও বেশি পরিমাণে দান করতেন। জীবনে কখনো কারো সওয়ালের ওপর না শব্দ উচ্চারণ করেননি। নবী করীম (সা.)-এর দয়া ও দানশীলতার অবস্থা এমন ছিল যে, কেউ তাঁর কাছে এসে কোনো কিছু চাইলে তা বিদ্যমান থাকলে তো অবশ্যই দিয়ে দিতেন। আর তা উপস্থিত না থাকলে তাকে পরে দেওয়ার ওয়াদা দিয়ে বিদায় করতেন। এ কারণে মানুষ এত বেশি দুঃসাহসী হয়ে উঠেছিল যে, একবার তো ঠিক নামাজের ইকামতের সময় এক বেদুইন এসে হাজির। এসেই নবীজির জামার আঁচল ধরে বলতে লাগল, আমার সামান্য একটি প্রয়োজন বাকি রয়ে গেছে। আমার ভয় হয়, তার কথা ভুলে যেতে পারি। সুতরাং আমার প্রয়োজনটি পূরণ করে দিন। অতএব দয়ার নবী ও করুণার ছবি রসুলে করীম (সা.) বেদুইন লোকটির সঙ্গে চলে গেলেন এবং তার প্রয়োজনটি পূরণ করলেন। এরপর এসে নামাজ আদায় করলেন। (সীরাতুন্নবী ও রহমাতুল্লিল আলামীন)

[1] আল-কুরআন, সূরা আল-ওয়াকিয়া, ৫৬:৩৫-৩৬

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ