আল্লামা শামসুল ইসলাম
نحمده ونصلي علىٰ رسوله الكريم، أما بعد: أعوذ بالله من الشيطان الرجيم، بسم الله الرحمن الرحيم: [قُلْ هُوَ اللّٰهُ اَحَدٌۚ۰۰۱ اَللّٰهُ الصَّمَدُۚ۰۰۲ لَمْ يَلِدْ١ۙ۬ وَلَمْ يُوْلَدْۙ۰۰۳ وَلَمْ يَكُنْ لَّهٗ كُفُوًا اَحَدٌؒ۰۰۴] {الإخلاص: 1-4}، اللهم صل علىٰ سيدنا محمد وعلىٰ آل محمد وبارك وسلم تسليمًا.
আল্লাহর অস্তিত্ব
আমার আপনার অস্তিত্বই বোঝায় যে, আমাদের একজন সৃষ্টিকর্তা আছে। কেননা আমার আপনার শক্তি দিন দিন চলে যাচ্ছে সেটা আর ফিরে আসে না। আমাদের রগের শক্তিও দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, সেটাও ফিরিয়ে আনা যায় না। এর দ্বারা কি বুঝা যায় যে, আমরা আমাদের স্রষ্টা নেই? বরং আমাদের একজন স্রষ্টা আছেন, সেই স্রষ্টা কি রকম? আমাদের স্রষ্ঠা হলেন যিনি সকল রুহকে সৃষ্টি করেছেন। তাহলে স্রষ্টাকে দেখি না কেন? আমরা কি আমাদের রুহকে দেখতে পাই? না! দেখতে পাই না। তাহলে আল্লাহ তাআলা যিনি সকল রুহকে সৃষ্টি করেছেন তাকে কিভাবে দেখব?
আমাদের রুহ আমরা দেখিনি, তাহলে রুহ আছে আমরা কীভাবে বুঝবো? রুহ থাকলে যে কাজ-কর্ম করা যায়, মানুষ করে থাকে, মৃত ব্যক্তি করতে পারে না, জীবিত ব্যক্তি করতে পারে, এ কাজ-কর্মের মাধ্যমে রুহ আছে তা বুঝি। রুহকে না দেখে, আমরা যেভাবে রুহের কাজ-কর্ম দ্বারা রুহকে চিনছি এবং বুঝছি আল্লাহকে না দেখে তার কাজ-কর্ম দ্বারা তিনি যে আছেন, তাও বুঝতে হবে।
এখন প্রশ্ন হলো, আল্লাহর কাজ-কর্ম কী? আল্লাহ তাআলা বলেন,
اَللّٰهُ الَّذِيْ خَلَقَ سَبْعَ سَمٰوٰتٍ وَّمِنَ الْاَرْضِ مِثْلَهُنَّؕ ۰۰۱۲
‘আল্লাহ সপ্তাকাশ সৃষ্টি করেছেন এবং পৃথিবীও সেই পরিমাণে।’[1]
অর্থাৎ আল্লাহ সাত স্তর আসমান আর সাত স্তর জমিন সৃষ্টি করেছেন। আমরা স্বচক্ষে সব দেখি না, বরং প্রথম আসমানই দেখি। অনেক বৈজ্ঞানিক আসমানের অস্তিত্ব অস্বীকার করে।
আসমানের দূরত্ব
জমিন হতে প্রথম আসমান পর্যন্ত পাঁচশত বছরের রাস্তা, দৈর্ঘ্য-প্রস্তের হিসাব নেই। তেমনি, প্রথম আসমান হতে দ্বিতীয় আসমান, দ্বিতীয় আসমান হতে তৃতীয় আসমান, তৃতীয় আসমান হতে চতুর্থ আসমান, চতুর্থ আসমান হতে পঞ্চম আসমান, পঞ্চম আসমান হতে ষষ্ঠ আসমান এবং ষষ্ঠ আসমান হতে সপ্তম আসমান পর্যন্ত পাঁচশত বছরের রাস্তা। দৈর্ঘ্য-প্রস্তের হিসাব নেই। সপ্তম আসমান হতে কুরসি তথা সিংহাসন পর্যন্ত পাঁচশত বছরের রাস্তা। এখন জানার বিষয় হল, এ সিংহাসন কত বড়? আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضَۚ ۰۰۲۵۵
‘আল্লাহর সিংহাসন সমস্ত আসমান ও জমিনকে পরিবেষ্টিত করে আছে।’[2]
আর সিংহাসন হতে সাগর পর্যন্ত ৫০০ বছরের রাস্তা। ওই সাগরের ওপর আরশ আর এ আরশের ওপর আল্লাহর অবস্থান। যেভাবে অবস্থান করতে হয়। উদাহরণ স্বরূপ, ঘরের মধ্যে তুমি অবস্থান কর, আধার ও আলোও অবস্থান করে। কিন্তু তোমার অবস্থান তোমার মতো আর উভয়ের অবস্থান নিজ নিজ অবস্থা মতো। আমাদের যা যা প্রয়োজন তা উভয়ের প্রয়োজন নেই। উভয়ের শীত-গরম ইত্যাদি কিছুই নেই। অতএব সৃষ্টির অবস্থান সৃষ্টির মতো আর স্রষ্টার অবস্থান স্রষ্টার মতো। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَبَنَيْنَا فَوْقَكُمْ سَبْعًا شِدَادًاۙ۰۰۱۲
‘আমি নির্মাণ করেছি তোমাদের মাথার ওপর মজবুত সপ্ত-আকাশ।’[3]
আল্লাহ তাআলা আকাশ তথা আসমান-জমিন এমন শক্ত করে সৃষ্টি করেছেন যে, সৃষ্টি লগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা দেয়নি এবং দেবেও না। অথচ আমরা যে ঘর নির্মাণ করি তা আস্তে, আস্তে নষ্ট হয়ে যায়। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,
ءَاَنْتُمْ اَشَدُّ خَلْقًا اَمِ السَّمَآءُ١ؕ بَنٰىهَاٙ۰۰۲۷
‘তোমাদের সৃষ্টি অধিক কঠিন না আকাশের।’[4]
আমরা বেঁচে থাকি ষাট বছর বা তার কম-বেশি, কিন্তু আসমানের বয়স সীমাবদ্ধ নেই। এখন প্রশ্ন হলো, আল্লাহ তাআলা আসমান কি দ্বারা সৃজন করেছেন? তা কি দুনিয়ার বস্তু হবে? আর কি জন্য সৃজন করেছেন? …উপরের আসমানসমূহ সৃজন করেছেন ফেরেশতাদের জন্য আর নিচের আসমানসমূহ সৃজন করেছেন এজন্য যে, তা থেকেই বৃষ্টিব র্ষিত হবে, সূর্য, চন্দ্র আলো দেবে আর নক্ষত্র কিরণ ছড়াবে। ফলে ফল-মূল ফলবে আর মানুষ চলাচল করবে। তোমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করনি, বরং আল্লাহ তাআলাই সৃষ্টি করেছেন। তোমরা যদি নিজেদের সৃষ্টি করতে তোমাদের মধ্যে কি চলছে, তোমরা তা জানতে।
আচ্ছা বল তো, তুমি পান করছো সাদা দুধ আর পেশাব করছো কেন অন্য রকম? পানির মতো। আচ্ছা তোমার চোখের পানি, নাকের পানি এক পানি অপর পানির সাথে মিল আছে কিনা? …এক পানি অপর পানির সাথে মিল নেই। অথচ সবই এক অপরের নিকটবর্তী স্থানের পানি। তাহলে চোখের পানি কোথায় থেকে বের হয়েছে? চোখের পানি কেন এক রকম আর অন্য পানি কেন অন্য রকম? …আমি তো জানি না। সুতরাং তুমি যদি স্বীয় সৃষ্টিকারী হতে নিজেকে চিনতে। সুতরাং বোঝা গেল, তুমি তোমার মালিকও নয় তুমি তোমার স্রষ্টাও নয়। তুমি তোমার নিজের মালিক নয়, অন্যজনের মালিক কিভাবে হবে?
(আশরাফুল মাখলুকাত) সৃষ্টির সেরা জীব যদি মালিক হতে না পারে যারা সেরা নয়, গরু-ছাগল এবং হাতি-বাঘ এরা কি মালিক হবে? কক্ষণই না। আর যদি মানুষের মালিক কেউ হতে না পারে মানুষ সৃষ্টি হয় কিভাবে? অবশ্যই একজন সৃষ্টিকর্তা থাকতে হবে আর সেই সৃষ্টিকর্তা হলো আল্লাহ। যিনি চিরকাল আছেন এবং চিরকাল থাকবেন। সবকিছু আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহকে কেউ সৃষ্টি করেননি। সৃষ্টিকারীর প্রয়োজন আগে না থাকলে। যেমন- আমরা আগে ছিলাম না।
আমাদের অস্তিত্বে আসতে আমাদের সৃষ্টি করতে হয়েছে। এখন যদি বলা হয় আল্লাহ পূর্বে ছিল না তাকে কেউ সৃষ্টি করেছেন, তাহলে যে সৃষ্টি করেছে তাকে কে সৃষ্টি করেছে? যদি বলা হয়, আগে ছিলো তাহলে ভালো। যদি বলা হয়, আগে ছিল না তাহলে তাকে কে সৃষ্টি করেছে? যদি বলা হয়, তাকে আরেকজন সৃষ্টি করেছে। তখন বলা হবে, আগে ছিল কিনা? যদি বলা হয়, আগে ছিল তাহলে ভালো। অন্যতায় তাকে কে সৃষ্টি করেছে? এভাবে চলতে থাকবে। যাকে আরবিতে تسلسل বলা হয়। এর সৃষ্টিকারী এ এর সৃষ্টিকারী, এ এর সৃষ্টিকারী, এভাবে চলতে থাকবে অথচ বাস্তবে এমন নয়। অতএব একমাত্র সৃষ্টিকারী আল্লাহ।
অন্যভাবে তুমি কিভাবে দেখো? চোখের সাহায্যে দেখি। চোখ কিভাবে দেখে? অন্য চোখের সাহায্যে। ওই চোখ কিভাবে দেখে? আরেকটা চোখের সাহায্যে। এ চোখ কিভাবে দেখে? আর এক চোখের সাহায্যে। কথা শেষ হবে না, তাহলে বলতে হবে আমি দেখি চোখে আর চোখ দেখে নিজে নিজে। তেমনিভাবে আল্লাহ সবকিছু সৃষ্টি করেছেন কিন্তু নিজের অস্তিত্ব নিজে নিজে।
আল্লাহর একত্ববাদ
মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,
قُلْ هُوَ اللّٰهُ اَحَدٌۚ۰۰۱
‘বলুন, তিনি আল্লাহ, এক।’[5]
আল্লাহ শব্দটি এমন এক সত্তার নাম, যিনি চিরকাল আছেন এবং চিরকাল থাকবেন। তিনি সর্বগুণের আধার ও সর্বদোষ থেকে পবিত্র। اَحَدٌۚ۰۰۱ শব্দের অর্থে এও শামিল যে, তিনি কোনো এক অথবা একাধিক উপাদান দ্বারা তৈরি নন। তাঁর মধ্যে একাধিকত্বের কোনো সম্ভাবনা নেই এবং কারও তুল্য নন।
আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, তার কোনো অংশীদার নেই। আমাদেরকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন চোখে দেখার, কানে শোনার যোগ্য করে। যদি আল্লাহ আরেকজন হত, তাহলে সে বলতো, তুমি অনেক দিন কানে শুনিয়ে, চোখে দেখিয়ে ক্ষমতা দেখিয়েছো এখন আমি কানে দেখিয়ে আর চোখে শুনিয়ে ক্ষমতা দেখাবো। তখন আমরা বলতাম, প্রথম আল্লাহ চোখে দেখিয়েছে আর কানে শুনিয়েছে এখন আরেক আল্লাহ এর বিপরীত করছে।
তেমনি যদি আল্লাহ কয়েকজন হতো, একজন আম গাছে আম আর কাঁঠাল গাছে কাঁঠাল দিত, অন্যজন এর বিপরীত আম গাছে কাঁঠাল আর কাঁঠাল গাছে আম দিত। একজন সূর্য পূর্ব দিক দিয়ে উদিত করত, অন্যজন দক্ষিণ দিক দিয়ে উদিত করত। তখন আমরা বলতাম, আল্লাহ দুজন একজন সূর্য পূর্ব দিকে উদিত করে অন্যজন দক্ষিণ দিকে উদিত করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
لَوْ كَانَ فِيْهِمَاۤ اٰلِهَةٌ اِلَّا اللّٰهُ لَفَسَدَتَاۚ ۰۰۲۲
‘যদি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্যান্য উপাস্য থাকত, তবে উভয়ের ধ্বংস হয়ে যেত।’[6]
আল্লাহ যদি দুইজন হত জগৎ দুইভাবে চলত আর যদি তিনজন হত তিনভাবে চলত। অথচ জগতের গতি এক ও অভিন্ন। সুতরাং বুঝতে হবে আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তিনিই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, তাকে কেউ সৃষ্টি করেনি। তিনি চিরকাল আছেন এবং থাকবেন। তাঁর অস্তিত্ব নিজে নিজে। যদি আল্লাহ না থাকে অন্য কিছু থাকে, তাহলে তাদেরকে রক্ষণাবেক্ষণ কে করবে? আমরা না থাকলে কোনো সমস্যা নেই, আমাদের মতো লক্ষ-লক্ষ লোক মারা গেলেও কোনো সমস্যা নেই। সবকিছু ঠিকঠাক চলবে, কিন্তু যদি আল্লাহ না থাকে, কিছুই ঠিকঠাক চলবে না। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা কে করবে? আল্লাহ ছাড়া কারো ক্ষমতায় তা নেই। সুতরাং আল্লাহ চিরকাল আছেন এবং চিরকাল থাকবেন। এ রকম কেউ নেই যে, চিরকাল আছে এবং থাকবে।
তাহলে ইবাদতের যোগ্য অন্য কেউ কিভাবে হবে? যখন ইবাদতের যোগ্য অন্য কেউ নেই ইবাদত করলে কি আল্লাহ হয়ে যাবে? যদি সূর্যকে চন্দ্র বলা হয় তা কি চন্দ্র হয়ে যাবে? তেমনি চন্দ্রকে যদি সূর্য বলা হয় তা কি সূর্য হয়ে যাবে? …কখনও হবে না। বাস্তব যে রকম সে রকম হতে হবে। যেমন ইবাদতের উপযুক্ত আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ নেই, তেমনি আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সৃষ্টিকর্তাও নেই। আবার সৃষ্টি করে ছেড়ে দিলে কি হবে? পালনকর্তা হতে হবে না? পালনকর্তা বলা হয়,
تربية الشيء إلى الكمال.
অর্থাৎ যখন যে পরিমাণ প্রয়োজন তা দিয়ে পরিপূর্ণতায় পৌঁছানো।
উদাহরণস্বরূপ মানুষের পরিপূর্ণতা, যে যুগে যেমন হয়। হযরত আদম (আ.)-এর যুগে লম্বা আর আমাদের যুগে খাটো, সাড়ে তিন হাত কিন্তু দিন আগে যে রকম ছিল এখনও সে রকম। সূর্য আগে যেটা ছিলো এখনো সেটা। খাদ্য-শস্য আগে যেগুলো ছিল এখনো সেগুলো। খাদ্য-শস্যও যদি পরিবর্তন না হয় তাহলে এত ব্যবধান কেন? সুতরাং বুঝতে হবে খাদ্য-শস্য ইত্যাদি প্রকাশ্য বিষয়। এর পেছনে কোনো রহস্য রয়েছে। আর তাহলো এসব আল্লাহ করছেন।
উদাহরণস্বরূপ তোমরা দুইভাই একসাথে জন্মগ্রহণ করছো। উভয়জন একই আহার গ্রহণ করেছো। কিন্তু তুমি লম্বা হয়ে গেছো আর সে ছোট-খাটো রয়ে গেছে। তোমাকে লম্বা কে করল? খাদ্য-শস্য করছে নাকি ভিটামিন? চন্দ্র-সূর্য হুবহু আগের গুলো। জন্মগ্রহণ উভয়ইজন একসাথে করেছো। উপযোগী খাবার ভক্ষণ করেছো। অতএব বুঝতে হবে বাস্তবে এগুলো কিছুই না, সবকিছুর মূলে একমাত্র আল্লাহ তাআলাই।
সেজন্য বলা হচ্ছে কাঁঠাল গাছ কাঁঠাল দিচ্ছে না। কাঁঠাল গাছ যদি নিজে নিজে কাঁঠাল দিয়ে থাকে, তার ভেতরে বড় না হলেও ছোট কাঁঠাল থাকত। অথচ যখন কাঁঠাল গাছ কাটা হয় তাতে কিছু দেখা যায় না। তাহলে বুঝতে হবে কাঁঠাল গাছ কাঁঠাল দিচ্ছে না, আম গাছ আম দিচ্ছে না, সাগর এবং পুকুর মাছ দিচ্ছে না, বরং আল্লাহ তাআলাই এগুলোকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে।
আল্লাহ তাআলার দর্শন
আল্লাহ তাআলা সবসময় ছিল, আছে, এবং সবসময় থাকবে। কিন্তু তিনি অবলোকনযোগ্য নয়। তার দর্শন সৃষ্টির দৃষ্টির ঊর্ধ্বে। তা একমাত্র পরকালেই সম্ভব। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاِنْ مِّنْ شَيْءٍ اِلَّا عِنْدَنَا خَزَآىِٕنُهٗ١ٞ وَمَا نُنَزِّلُهٗۤ اِلَّا بِقَدَرٍ مَّعْلُوْمٍ۰۰۲۱
‘আমার কাছে প্রত্যেক বস্তুর ভাণ্ডার রয়েছে। আমি নির্দিষ্ট পরিমাণেই তা অবতরণ করি।’[7]
অর্থাৎ তোমরা যা কিছু দেখছো এগুলো জমা রাখার জন্য একটি ভাণ্ডার আছে, এ ভাণ্ডারে সবকিছু আছে, যার যত কিছু প্রয়োজন আমি আল্লাহ তা থেকে দিই। আচ্ছা তোমরা বলতো, ডিমের ভেতর দেহ আছে আর দেহের ভেতর প্রাণ আছে, এ প্রাণ প্রবেশ করার জন্য বাইর থেকে কোনো সুযোগ নেই। এ প্রাণ দান করল কে? আচ্ছা, বল দেখি কাঁঠালের বাইরে সবকিছু ঠিক আছে ভেতর পোকা কোথায় থেকে এল? বোঝা যাচ্ছে, আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
اِنَّمَاۤ اَمْرُهٗۤ اِذَاۤ اَرَادَ شَيْـًٔا اَنْ يَّقُوْلَ لَهٗ كُنْ فَيَكُوْنُ۰۰۸۲
‘তিনি যখন কোনো কিছু করতে ইচ্ছা করেন, তখন তাকে কেবল বলে দেন, ‘হও’ তখনই তা হয়ে যায়।’[8]
কাঁঠাল ফেটে পোকা আর ডিম ফেটে প্রাণ দেওয়ার বিন্দুপরিমাণও প্রয়োজন নেই। সংকল্প করাই হয়ে যাচ্ছে। অন্যভাবে তোমাদের বাড়িতে চাউলে পোকা ধরছে। সব চাউল ঠিক আছে কিন্তু মধ্যভাগে চাউল নষ্ট হয়ে গেছে। ওপর থেকে যায়নি নিচ দিয়েও উঠেনি। তাহলে বলো দেখি পোকা কোথায় থেকে এল? কে দিল? …কেউ দেয়নি, আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করা মাত্রই হয়েছে।
আল্লাহর অমুখাপেক্ষিতা
পূর্বে চন্দ্র-সূর্য, খাদ্য-শস্য ইত্যাদি ছিল না। তাহলে যে আল্লাহ চিরকাল আছেন এবং থাকবে সে কি আহার করেছিলেন? আল্লাহ তাআলা বলেন,
اَللّٰهُ الصَّمَدُۚ۰۰۲
‘আল্লাহ অমুখাপেক্ষী।’[9]
আল্লাহ সে সত্তা যার কাছে মানুষ আপন অভাবও প্রয়োজন পেশ করে এবং যার সমান মহান কেউ নেই। আল্লাহ তাআলা কোনো কিছুর মুখাপেক্ষী নয়। তার কিছুই আহার করতে হয় না। তাহলে বল দেখি, বাতাস কি আহার করে, আগুন কি আহার করে? তোমরা বলবে, বাতাস আর আগুন কিছুই আহার করে না, এদের আহারের প্রয়োজন নেই।
যদি আল্লাহর সৃষ্টি আগুন-বাতাস কিছু আহার না করে থাকতে পারে, তাহলে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সে কি কিছু আহার না করে থাকতে পারে না। অবশ্যই পারে। আল্লাহ অমুখাপেক্ষী তার কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। উদাহরণস্বরূপ খাওয়া-দাওয়া করা, বিশ্রাম নেওয়া ইত্যাদি। যদি আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী হত যখন কিছু ছিল না তখন আল্লাহ কিভাবে ছিলো? তাহলে বুঝা গেল, আল্লাহ অমুখাপেক্ষী।
এখন প্রশ্ন হলো, আল্লাহ তাআলা অমুখাপেক্ষী হওয়া সত্ত্বেও আসমান-জমিন, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি কেন সৃষ্টি করেছেন? এর কারণ কী? রহস্য কী? আল্লাহ তাআলা সবকিছু মানুষের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। আর মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদত করার জন্যে। যদি মানুষ আল্লাহর ইবাদত না করে? তাহলে সেকি আল্লাহকে সম্মান করেছে? যখন আল্লাহর ইবাদতকারী এবং সম্মানকারী কেউ থাকবে না, তখন আল্লাহ তাআলা আসমান-জমিন ইত্যাদি ধ্বংস করে দেবেন।
আর যদি আল্লাহ তাআলা কারো মুখাপেক্ষী হয়, তাহলে যার দিকে মুখাপেক্ষী তার আল্লাহর চেয়ে শক্তিশালী হতে হবে। অথচ বাস্তব এমন নয়। আর যদি তোমরা বলো যেমন নাস্তিকরা বলে থাকে, সবকিছু এমনি এমনি হচ্ছে। তাহলে তোমাদের কেউ কিছু বড় হয়ে আর হয় না কেন? সারকথা এই যে, সবাই তার মুখাপেক্ষী, তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন। বুঝতেই হবে কিছু এমনি এমনি হয় না, সবকিছু আল্লাহ তাআলাই করেন। আর যারা বিশ্বাস করে, তারা চার দলে বিভক্ত। প্রথম দল, ইয়াকুবিয়া, দ্বিতীয় দল, মালাকানিয়া, তৃতীয় দল, নসতরিয়া, আর চতুর্থ দল হলো ইসলামিয়া।
প্রথম দল তথা ইয়াকুবিয়ারা বলে,
اِنَّ اللّٰهَ ثَالِثُ ثَلٰثَةٍۘ ۰۰۷۳
‘আল্লাহ তাআলা তিনজনের তৃতীয়জন।’[10]
অর্থাৎ প্রভু তিনজন, তাদের মধ্যে আল্লাহ তাআলা তৃতীয় নম্বর। এরা সৃষ্টি স্রষ্টাকে সমান করে ফেলে।
দ্বিতীয় দল মালাকানিয়া বলে, হযরত ঈসা (আ.) হুবহু আল্লাহ আর আল্লাহ তাআলা হুবহু হযরত ঈসা (আ.)।
তৃতীয় দল নসতরিয়া বলে, হযরত ঈসা (আ.) আল্লাহর সন্তান।
আর চতুর্থ দল তথা আমরা মুসলমানরা বলি, আল্লাহ তাআলা এক ও অদ্বিতীয়, তার কোনো অংশীদার নেই। তিনি কারো পিতা নন আর কারো সন্তানও নন এবং হযরত ঈসা (আ.) আল্লাহর বান্দা ও রসুল।
আচ্ছা, বলুন তো হযরত ঈসা (আ.) কি খাওয়া-দাওয়া করেন না? অবশ্যই করেন। অথচ আল্লাহ তাআলা খাওয়া-দাওয়া করেন না। আর যিনি খাওয়া-দাওয়া করেন তিনি কিভাবে তার সমকক্ষ বা সন্তান হবে যিনি খাওয়া-দাওয়া করেন না। অতএব চিন্তা করে দেখো সে কতইনা হতভাগা, যে বলে, আল্লাহ তাআলা তিনজনের তৃতীয়জন বা আল্লাহ তাআলা হযরত ঈসা (আ.)-এর পিতা আর তিনি আল্লাহ তাআলার সন্তান।
যদি বলো সে অনেক মুজিজা দেখিয়েছে, উদাহরণস্বরূপ, মৃত ব্যক্তি জীবিত করতেন, কুষ্ঠ রোগীকে হাত বুলিয়ে দিলে সে ভালো হয়ে যেত ইত্যাদি। তাই তাকে আল্লাহ বলতে বাধ্য। …যদি মুজিজার কারণে কেউ আল্লাহ হয়, হযরত মুসা (আ.)সহ অনেক নবী-রসুল আল্লাহ হওয়া আবশ্যক হয়ে পড়বে। কেননা তাঁদের অনেকে মুজিজা দেখিয়েছেন।
আর দেখেন আল্লাহ তাআলা নিরাকার আর আল্লাহর সন্তান কি আকার বিশিষ্ট হতে পারে? আল্লাহ অসীম আর সন্তান কি সসীম হতে পারে? আল্লাহ তাআলা খাওয়া-দাওয়া করেন না আর যে খাওয়া-দাওয়া করে সে কি ছেলে হতে পারে? আল্লাহ চিরকাল আছেন আর চিরকাল থাকবেন আর যে এ রকম নয়, সেকি আল্লাহ বাসন্তান হতে পারে? …বরং সঠিক হল হযরত ঈসা (আ.) আল্লাহর বান্দা ও রসুল। আল্লাহর ছেলে নন। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
لَمْ يَلِدْ١ۙ۬ وَلَمْ يُوْلَدْۙ۰۰۳
‘তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাঁকে জন্ম দেয়নি।’[11]
সন্তান প্রজনন সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য, স্রষ্টার নয়। অতএব তিনি কারও সন্তান নন এবং তার কোনো সন্তান নেই। কেননা দুনিয়ায় যা কিছু আছে সবকিছু আকারবিশিষ্ট আর আল্লাহ নিরাকার। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَمْ يَكُنْ لَّهٗ كُفُوًا اَحَدٌؒ۰۰۴
‘তারসমতুল্য কেউ নেই।’[12]
অর্থাৎ কেউ আল্লাহ তাআলার সমতুল্য নয় এবং আকার-আকৃতিতে কেউ তাঁর সাথে সামঞ্জস্য রাখে না। যদি কেউ সমকক্ষ হতো কমপক্ষে জীবিত থাকতো।
উদাহরণস্বরূপ আগামীকাল নাতনির বিয়ে নানা চলে যাচ্ছে আজ। কেন? …সে নিজের মালিক এবং খালেক নয়। জীবন-মরণ তার হাতে নেই। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, আল্লাহ সৃষ্টিকর্তা, আল্লাহ অমুখাপেক্ষী এবং আল্লাহর সমকক্ষ কেউ নেই।
অবশেষে আল্লাহর কাছে বিনীত আবেদন আল্লাহ যেন আমাদেরকে তওহীদের কথা বলার, শোনার এবং বুঝার তওফিক দান করুন। আমীন।
আলোচক: মুহাদ্দিস, রাজঘাটা মাদরাসা লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম
অনুলিখন: খালেদুর রহমান
শিক্ষার্থী, আরবি সাহিত্য বিভাগ
আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম
[1] আল-কুরআন, সুরা আত-তালাক, ৬৫:১২
[2] আল-কুরআন, সুরা আল-বাকারা, ২:২৫৫
[3] আল-কুরআন, সুরা আন-নাবা, ৭৮:১২
[4] আল-কুরআন, সুরা আন-নাযিআত, ৭৯:২৭
[5] আল-কুরআন, সুরা আল-ইখলাস, ১১২:১
[6] আল-কুরআন, সুরা আল-আম্বিয়া, ২১:২২
[7] আল-কুরআন, সুরা আল-হিজর, ১৫:২১
[8] আল-কুরআন, সুরা ইয়াসীন, ৩৬:৮২
[9] আল-কুরআন, সুরা আল-ইখলাস, ১১২:২
[10] আল-কুরআন, সুরা আল-মায়িদা, ৫:৭৩
[11] আল-কুরআন, সুরা আল-ইখলাস, ১১২:৩
[12] আল-কুরআন, সুরা আল-ইখলাস, ১১২:৪