জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রিয় নবীজি (সা.)

ছানা উল্লাহ রিয়াদ

আল্লাহ তাআলা ইসলামের মাধ্যমে মানবজাতিকে সম্মানিত করেছেন। তিনি অধিকার আদায়কে দীনের মৌলিক বিষয়গুলোর অন্যতম বলে সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। অধিকার প্রদানকে আল্লাহ তাআলা ইলাহি পদ্ধতি হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। এ পদ্ধতির অনুসরণ করলে মানুষকে করা হয় পুরস্কৃত আর উপেক্ষা করলে করা হয় তিরস্কৃত। এ অধিকার দীন-ধর্ম, জাত ও বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি শ্রেণিকে যেভাবে শামিল করে, ঠিক তেমনিভাবে অন্যান্য জীব-জন্তুকেও শামিল করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন এই অধিকারগুলো সমন্বয়ের সর্বোত্তম কারিগর। ফলে মানবমণ্ডলী তাঁর নির্দেশনা ও আদর্শের ছায়ায় মর্যাদাপূর্ণ স্বাধীন জীবনযাপন করেছে।

মানুষের অধিকার

ইসলাম মানুষের প্রতি সম্মান-মর্যাদাসহ মহত্ত্বের দৃষ্টিতে তাকায়। যেমন- আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয় আমি আদমসন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদের জলে-স্থলে চলাচলের বাহন দান করেছি, তাদের উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং অনেক সৃষ্টবস্তুর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ (সুরা আল-ইসরা: ৭০)

মানবাধিকারের প্রতি ইসলামের এই সুদৃষ্টি তাঁকে বিশেষ ও ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছে। এর অন্যতম হলো, সকল অধিকারের ব্যাপকতা। যেমন- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আদর্শিক অধিকার। এ অধিকার ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি ও পরিবর্তনের অবকাশ এতে নেই। এগুলো রাব্বুল আলামীনের প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী প্রয়োগ হবে। নবীজি (সা.)-এর কথা ও কাজ এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ। নবীজি (সা.)-এর শেষ খুতবাটি মানুষের অধিকারের বর্ণনায় সমৃদ্ধ ও পরিব্যাপ্ত ছিল, সেখানে তিনি ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের রক্ত এবং সম্পদ তোমাদের ওপর হারাম, যেমন আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের দিন পর্যন্ত তোমাদের এ দিনটি হারাম, এ মাসটি হারাম এবং এ শহরটি হারাম।’ (সহীহ আল-বুখারী: ১৪৩)

নবীজি (সা.)-এর এ খুতবাটি সামগ্রিকভাবে সকলের অধিকারকে সুনিশ্চিত করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী রক্ত, সম্পদ ও অস্থাবর সম্পত্তি। রাসুলুল্লাহ (সা.) সাধারণভাবে মানুষের মর্যাদাকে বড় করে দেখেছেন, তাদের সবচেয়ে বড় অধিকার- জীবনের অধিকার সংরক্ষণ করেছেন। নবীজি (সা.) গোটা মানবজাতির মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। ব্যক্তি ও দলের মধ্যে, জাতি ও গোষ্ঠীর মধ্যে, বিচারক ও বিচার প্রার্থীর মধ্যে, শাসক ও শাসিতের মধ্যে কোনো ভিন্নতা নেই। মানুষের মর্যাদা নির্ণীত হবে তাকওয়ার ভিত্তিতে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘হে মানবজাতি! তোমাদের রব এক, তোমাদের পিতা একজন। সাবধান! অনারবের ওপর আরবের, আরবের ওপর অনারবের, কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শেতাঙ্গের, শেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের তাকওয়া ছাড়া মর্যাদার কোনো মানদণ্ড নেই।’ (মুসনদে আহমদ: ১৪৭)

এভাবেই রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষের অধিকার আদায়ের ছিলেন মহান রক্ষক। তিনি মানবজাতির প্রতি যে রিসালাত নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তা ছিল ইনসানিয়াতের রিসালাত। এ রিসালাত এমন সব অধিকারের রক্ষক ছিল, যা প্রকৃত অর্থেই মানবতার সাথে সম্পৃক্ত। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইনসানিয়াত ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের ইনসানিয়াত মহান মানবতা।

নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রিয় নবীজি (সা.)

ইসলাম নারীকে যত্ন ও অনুগ্রহের বেষ্টনীতে ঘিরে রেখেছে। তাকে উঁচু করেছে, তাকে সম্মানিত করেছে। ইসলামই প্রথম এ সিদ্ধান্ত প্রদান করেছে নারী ও পুরুষের সৃষ্টিমূল একই। সংগতকারণেই মানবিক অধিকারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমান। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘হে মানবসমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় করো, যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন। আর বিস্তার করেছেন তাদের দুজন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। আর আল্লাহকে ভয় করো, যাঁর নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাচনা করে থাকো এবং আত্মীয়-জ্ঞাতিদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করো। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে সচেতন রয়েছেন।’ (সুরা আন-নিসা: ১)

এ বিষয়ে আরো অনেক আয়াত রয়েছে, যেগুলো নারী-পুরুষের সমন্বিত মানবতার মধ্যকার উদ্ভূত বৈষম্যকে তিরোহিত করে ইসলামের ফয়সালা বর্ণনা করেছে। ইসলামের এ দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখে, বর্বর যুগের নীতিমালা ও পূর্ববর্তী জাতিগুলোর কৃষ্টিকে অস্বীকার করে- যেগুলোতে নারীদেরকে নীচু করে উপস্থাপন করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) নারীর অধিকার রক্ষার জন্য দাঁড়িয়েছেন এবং নারীর জন্য এমন নির্ঝঞ্ঝাট অবস্থান গ্রহণ করেছেন। জাহিলিয়াতের যুগে আরবের প্রথা ছিল কন্যা সন্তানকে জীবিত প্রোথিত করা। আর এ জঘন্য কাজকে তারা অপরাধ জ্ঞান করত না, বরং তাদের জন্য এটা ছিল মর্যাদাকর। পক্ষান্তরে নবীজি (সা.) এ কাজকে মহাঅপরাধ ও হারাম ঘোষণা করেছেন। আর কুরআনেও এ ব্যাপারে কঠোর জেরা এসেছে। এভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষার ফলে নারীজাতি আত্মরক্ষা ও সম্মানজনক, আভিজাত্যপূর্ণ জীবন যাপনের সুযোগ লাভ করেছে।

শিশুর অধিকার

ইসলামধর্মে শিশুরা পার্থিব সৌন্দর্য। ওরা আত্মার প্রশান্তি ও চোখের শীতলতা। শিশুরা এ পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পরিপূর্ণ মমতাময় অবস্থানের বদৌলতে। রাসুলুল্লাহ (সা.) শিশুদের খুব বেশি ভালোবাসতেন। কোলে জড়াতেন। নবীজি (সা.) শিশুদের জন্য বিভিন্ন অধিকার বিধিত করেছেন। সেগুলোর অন্যতম একটি অধিকার, যে অধিকারটি শিশু তার জন্মের পূর্বে, বরং মাতৃগর্ভে ভ্রুণ হওয়ার পূর্ব থেকে লালন করে, যেটি রক্ষার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) বিবাহে আগ্রহী পুরুষকে নির্দেশ প্রদান করেছেন, অবশ্যই দীনদার সতী নারীকে স্ত্রী হিসেবে নির্বাচন করতে হবে। রাসুল (সা.) নবজাতক শিশুর জন্য আকিকার বিধানের প্রচলন করেছেন। সন্তানের আগমনে খুশির বহিঃপ্রকাশ হিসাবে আকিকার বিধান দিয়েছেন। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে সন্তান জন্মলাভ করবে, সে যেন পুত্র সন্তানের পক্ষ থেকে দুটি পূর্ণ মাপের বকরি জবাই করে এবং কন্যা সন্তানের পক্ষ থেকে একটি বকরি। (সুনানে আবু দাউদ: ২৮৪৪)

সন্তানের পড়ালেখা ও ইবাদত বন্দেগির প্রতি যত্নবান হওয়া, তার প্রতি স্নেহ, ভয়ের মুহূর্তে তাকে বিরত্বসুলভ আচরণ শিক্ষা দেওয়া, তার জন্য সৎসঙ্গের ব্যবস্থা করা, তার জন্য দোয়া করার আদর্শও রাসুল (সা.) বিধিত করেছেন। এভাবেই নবীজি (সা.) ভালোবাসা, মায়া-মমতায় জড়িয়ে আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎকে সভ্যতা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন। এছাড়াও রাসুলুল্লাহ (সা.) সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেবক-শ্রমিকের অধিকার, অসুস্থ ও প্রতিবন্ধীদের অধিকার, এতিম-মিসকিন ও বিধবাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম যখন যেখানে বিস্তৃত হয়েছে, সেখানেই সব অনাচার, কুসংস্কার, বৈষম্য ইত্যাদি দূরীভূত হয়েছে এবং মানুষ তাঁর ন্যায্য অধিকার ভোগ করেছে। ইসলামই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সফলতা লাভ করেছে। আজও ইসলামি রীতিনীতি অনুসরণ ও পালনের মাধ্যমেই পৃথিবীর বুকে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

লেখক:  সহকারী পরিচালক, দারুল উলুম শামলাপুর, টেকনাফ

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ