মৌসুমের পালাবদলে হাজির হয় শীত মৌসুম। শীতল বায়ু ও ঘোলাটে আবহাওয়া নিয়ে আমাদের ওপর চেপে বসে শীতকাল। ছোট থেকে বড় সবাইকে কাবু করে এই ঋতুর দিনগুলো। অঞ্চলভেদে শীতের তীব্রতা কম বেশি হলেও রাতের শীতল হাওয়া সবাইকে কাঁপিয়ে তুল। আর ভোররাতে পানি স্পর্শ করা এ যেন বরফ নিয়ে খেলা। তারপর আবার ঘন কুয়াশাময় প্রভাতে শান্তির বিশ্রাম ছেড়ে প্রভুর ইবাদতে মনোনিবেশ করা তো জীবনের সাথে সংগ্রাম। সূর্যের মুখ দেখতে ও রোদের তাপ পোহাতেও যেন আরামের ঘুম হারাম করতে ইচ্ছে করে না। সকালে পাখ-পাখালির গুঞ্জন থাকলেও মানুষ থাকে নীরব। প্রকৃতির কোলাহল থাকলেও মানুষের থাকেনা চলাচল। এ যেন এক নিস্তব্ধ পরিবেশ, মানুষ শূন্য পশু-পাখির আস্তাবল। না হয় দর্শন উদিত সুবহে সাদিক, না হয় শ্রবণ মধুর আজানের ধ্বনি, না গড়ে উঠে মসজিদের আঙিনায় মুসল্লিদের মিতালি। সবাই তাকে মহান মালিকের স্মরণ ভুলে ঘুমে বিভোর। ভোরের শিশির ও ফুলের সুরভীও তাদের ঘুম ভাঙাতে পারে না।
ঋতুর পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য আল্লাহ তায়ালার দান। শীতকাল প্রকৃতির বিশেষ নেয়ামত ও আমাদের জন্য গনীমত। হযরত ওমর (রাযি.) বলেছেন, ‘শীতকাল হলো ইবাদতকারীদের জন্য গনিমতস্বরূপ।’ শীত তো এমন গনিমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ), যা কোনো রক্তপাত কিংবা চেষ্টা ও কষ্ট ছাড়াই অর্জিত হয়। সবাই কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই এ গনিমত স্বতঃস্ফূর্তভাবে লাভ করে এবং কোনো প্রচেষ্টা বা পরিশ্রম ব্যতিরেকে তা ভোগ করে। এই শীতকাল গনিমত হওয়ার কারণ তো এটাই বলা যায়, যা বিভিন্ন সাহাবায়ে কেরামের বাণীতেও এসেছে যে, শীতের রাত দীর্ঘ হওয়ায় মুমিন ব্যক্তি রাতের বেলায় নফল নামাজ পড়তে পারে, আর দিনের বেলায় নফল রোযা রাখতে পারে। সুতরাং বলা যায় শীতকাল হল নফল ইবাদতের জন্য সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সসমযয়। এজন্যই রাসূলুল্লাহ (সা.) শীতকালকে বসন্তকাল বলেছেন, হযরত আবু সাঈদ আল-খুদরী (রাযি.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেন, শীতকাল হচ্ছে মুমিনের বসন্তকাল।
তাছাড়াও শীতকালের পবিত্রতা অর্জনে সঠিকভাবে সকল অঙ্গে পর্যাপ্ত পানি পৌঁছিয়ে অযু করাও গুরুত্বপূর্ণ আমল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তিনটি আমল পাপ মুছন করে; সংকটকালীন দান, গ্রীষ্মের রোজা ও শীতের অযু।
রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, আমি কি জানাব না কিসে তোমাদের পাপ মুছন হবে এবং মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, অবশ্যই হে রাসুলুল্লাহ! তিনি বললেন, শীতের কষ্ট সত্ত্বেও সঠিকভাবে অযু করা।
মহান প্রভুর কাছে ক্ষমা চাইলেও তিনি বান্দাকে ক্ষমা করে দেন, তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত আছে, ‘নবী করীম (সা.) বলেছেন, যদি তীব্র ঠান্ডার দিন আল্লাহর কোনো বান্দা বলে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু (আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই), আজকের দিনটি কতই না শীতল! হে আল্লাহ! জাহান্নামের জামহারি থেকে আমাকে মুক্তি দিন।’ তখন আল্লাহ জাহান্নামকে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমার এক বান্দা আমার কাছে তোমার জামহারি থেকে আশ্রয় চেয়েছে। আমি তোমাকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি তাকে আশ্রয় দিলাম।’
সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন, জামহারি কী? নবীজি (সা.) বললেন, ‘জামহারি এমন একটি ঘর যাতে অবিশ্বাসী, অকৃতজ্ঞদের নিক্ষেপ করা হবে এবং এর ভেতরে তীব্র ঠান্ডার কারণে তারা বিবর্ণ হয়ে যাবে।
এসব বিভিন্ন কারণেই নেককার পূন্যাত্মা ব্যক্তিরা শীতকালে মহান প্রভুর যিকির ও ইবাদতের আত্মনিয়োগ করতেন। নিজেদের পাপ মুছন করা ও আখিরাতের নাজাতের উসিলা গ্রহণে সদা নিয়োজিত থাকতেন।
অন্যদিকে শীতের দিনে শরীরে শক্তি সঞ্চিত থাকে বেশি। তাই ব্যায়াম করার খুব উপযোগী সময় এটা। ব্যায়ামে শীতের জড়তা, আলসেমি কেটে যায়, কাজকর্মেও গতি ফিরে আসে। আর ব্যায়াম শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাকেও চাঙা রাখে। ব্যায়াম করলে শীতের সর্দি-কাশি, জ্বরের মতো রোগবালাই সহজে কাবু করতে পারে না শরীরকে। সুতরাং শীতটাকে উপভোগ করতে চাইলে ব্যায়ামের বিকল্প নেই।
এজন্য বলা যায় শীতকালে আত্মার খোরাক ইবাদত যেমন জরুরি ঠিক শরীরের সুস্থতার জন্য শারীরিক ব্যায়ামও তেমন জরুরি। আমরা জানি একটি মানুষ তখনই সবচেয়ে বেশি সুখী হয় যখন তার মাঝে মন ও দেহে উভয়ের প্রশান্তি থাকে। কোন একটির অনুপস্থিত অন্যটিকে ত্রুটিপূর্ণ করে দেয়। তাই মনের প্রশান্তির জন্য ইবাদত আর দেহের প্রশান্তির জন্য ব্যায়ামের কোন বিকল্প নেই। কারণ ইবাদত না করলে মানুষ যেমন অস্থিরতা অনুভব করে তেমনি অসুস্থতা অনুভব করে ব্যায়াম না করলে। তো উভয়টির উপস্থিতি মানেই মানুষটি সুখী।
আর ইবাদতে মনোনিবেশ করা, তা ধীরস্থিরতার সাথে আদায় করা, মনকে ইবাদতের মধ্যে নিয়োজিত করা, প্রতিনিয়ত ইবাদত করা ইত্যাদি সবকিছুর জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার স্মরণ ও তার প্রতি ভয় থাকা অত্যাবশ্যক। আর এই দুটির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এমনকি বলা যায় একমাত্র প্রভাব বিস্তারকারী হলো মহান প্রভুর যিকির। জিকিরে যেমন আল্লাহ তায়ালার স্মরণ হয়, তার প্রতি ভীতির সঞ্চার হয়, তেমনি এদুটার সাহায্যে মানুষ ইবাদতেও আত্মনিয়োগ করতে, ইবাদতকে চিরসঙ্গী বানাতে এবং ইবাদতের পোশাক নিজের সর্বাঙ্গে সবসময় জড়িয়ে রাখতে ব্যাকুল হয়ে উঠে। কারণ জিকিরের ফজিলতের মধ্যে এসেছে যে, জিকরুল্লাহর মাধ্যমে সুন্নতের প্রতি আগ্রহ জন্মে, ইবাদতে মনোযোগ আসে, গুনাহর প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হয়, যিকির শয়তানকে রুখে দেয় এবং তার শক্তিকে ভেঙে দেয়। আল্লামা ইবনে কাইয়িম (রহ.) একজন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি জিকরুল্লাহর প্রতি গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে এবং তার ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে একটি পুস্তিকা লেখেন, তার নাম ‘আল-ওয়াবিলুস সাইয়িব’। এই কিতাবে তিনি আল্লাহর জিকিরের এক শরও বেশি উপকারিতা লিখেছেন। যেমন- জিকিরে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জিত হয়, জিকিরে অন্তর থেকে দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায় এবং প্রশান্তি লাভ হয়, ইত্যাদি। তাছাড়াও যিকির সহজতর ইবাদত হওয়া সত্ত্বেও সব ইবাদত থেকে উত্তম।
তাই হে মুমিন! হে প্রিয় মুসলিম! হে আমার ভাই ও বোন! আর নয় ঘুম! সাময়িক ক্ষতিকারক কম্বলের নিচের এই শান্তির বিশ্রাম ত্যাগ করে, চলো! প্রকৃতির সাথে আলিঙ্গন করি। পাখপাখালির সাথে প্রভুর তাসবীহ পড়ি। মহান মালিকের সাথে মিতালি গড়ি। চলো! ভোরের শিশিরে ভেজা ঘাসে সিক্ত করি চরণ, তার স্রষ্টার মধুর জিকিরে ভরিয়ে দেই মন। হোক প্রফুল্ল হৃদয়, হোক সতেজ দেহ। মুখে ফুটুক হাঁসি, নয়নে ভাসুক মুক্তির চিঠি। আল্লাহুম্মা আমীন!
জহির তানভীর
শিক্ষার্থী, দাওয়া অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম