রাকিবুল হাসান
আপনি যখন ইমাম যাহাবী (রহ.)-এর সিয়ারু আলামিন নুবালা খুলবেন, নিবিষ্ট হয়ে যখন পড়তে শুরু করবেন ব্যবসায়ী আলেমদের জীবনী, ইলমচর্চা এবং ব্যবসার মাঝে ইতিহাসবিখ্যাত আলেমদের সমন্বয় দেখে চমকে উঠবেন। তাদের ব্যবসা কেবল ‘অন্যের কাছে চাইতে হবে না’ পরিমাণে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তাদের ব্যবসা ছিল বিরাট, বিস্তৃত, আড়ম্বরপূর্ণ। লাভের পাল্লাটাও ছিলো অনেক বড় অঙ্কের। একজন ব্যবসায়ী আলেম বলেছিলেন, ‘ব্যবসার চেয়ে সহজ কোনো কাজ নেই। আমার বাড়ির চেয়ে উন্নত কোনো বাড়ি নেই।’ মৃত্যুর সময় এ ব্যবসায়ী আলেম রেখে গিয়েছিলেন তিনলাখ দিনার। বর্তমানের হিসেবে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার!
ব্যবসায়ী আলেমদের এমন শতশত উদাহরণ মিলবে ইমাম আবু সাদ সামআনীর আল-আনসাব, সাদ হারাবীর আস-সুন্না মিনাল ফুকাহা ওয়াল মুহাদ্দিসিন গ্রন্থে। গবেষক আবদুল বাসেত ইবনে ইউসুফ আত-তারিফা ফি-মান নুসিবা মিনাল ওলামা ইলা মিহনাতিন আও হিরফাতিন শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র তৈরি করেছেন। এপত্রে তিনি ১৫০০ আলেমের জীবনী এনেছেন, যারা প্রায় চারশ পেশা এবং কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এ কাজই ছিল তাদের উপার্জন-মাধ্যম।
ব্যবসা এবং ইলমচর্চা এ দুয়ের মাঝে সম্পর্কটা গত কয়েক শতাব্দী হলো অবনতির দিকে। কিন্তু এর আগে, পুরো ইসলামি সভ্যতায় এ দুয়ের মাঝে সম্পর্কটা ছিল অটুট, অক্ষুন্ন। তখন ব্যবসায়ী কাফেলার মধ্যে পাওয়া যেতো আলেম, তালেবুল ইলম, কিতাব। আলেমগণ ছিলেন স্বাধীনচেতা, এই অর্থপ্রাচুর্য ছিল তাদের সেই স্বাধীনতার শ্বেতপত্র। এখানে বাক স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, কর্মের স্বাধীনতা সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত। অর্থ কেবল তাদের স্বাধীনতার গ্যারান্টি ছিল এমন নয়, বরং ইলমি আন্দোলন ধারাবাহিক পরিচালনার সহায়কও ছিল এ অর্থ।
তাই গবেষক অলিভিয়া রেমি কনস্টেবলের পরিসংখ্যান দেখে অবাক হবার কিছু নেই। গবেষক অলিভিয়া তার আল-হাজারাতুল আরাবিয়া ইসলামিয়া ফিল উন্দুলুস গ্রন্থে এইচ জে কোহেনের প্রস্তুতকৃত একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন। পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে—আলেমদের জীবনীগ্রন্থগুলোতে সন্নিবেশিত ১৪ হাজার নিবন্ধের মধ্যে ৪ হাজার দুইশ নিবন্ধই তাদের পেশা সম্পর্কিত। তাদের মধ্যে ২২% টেক্সটাইল বাণিজ্য বা শিল্পে, ১৩ % ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে, ৪% জুয়েলারি ইন্ডাস্ট্রিতে, ৪% পারফিউম ইন্ডাস্ট্রিতে, ৪% চামড়া শিল্পে, ৪% বই প্রকাশন শিল্পে, ৩% ধাতব শিল্পে, ২% কাঠ এবং ২% সাধারণ বাণিজ্যে। এছাড়াও অন্যান্য পেশায় ৯%, মানি এক্সচেঞ্জে ৩%, দালালি এবং বাণিজ্যিক এজেন্সিতে ২% আলেম কাজ করতেন।
এ নিবন্ধে চেষ্টা করবো ইসলামি সভ্যতায় বিভিন্ন যুগে আলেমদের ব্যবসার হাল-হাকিকত কেমন ছিলো তা তুলে ধরতে।
প্রাথমিক উন্মেষকাল
আলেম, ব্যবসা এবং ব্যবসায়ী—এগুলোর মাঝে সম্পর্ক নিয়ে আজকাল খুবই কম আলোচনা করা হয়। বরং বলা ভালো—একপ্রকার এড়িয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ব্যবসা মুসলিম ফকীহদের অন্তর-মনও দেখল করেছিলো। কারণ ইসলামি রাষ্ট্রের প্রাথমিক ভিত্তিটাই ছিল ব্যবসার ওপর। ইমাম তাবারী (রহ.) তার তাফসীরে লিখেছেন, পবিত্র কুরআনে দুটো বাণিজ্য ভ্রমণের উল্লেখ আছে। এক্তইয়ামানে শীতকালীন সফর। দুই—শামে গ্রীষ্মকালীন সফর।
তাই দেখতে পাই নুবুওয়াত লাভের পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত খদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ (রাযি.)-এর ব্যবসার ম্যানেজার হিসেবে সফরে বেরুতেন। আর-রওযাতুল উনুফ গ্রন্থে আবুল কাসিম সুহাইলী লিখেছেন, হযরত খদীজা (রাযি.) তাঁর ব্যবসায়িক কাজের জন্য বিভিন্ন লোক নিয়োগ দিতেন। তাদের মধ্যে অন্যদের চেয়ে বেতন একটু বেশি দিতেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে।
অন্যদের সঙ্গে শরীকেও ব্যবসা করতেন রাসূলুল্লাহ (সা.)। ইমাম যাহাবী (রহ.) সিয়ারু আলামিন নুবালায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সায়িব কুরাশীর জীবনীতে লিখেছেন, ‘নুবুওয়াত লাভের পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ব্যবসায় অংশীদার ছিলেন তার পিতা।’ ইমাম আহমদ (রহ.) তার মুসনদে সায়িব ইবনে সায়িব থেকে একটি রেওয়ায়াত বর্ণনা করেছেন। তাতে আছে, ইসলামের পূর্বে তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে অংশীদার হয়ে ব্যবসা করতেন। মক্কা বিজয়ের দিন তিনি যখন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট এলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ‘অভিনন্দন আমার ভাই, আমার অংশীদার!’
ইসলামের আগে এবং পরে সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) ও ব্যবসায় গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ ইসলাম সবাইকে ব্যবসা, উপার্জন, নিজ হাতে কাজ করে খাওয়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। অলসতা ও পরনির্ভরশীলতাকে ‘না’ বলে। তাই বিরাট সংখ্যক সাহাবীকে আমরা ব্যবসায়ী হিসেবে দেখতে পাই। তারা অনেকেই ছিলেন অনেক ধন-সম্পদের অধিকারী; তাদের কাল হিসেবে নয়, আমাদের কাল হিসেবেই।
প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রাযি.) ছিলেন মক্কার ব্যবসায়ী। হিজরতের পরও তিনি ব্যবসায় যুক্ত হন। ইমাম তাবারী (রহ.) বলেন, ‘তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। প্রতিদিন বাজারে যেতেন, বিক্রি-বাট্টা করতেন।’ খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করার ছয়মাস পর সঙ্গীদের লক্ষ করে হযরত আবু বকর (রাযি.) বলেছিলেন, ‘মানুষের জন্য উত্তম হলো ব্যবসা করা। মানুষের পক্ষে উত্তম হলো তাদের সুযোগ-সুবিধার প্রতি মনোযোগ দেওয়া। আমার পরিবারের জন্য উত্তম হলো তাদের যতটুকু প্রয়োজন, কেবল ততটুকু নেয়া। সুতরাং তিনি ব্যবসা ছেড়ে দিলেন। বায়তুল মাল থেকে ভাতা চালু করলেন যতটুকু তার এবং তার পরিবারের দৈনিক প্রয়োজন, ততটুকুই। বার্ষিক ভাতা ছয় হাজার দিরহাম। বর্তমানের হিসেবে প্রায় সাড়ে সাত হাজার মার্কিন ডলার।
তৃতীয় খলীফা হযরত ওসমান ইবনে আফফান (রাযি.) ছিলেন সাহাবীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় কুরাইশী ব্যবসায়ী। ইমাম তাবারী (রহ.) তার একটি উক্তি উদ্ধৃত করেছেন, ‘আমি ছিলাম কুরাইশে বড় একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি এবং ব্যবসায় আমার অংশ ছিল বেশি।’ ইবনে হিশামের আস-সিরাতুন নববিয়া গ্রন্থে আছে, নয় হিজরীতে গাযওয়ায়ে তাবুকের প্র্রস্তুতি যখন শুরু হলো, রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর রাস্তায় দান করতে ধনাঢ্যদের উৎসাহিত করলেন। এ যুদ্ধে হযরত ওসমান (রাযি.)-এর চেয়ে বেশি অনুদান কেউ দিতে পারেনি। তিনি বাহিনীর জন্য অনুদান দিয়েছিলেন এক হাজার দিনার। বর্তমানের হিসেবে ১৮০ হাজার মার্কিন ডলার প্রায়। সুনানে তিরমিযীতে আছে, হযরত ওসমান (রাযি.) বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর রাস্তায় আমি দেব তিনশ উট।’
মিরাসের পরিমাণ
হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাযি.) মদীনায় যখন হিজরত করে এসেছিলেন, তিনি ছিলেন দরিদ্র। হাতে কোনো সম্পদ ছিলো না। এরপর তিনি ব্যবসায় জড়িত হয়ে পরিণত হলেন ইসলামের ইতিহাসে বড় একজন ধনাঢ্য ব্যক্তিতে। সিয়ারে ইমাম যাহাবী (রহ.) তার অনুদানের একটা চিত্র তুলে ধরেছেন, হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাযি.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে দান করেছেন চার হাজার দিনার। এরপর দান করেছেন চল্লিশ হাজার দিনার। আল্লাহর রাস্তায় দিয়েছেন ৫০০ ঘোড়া, এরপর ৫০০ বাহন। এ সব সম্পদ ছিলো তার ব্যবসা থেকে উপার্জিত। তিনি ছিলেন শুকরিয়া জ্ঞাপনকারী ধনী।’
ইমাম যাহাবী (রহ.) তারিখুল ইসলামে হযরত যুবাইর ইবনে আওয়াম (রাযি.)-এর মিরাসের একটা হিসাব দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, সহীহ হাদীসে প্রমাণিত: হযরত যুবাইর (রাযি.) অনেক সম্পদ রেখে গিয়েছিলেন। তার পরিমাণ ৪ কোটি দিরহাম কিংবা তারচেয়ে বেশি। বর্তমানের হিসেবে ১.২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রায়!’ সিয়ারে এসেছে, হযরত তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রাযি.) যখন শহীদ হন, তার খাজাঞ্চির হাতে ছিল এক লাখ দিরহাম। তার সহায়-সম্পত্তির মূল্য হয়েছিলো ৩ কোটি দিরহাম! ইবনুল জাওযী (রহ.) বলেছেন আরও বিস্ময়কর কথা। তিনি বলেছেন, ‘তালহা (রাযি.) তিনশ বাহন স্বর্ণ রেখে গিয়েছিলেন।’
কেবল বড় বড় বড় সাহাবীরাই ব্যবসা করেননি। বরং ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ছোট সাহাবী এবং তাদের গোলামগণও। ইমাম নওয়াওয়ী (রহ.) তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত গ্রন্থে সাদ করজ মুআযযিন বলে পরিচিত সাদ ইবনে আয়েয (রহ.)-এর জীবনী এনেছেন। তিনি বলেছেন, হযরত সাদ (রাযি.) ছিলেন হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রাযি.)-এর গোলাম। তিনি কোনো ব্যবসায় নামলেই লোকসান করতেন। তবে চামড়ার ব্যবসায় তিনি লাভের মুখ দেখলেন। এ ব্যবসাটাই চালিয়ে গেলেন। মসজিদে কুবায় রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে মুআযযিন নিয়োগ দিয়েছিলেন। হযরত আবু বকর (রাযি.) যখন খলীফা হলেন, হযরত বেলাল (রাযি.)ও আযান দেওয়া ছেড়ে দিলেন, তিনি সাদকে মসজিদে নববীতে আযান দেওয়ার জন্য নিয়ে এলেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এখানেই আযান দিয়েছেন।’
সাহাবীদের দেখানো পথেই চলেছেন তাবিয়ী এবং তবে তাবিয়ীগণ। সায়দুল খাতির গ্রন্থে ইমাম ইবনুল জওযী লিখেছেন, ‘তাবিয়ীনদের সরদার সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব (রহ.) অনেক সম্পদ রেখে মারা গেলেন। তিনি তেল প্রক্রিয়াজাত করতেন।’ একইভাবে ইমাম সুফিয়ান ইবনে সওরী (রহ.) তেল বিক্রি করতেন। ইমাম আবু নুআইম ইস্পাহানী হিলয়াতুল আউলিয়া গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, সুফিয়ান সওরী (রহ.)-এর এক ছাত্র ব্যবসা করতে অসম্মতি প্রকাশ করলো। সুফিয়ান ইবনে সওরী (রহ.) তাকে ধমক দিয়ে বললেন, চুপ করো! আলেমদের হাতে যদি দিনার-দিরহাম না থাকতো, তাহলে বিত্তবানরা আমাদেরকে রুমালের মতো ব্যবহার করতো।
সিয়ারে ইমাম যাহাবী (রহ.) লিখেছেন, ইমাম আবেদ মুজাহিদ আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) ছিলেন ব্যবসায়ী। তার অধিকাংশ সফর ছিলো ইলম অর্জন, যুদ্ধ, ব্যবসা, কাউকে সাহায্য করা এবং তার সঙ্গে মানুষকে হজে নিয়ে যাওয়ার জন্য।’ বড় আলেম ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ইমাম লাইস ইবনে সাদ (রহ.)। ইমাম যাহাবী তাকে বলেছেন, ইমাম, হাফিয, শায়খুল ইসলাম, মিসরের আলেম, তিনি যেখানে থাকেন গর্ব করে সেখানের মাটি। ব্যবসায় বছরে তিনি বিশ হাজার দিনার লগ্নি করতেন! বর্তমানের হিসেবে ৩.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার! লগ্নির অঙ্ক থেকে অনুমেয় বার্ষিক লাভ তার কতো হতো।
বিত্তবান হওয়া প্রতি আহ্বান
কালের বিকাশে রাষ্ট্রের যখন বিস্তৃতি ঘটলো, আলেমগণ যখন সেনাবাহিনীতে যোগদান বন্ধ করে দিলেন, দরজা যখন বন্ধ হলো মালে গনিমতের, অনেক আলেম বাধ্য হয়ে তখন ব্যবসা গ্রহণ করেছিলেন। যেন কারো কাছে হাত পাততে না হয়। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা থাকলে আলেমগণ অনুসরণীয় থাকেন, অনুসরণকারী হন না। অর্থ থাকলে মনে একটা বল পাওয়া যায়। এ বলটাকেই ডাক্তারগণ মানসিক ওষুধ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
এ বিষয়ে সবচেয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন ইমাম ইবনুল জওযী (রহ.)। তার মতে, তালিম, ফতওয়া ও ইলমচর্চায় স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা থাকা উচিত। যেন বিত্তবানরা তাদেরকে ব্যবহার করতে না পারেন। তাই তিনি বলেছেন, ‘মানুষ থেকে অমুখাপেক্ষী থাকার জন্য অর্থ উপার্জন, আলেমদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’ তিনি আহলে ইলমদের আহ্বান করেছেন, মানুষ থেকে অমুখাপেক্ষী থাকার জন্য অর্থ উপার্জনে মনোযোগী হও, শ্রম দাও। কেননা এই অর্থ তোমার কাছে তোমার দীন বাঁচিয়ে রাখবে। আলেমদের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ পার্থিব লোভ। দারিদ্র্য থেকেই এই লোভটা আসে।
আক্ষেপ করে ইমাম ইবনুল জওযী বলেছেন, ‘দেখি তো! বিত্তবানরা আলেমদের ব্যবহার করে। সামান্য বিষয়ে তাদেরকে অপদস্থ করে। তাদেরকে যাকাতের টাকা দেয়। তাদের ছাড়া মজলিশ শুরু হয় না। প্রয়োজনের দিকে লক্ষ করে আলেমগণও অপমান সহ্য করে থাকেন। অথচ এটা মূর্খতা। তাদের উচিত তাদের ইলম রক্ষা করা।’
আলেমদের স্বাধীনতা এবং ইলমচর্চার অত্যাবশকীয় জিনিসগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে এই অর্থনৈতিক বিষয়টি উল্লেখ করেছেন ইমাম ইবনুল জওযী। তার মতে, বুদ্ধিমানের কাজ হলো তাকে যখন রিজিক দেওয়া হয় কিংবা রিযিকের উৎস সৃষ্টি করে দেওয়া হয়, তা সংরক্ষণ করা। যেন তার চিন্তা বিক্ষিপ্ত না হয়। উদর পূর্ণ থাকলে মন শান্ত থাকে। কিন্তু তার যদি যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ না থাকে, তখন মনোযোগ, নিবিষ্টতা সবই ভেঙে পড়ে।’
আলেমদেরকে অর্থনৈতিক সাপোর্ট
সব আলেমদের জন্য ব্যবসায় যুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। তাহলে তার ইলমচর্চা, গবেষণা ও ইলমের জন্য সফর করায় ব্যাঘাত ঘটবে। তাই আলেমদের জীবিকার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে কাউকে না কাউকে। চাই সেটা একদিনের খাবারও হোক। এই প্রয়োজন থেকেই ফকীহগণ মুসলমানদের বায়তুল মালের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। এটা রাষ্ট্র হিসেবে নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর দেশ হিসেবে। তারা শাসকদের ওপর আলেমদের জীবিকার ব্যবস্থা করা ওয়াজিব বলেছেন। রাষ্ট্র যদি এ দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে এটা সর্বসাধারণের ওপর ওয়াজিব হয়ে যাবে কিফায়াতান। কাউকে না কাউকে এ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে।
আল-ফকীহ ওয়াল মুতাফাক্কি গ্রন্থে খতীব বাগদাদী (রহ.) লিখেছেন, ‘ইমামের জন্য কর্তব্য হলো্তফিকহ এবং ফতওয়ার জন্য যিনি নিযুক্ত, তার জীবিকার ব্যবস্থা করা। যেন তিনি অর্থ উপার্জনের ব্যস্ততা থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। আর এ জীবিকার ব্যয়ভার বহন করবে বায়তুল মাল। যদি বায়তুল মাল না থাকে, অথবা ইমাম যদি দায়িত্ব পালন না করেন, তাহলে দেশবাসী তাদের জীবিকার ব্যয়ভার বহন করবে সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।’
খতীব বাগদাদী লিখেছেন, খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ হিমসের গভর্নরের কাছে লেখা চিঠিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ফিকহের জন্য যারা নিজেদেরকে নিযুক্ত করেছে, তাদের দিকে খেয়াল রাখবে। অর্থ উপার্জনের ব্যস্ততা থেকে সরিয়ে তাদেরকে মসজিদে আবদ্ধ রাখবে। তাদের প্রত্যেককে একশ দিনার করে দিবে।’ বর্তমানের হিসেবে ১৭ হাজার মার্কিন ডলার!
সরকারি এ সম্পদ কোনো আলেম রাষ্ট্রের কোষাগারে নিজের হক মনে করে গ্রহণ করতেন। কোনো আলেম গ্রহণ করতেন না। তবে আলেমদের অর্থনৈতিক চিন্তা থেকে মুক্ত থাকার বিষয়টি তাড়িত করেছিল ওমর ইবনে আবদুল আজিজকে। বায়তুল মাল থেকে তিনি আলেমদের জন্য বরাদ্দ দিয়েছিলেন তাদের সামাজিক খেদমতের বিনিময় হিসেবে। যেমন বরাদ্দ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনী এবং রাষ্ট্রীয় সব কর্মকর্তাদের।
আলেমদের বাণিজ্যভ্রমণ
হিজরী পঞ্চম শতাব্দীর শুরু থেকে ফকীহগণ রাষ্ট্র এবং বিত্তবানদের অনুদানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ফতোয়া, বিচার, খুতবা এবং অন্যান্য ধর্মীয়, পদগুলো যখন প্রাতিষ্ঠানিককরণের পর। তবে একদল আলেম শাসক এবং বিত্তবানদের অনুদান গ্রহণ করেননি। তারা নিজেরা ব্যবসা করেছেন। ব্যবসার জন্য সফর করেছেন। তাদের পেশা ছিল হরেক রকম। শুরুতেই কোহেনের পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে।
মুহাদ্দিস ইউসুফ ইবনে যুরাইক (মৃ: ২২২ হি./৪৩৭ খ্রি.) ব্যবসা করতে মিসরে গিয়েছিলেন। সেখানেই ইন্তেকাল করেছেন। মুসিলের মুহাদ্দিস ইবনে আম্মার মুসিলি (মৃ: ২৪২ হি./৪৫৬ খ্রি.) ব্যবসা করতেন। তিনি কয়েকবার বাগদাদে এসেছেন এবং হাদীসও বর্ণনা করেছেন। সমরকন্দের মুহাদ্দিস জামাল ইবনে মুহাম্মদ বাগদাদী (মৃ: ৩৪৬ হি./৯৫৭ খ্রি.) ইলমের জন্যও সফর করতেন, ব্যবসার জন্যও সফর করতেন।
ইলম এবং সম্পদের পাহাড় গড়েছিলেন যারা, তাদের মধ্যে অন্যতম আলেম দালাজ ইবনে আহমাদ সিজিস্তানি (মৃ: ৩৫১ হি./৯৬৪ খ্রি.)। ইমাম যাহাবী তাকে বলেছেন, মুহাদ্দিস, ফকীহ, ইমাম, বিরাট সম্পদশালী ব্যবসায়ী, ব্যবসার জন্য তিনি সফর করতেন।’ ব্যবসায়িক ব্যস্ততা সত্ত্বেও ইলমের চূড়ায় আরোহণ করেছিলেন তিনি। তাকে বলা হতো তার কালের ফকীহ, শায়খুল হাদীস। ইমাম দারাকুতনী (মৃ: ৩৮৫ হি./৯৯৪ খ্রি.) বলেছেন, ‘দালাজের চেয়ে বিশ্বস্ত কোনো শায়েখ আমি দেখিনি।’
ইমাম যাহাবী (রহ.) উল্লেখ করেছেন, মৃত্যুর সময় দালাজ তিন লাখ দিনার রেখে গিয়েছিলেন। তার বর্তমান হিসাব ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রায়। তিনি দাবি করতেন, ‘পৃথিবীতে আমার বাড়ির মতো কারো বাড়ি নেই। কারণ পৃথিবীতে বাগদাদের মতো কোনো শহর নেই। বাগদাদে কাতিআ মহল্লার মতো কোনো মহল্লা নেই। এই মহল্লায় আবু হালফ স্ট্রিটের মতো কোনো রাস্তা নেই। আর এই স্ট্রিটে আমার বাড়ির মতো কোনো বাড়ি নেই।’ বাগদাদের জাঁকজমকপূর্ণ এই বাড়ি থাকলেও মক্কায় তিনি আব্বাসিদের একটি বাড়ি কিনেছিলেন ৩০ হাজার দিনার দিয়ে!
উন্দুলুসের ব্যবসায়ী ইসহাক ইবনে মাসাররাহ তুজিবি (মৃ: ৩৫৪ হি./৯৬৭ খ্রি.) ছিলেন কুরতুবার বড় একজন আলেম। তিনি সুতি কাপড়ের ব্যবসা করতেন। মুহাদ্দিস ইবনে জামি গাসসানি সায়দাবী (মৃ: ৪০৩ হি./১০১৩ খ্রি.) ভ্রমণ করতেন। ইমাম যাহাবী তার দশাধিক বড় বড় শায়খের কথা উল্লেখ করেছেন। যারা মিসর, শাম, ইরাক, হেজায, পারস্যের অধিবাসী। ইবনে জামি উক্ত অঞ্চলে তার ব্যবসায়িক সফরের সময় এসব শায়খের স্নেহধন্য হন। আতরাফুস সহীহাইন গ্রন্থের রচয়িতা ইমাম হাফিয খালফ ওয়াসিতি (মৃ: ৪০০ হি./১০১০ খ্রি.) প্রচুর বাণিজ্য সফর করতেন। উন্দুলুসের ব্যবসায়ী সাদ খাইর আনসারী ছিলেন ইমাম, মুহাদ্দিস, পরিভ্রমণকারী। ব্যবসার জন্য তিনি উন্দুলুস থেকে চীনে গিয়েছিলেন। তাই নাম হয়ে গেছে সাদ খাইর উন্দুলুসি চীনি। মুহাদ্দিস আবু তামাম আব্বাসি বাগদাদী (মৃ: ৫৪৩ হি./১১৪৮ খ্রি.) সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য ভ্রমণে বেরুতেন হিন্দুস্তান এবং তুর্কিস্তানে।। তিনি নিশাপুরে ইন্তেকাল করেছেন।
হালবের ঐতিহাসিক ইবনুল আদিম তার বুগইয়াতুত তালাব গ্রন্থে বাণিজ্য ভ্রমণে আসা এক ব্যবসায়ী আলেমের ঘটনা লিখেছেন। তিনি লিখেছেন্ত৫০৫ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে হালবে একজন ফকীহ ব্যবসায়ী এলেন। তার নাম আবু হারব ঈসা ইবনে যায়েদ ইবনে মুহাম্মদ খুযান্দি। তিনি সঙ্গে নিয়ে এলেন পণ্য বোঝাই ৫০০ উট। তিনি তার কর্মচারীদেরদের সঙ্গে মাল নামাচ্ছিলেন। তার চারপাশে ছিল একদল খাদেম, কর্মচারী!’
ব্যবসা থেকে সরে পড়া
অন্যদের মতো আলেম ব্যবসায়ীরাও কখনো লোকসানের মুখোমুখি হয়েছেন। ফলে দেখা গেছে, তারা আর কোমর সোজা করে দাঁড়াতেই পারেননি। ব্যবসা থেকে সরেই পড়েছেন। যেমন ইমাম আবুল ফারজ ইবনে কুলাইব হাররানি একজন ব্যবসায়ী আলেম ছিলেন। তিনি তার ছাত্রদের বললেন, ‘একদিন খবর এলো আমার ব্যবসায়ি মালসহ আমার ম্যানেজার সমুদ্রে ডুবে গেছে। মালের পরিমাণ ছিলো ছয় হাজার দিনার কিংবা তারচেয়ে বেশি।(বর্তমানের হিসেবে কয়েক মিলিয়ন মার্কিন ডলার)। কিন্তু আমার অবস্থা ভালো থাকায় আমার অতটা চিন্তা হয়নি।’ যিনি এতবড় ব্যবসায়ী ছিলেন, মৃত্যুর সময় অন্যের কাছে তার হাত পাততে হয়েছে। ইমাম যাহাবী (রহ.) বলেন, ‘তিনি এতটাই শূন্য হয়ে পড়েছিলেন, পড়ানোর বিনিময়ে তিনি ছাত্রদের কাছ থেকে দিনার-দিরহাম নিতেন। দিনার ছাড়া জুয ইবনে আরাফা বর্ণনাই করতেন না!!
তবে ব্যবসার একটা পর্যায়ে অনেকে ইচ্ছে করেই সরে পড়েছেন। সরে পড়েছেন ইবাদাতের জন্য, ইলম ও তাদরিসের জন্য। সাহাবী হযরত আবু দারদা (রাযি.) ব্যবসায়ী ছিলেন জীবনের একটা সময়। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি ইবাদাতে মনোযোগ দেবার জন্য ব্যবসা ছেড়ে দেন। ইমাম যাহাবী (রহ.) লিখেছেন, ‘আবু দারদা (রাযি.) বলেছেন, ইসলামপূর্ব যুগে আমি ব্যবসায়ী ছিলাম। ইসলাম আসার পর ব্যবসা এবং ইবাদাত দুটোর mgš^q করেছি। যখন আর mgš^q করতে পারছি না, তখন ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছি।’
তাবাকাতুল ফুকাহায়িশ শাফিয়িয়া গ্রন্থে ইবনুস সালাহ লিখেছেন, যাহেদ ফকীহ ইবনু শাযাহ নিশাপুরী শাফেয়ি (মৃ: ৩৭২ হি./৯৮৫ খ্রি.) ব্যবসা করতেন। এরপর তিনি ব্যবসা ছেড়ে কয়েকবছর মসজিদেই কাটিয়ে দিয়েছেন। হাসান ইবনে মুহাম্মদের জীবনীতে ইবনে হাজার লিখেছেন, তিনি ছিলেন একজন সজ্জন ধার্মিক মানুষ। তিনি ব্যবসা ছেড়ে ইবাদত, হাদীসের মজলিসে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।
ব্যবসায়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি লক্ষ্য
অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন এবং ইলমিচর্চা অব্যাহত রাখা—এ দুটোর মধ্যেই আলেমদের ব্যবসার লক্ষ্য সীমাবদ্ধ নয়। বরং ব্যবসার অন্যতম একটি দিক হলো—পৃথিবীর দিগ-দিগন্তে কিতাব, দীন, মাযহাব পৌঁছে দেওয়া। ইসলামি ভূমি থেকে অন্যান্য অঞ্চলে ইলমের উপাদান সহজলভ্য করে দেওয়া। এ লক্ষ্যে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আলেমগণ এবং বই ব্যবসায়ীগণ।
ইবনে আবু উসাইবিআ (৬৬৮ হি./১২৭০ খ্রি.) উন্দুলুসের বিখ্যাত চিকিৎসক আবুল আলা ইবনে যুহরের জীবনীতে লিখেছেন, ইবনে সিনার আল-কানুন গ্রন্থটি মরক্কোয় পৌঁছেছিল ষষ্ঠ হিজরী শতাব্দীতে। আর এ কিতাবটি ইরাক থেকে উন্দুলুসে নিয়ে এসেছিল একজন ব্যবসায়ী। এছাড়াও অনারব দেশ কিংবা পারস্য থেকে ব্যবসায়ীরা অনেক দুর্লভ দুর্লভ কিতাব মধ্য এশিয়ায় নিয়ে আসতো।
উয়ুনুল আমবা গ্রন্থে এসেছে, ৬৩২ হিজরীতে দামেশকে একটি অনারব ব্যবসায়ী দল এসে পৌঁছলো। তাদের নিকট ছিল জালিনুসের মানাফিউল আ’জা গ্রন্থের ব্যাখ্যা শরহু ইবনে আবি সাদিকের একটি কপি। শামে এর আগে তার কোনো নুসখা ছিল না।
আলেমদের অনুদান
অনেক সজ্জন ব্যবসায়ী আলেম এবং তালেবুল ইলমদের ব্যয়ভার বহন করতেন। এটাকে তারা ইবাদত মনে করতেন। অনুগ্রহ কিংবা প্রভাব খাটানোর জন্য করতেন না। এ ধরণের ব্যবসায়ী দু’ভাগে বিভক্ত। এক্তব্যবসায়ী আলেম। দুই—সাধারণ ব্যবসায়ী।
ব্যবসায়ী আলেমদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইমাম আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক। তিনি কাপড়ের ব্যবসা করতেন। তিনি বলতেন, পাঁচজন না থাকলে আমি ব্যবসাই করতাম না। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, সেই পাঁচজন কারা? তিনি বললেন, সুফিয়ান সওরী, সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা, ফুযাইল ইবনে ইয়ায, মুহাম্মদ ইবনে সাম্মাক এবং ইবনে উলাইয়া। তিনি খোরাসানে ব্যবসা করতেন। লাভ যা হতো, পরিবার এবং হজের জন্য কিছু রাখতেন। বাকিগুলো এ পাঁচজনের কাছে পৌঁছে দিতেন।
ইমাম লাইস ইবনে সাদের কথা এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি যখন হজ করতে মিসর থেকে মদীনায় এলেন, ইমাম মালিক (রহ.) তার জন্য কিছু হাদিয়া পাঠালেন। ইমাম লাইস ইবনে সাদ ফিরতি হাদিয়া পাঠালেন ইমাম মালিক (রহ.)-এর নিকট। এ হাদিয়ার পরিমাণ ছিল এক হাজার দিনার। ইমাম লাইস ছিলেন তৎকালীন মিসরের মুফতি। ইমাম যাহাবী সিয়ারে উল্লেখ করেছেন, লাইস ইবনে সাদ প্রতি বছর ইমাম মালিক (রহ.)-কে একশ দিনার দিতেন। ইবনে লাহীয়াহকে দিতেন এক হাজার দিনার। ওয়ায়িয মনসুর ইবনে আম্মারকে দিতেন এক হাজার দিনার।
ইমাম দালাজ সিজিস্তানির কথা পূর্বে বলা হয়েছে। তিনি আহলে ইলমদের জন্য বিরাট অঙ্ক দান করতেন। মক্কা এবং বাগদাদে আহলে হাদীসদের জন্য তিনি সম্পত্তিও ওয়াকফ করেছিলেন। ইমাম যাহাবী (রহ.) সিয়ারে তা উল্লেখ করেছেন। ইমাম আবু আমর শাফেয়ি বলেন, একদিন দালাজ আমাকে তার ঘরে নিয়ে গেলেন। একটি পয়সার থলে দেখিয়ে বললেন, তোমার প্রয়োজনমতো তুমি নিয়ে নাও। আমি তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললাম, না, দরকার নেই। আমার যথেষ্ট আছে।
মুহাদ্দিস ইবনে রিযা ইস্পাহানী ধন-সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন। তিনি আহলে ইলমদের ছিলেন অত্যন্ত উদার, হাতখোলা।
আলেমদের জন্য গাইরে আলেম সজ্জন ব্যবসায়ীরাও অনুদান দিতেন। তবে সব আলেমগণ তা গ্রহণ করতেন না। ইবনে কাসির (রহ.) আবদুল্লাহ ইবনে ইমাম আহমদ (রহ.) (মৃ: ২৯০ হি./৯০৩ খ্রি.) থেকে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘খলকে কুরআন প্রসঙ্গে অস্থির সময়ের কথা। আমরা তখন খলীফা ওয়াসেকের শাসনাধীন। কঠিন সময় পার করছে আমার পরিবার। এক লোক এই সময়ে আামর বাবার কাছে চিঠি পাঠালো, আমার নিকট চার হাজার দিরহাম আছে। (৫ হাজার মার্কিন ডলার)। আমার বাবা থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। এতে সদকা কিংবা যাকাত কিছুই নেই। এগুলো আপনাকে হাদিয়া দিতে চাচ্ছি। যদি গ্রহণ করতেন। আমার বাবা প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন, আপনার শুকরিয়া! আমাদের যথেষ্ট আছে। তারপর একদিন আরেকজন তিন হাজার দিনার দিতে চাইলো। (৫ লাখ মার্কিন ডলার)। বাবা তা গ্রহণ করতেও অস্বীকৃতি জানালেন।
উপসংহার
ব্যবসা ছিল আলেমদের স্বাধীনতার শ্বেতপত্র। তাদের জীবন-যাপনে, শরয়ি হুকুম বাস্তবায়নে বিত্তবানদের প্রভাবমুক্ত থাকার অন্যতম মাধ্যম। কারণ বিত্তবানরা প্রায়শই চেষ্টা চালান তাদের অনৈতিক কাজের নৈতিক বৈধতা দিতে। এ ক্ষেত্রে তারা কাজে লাগাতে চায় আলেমদের। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা না থাকলে নির্ভর হয়ে পড়তে হয় বিত্তবানদের দানের ওপর। প্রয়োজনের কথা চিন্তা করে তখন মুখ বুঝে সয়ে যেতে হয় সব অনৈতিক কাজ, লাঞ্ছনাকর অপমান।