মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন
পরম শ্রদ্ধেয় নিষ্ঠাবান ইসলামী কর্মবীর এডভোকেট আহমদ ছগীর, চট্টগ্রাম মহানগরীর বাসিন্দা ও পটিয়ার কৃতি সন্তান। দীর্ঘ কর্মময় জীবনের ইতি টেনে বার্ধক্যের হাত ধরে সম্প্রতি পরকালে পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিউন। তিনি ২ ছেলে ও ১ মেয়ে, স্ত্রীসহ হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মি ও আইনি পেশার অসংখ্য গুণগাহী রেখে যান। আশির দশক থেকেই তিনি চট্টগ্রাম মহানগরীতে আইন ব্যবসায় পেশাদারিত্বের গুণাবলি নিয়ে কর্মময় জীবন কাটাতে শুরু করেন। তাঁর বড় ছেলে শিক্ষানবিস এডভোকেট সুমন সাহেবের তথ্য অনুযায়ী তিনি আইন ব্যবসায় সুনাম অর্জন করে ১৯৮২ সালে জেলা বারের সেক্রেটারির পদ অর্জন করেন এবং নেতৃত্ব দেন। একজন আইনজীবী হিসেবে তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের কাছে তিনি ছিলেন বিশ্বস্ত, মর্যাদার এক হীরকখণ্ড। হাজারো আইনজীবীর মাঝে তিনি পেশাদারিত্বের বিশ্বস্ততা অর্জন করেছেন তা তাঁর সাথে তার চেম্বারে না গেলে বুঝতাম না। সততা ও মক্কেলদের অন্তরে জায়গা পাওয়া এমন এডভোকেটের সংখ্যা হাতে গোনা। তাঁকে কাছ থেকে দেখেছি যে, তাঁর মক্কেলদের বলতেন, কাগজ মজবুত তথা আইন ভিত্তিক দৃঢ়তা না থাকলে সে মামলার মেরিট বলতেই থাকেনা। এটির পিছনে অর্থব্যয় চরম বোকামি। মক্কেলের হয়রানি, সময়ের অপচয়ের পক্ষে আমি আহমদ ছগীর নেই। তার চেম্বারে যত বারই গিয়েছি দেখেছি চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠিত পরিবারের লোকদের দেওয়ানি মামলাবিষয়ক যুক্তি-তর্ক এবং মুনশির মুসাবিদার কলমের খসখস আওয়াজ। এডভোকেট কল্লোল বড়ুয়া, এডভোকেট আবুল ফজল ভাই লিখছেন আর তিনি আইনি ধারাগুলো বলে যাচ্ছেন। আইনের দুর্লভ বইগুলো তাঁর সামনে। ব্রিটিশ আইনসহ দেশি-বিদেশি আইনের বই এবং গাজীউল হকের সেরা আইনের অসংখ্য বইয়ের স্তুপ। এ ছাড়াও তিনি পরিবারের জন্য যে লাইব্রেরি গড়ে তুলেছেন তাতে আমাদের ইসলাম ধর্মীয় বইয়ের স্তুপ ছিল চোখে পড়ার মতো। ঐতিহাসিক আবু আলী সিনা, ফারাবী, ওমর খৈয়াম, কবি নজরুল, ফররুখ, ইবনে আরাবী, দার্শনিক ইমাম গাযালীর বইগুলো ছিল চোখে পড়ার মতো। তিনি সাধ্যমত তা অধ্যয়ন করতেন। এসবের নীতিবাক্য থেকে দলিল দিতেন। তিনি সম্ভবত ফেরেশতা চরিত্রের গুণগুলো এসব বই পড়ে পড়ে অর্জন করেছেন। তার কাছে অনেক দুর্লভ তাফসীরের কিতাব ছিল। তা তিনি নিয়মিত অধ্যয়ন করতেন। ৯০-এর দশক থেকে তিনি খেলাফত মজলিসের শায়খুল হাদীসের অর্থাৎ বাবরী মসজিদ আন্দোলনের আল্লামা আযিযুল হক সাহেবের সাথে যুক্ত হয়ে তাঁর দলের চট্টগ্রাম মহানগরীর সভাপতিত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন অতীব সুনামের সাথে। ময়দানে স্বচ্ছ, তেজীয়ান, চরিত্রবান বংশীয় ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ দক্ষ ওলামাদের সংশ্রবপ্রাপ্ত প্রাজ্ঞ ও বিদ্যান ব্যক্তি, শিক্ষানুরাগী বিশেষ করে নিষ্ঠাবান লোক রাজনীতির পতাকা হাতে নিলে সংগঠন করার জন্য কাউকে বেশি বলতে হয় না। এডভোকেট ছগীর সাহেব তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নির্মোহ, নির্লোভ অনেকটা মাওলানা ভাসানী ও শেরে বাংলা ফজলুল হক চরিত্রের সাহসী এ লোকটির কর্মির অভাব ছিল না। কর্মি ছিল ভরপুর। কর্মিদের প্রতি তিনি ছিলেন দয়ালু অভিভাবকস্বরূপ| বিনম্র অথচ সাহসী, আমানতদার, চরিত্রবান দক্ষ হিসেবে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিক। খিলাফত মজলিসের রাজনীতি তখন তুঙ্গে সে মুহূর্তে তিনি ২০০০ সালে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব হাতে নেন। এ ক্ষেত্রে এডভোকেট শামসুদ্দীন আহমদ মির্জাসহ তাঁর সিনিয়র অনেক বন্ধু তাকে উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে এ পদ তুলে দেন তার হাতে। তিনি বরাবরই বলতেন, আমি কি ভাবে দায়িত্ব পালন করবো; কি ভাবে বারের হক আদায় করবো। এডভোকেট আহমদ ছগীরের চেম্বার ছিল অনেকটা কাওমী ওলামাদের মিনি অফিস কক্ষ। তাদের রাজনৈতিক সুখ-দুঃখ বিশেষ করে আল্লামা আযিযুল হক, আল্লামা আমিনী, সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম পীর সাহেব চরমোনাই, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, পটিয়ার আল্লামা হারুন ইসলামাবাদীসহ এসব দীনের এ সিপাহসালাদের রাজনৈতিক সামাজিক, সংস্কৃতিক নৈতিক কর্মপদ্ধতির একজন চিন্তানায়ক ছিলেন তিনি। সাথে সাথে কর্মবীর হিসেবে চট্টগ্রামের এমন কোন রাজপথ নেই যে পথে তিনি মিছিল মিটিং করেননি। পার্বত্য চট্টগ্রাম সুরক্ষায় শান্তিচুক্তির ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ের ক্ষতির দিকগুলো তুলে ধরে তিনি শায়খুল হাদীসকে সাথে নিয়ে রামগড়ে সমাবেশ করে বাঙালি মুসলমানদের সংগঠিত করেছেন। তিনি উপমহাদেশের আযাদী আন্দোলনের রাহবার আবুল কালাম আযাদের ভক্ত ও অনুরাগী এবং সে মতবাদের রাজনৈতিক ছিলেন। তিনি নিজস্ব ভাষায় এমন উক্তি করতেন, ‘উম্মতে মুহাম্মদিয়ার মুল মাকসাদ (উদ্দেশ্য) হলো ইনসানে কামেল পয়দা করা।’ তিনি প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম সাহেবদের সাথে তামাদ্দুন মজলিসের ব্যানারেও কাজ করেছেন। আর এ তামাদ্দুন মজলিস ভাষা আন্দোলনের প্রথম ভূমিকা রেখেছেন।
তিনি তাঁর বন্ধু হিসেবে দৈনিক ইনকিলাবে কর্মরত বর্তমান ভাষা সৈনিক অধ্যাপক আবদুল গফুর সাহেবের সাথে তামাদ্দুন মজলিস করতেন। তিনি এডভোকেট আহমদ ছগীর নিজ দলের কর্মিদের ভালবাসতেন সবসময়। খোঁজ-খবর নিতেন। আর্থিক প্রয়োজন দেখা দিলে নগদ টাকা দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়াতেন। সংসারের ও খোঁজ-খবর নিতেন। নিজ হাতে বাজার করতেন। মিতব্যয়ী ছিলেন। অনিয়ম ছিল তার চক্ষুশূল। তিনি মিতব্যায়ী ছিলেন। সবার জন্য দরদ ছিল তার রাজনৈতিক ভারসাম্য দৃষ্টিভঙ্গি। যা আজ বড়ই অভাব। অন্য দলের বড় নেতাদের নাম নিতেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে। আমরা অনেক কিছু শিখেছি তার রাজনৈতিক গতিময় উজ্জ্বল জীবন থেকে।
তিনি এত ব্যস্ত মানুষ হয়েও আন্দরকিল্লা মসজিদ আবাদ রাখতেন। জামায়াতে যথাসময়ে নামায পড়তেন আন্তরিক হয়ে। এত ব্যস্ত কর্মময় সুন্দর চরিত্রের মানুষটি নিজ গৃহ পালিত পোষা বিড়ালটিরও খবর রাখতেন। একদিন বিড়ালটি অসুস্থ হলে তিনি ডাক্তারের নিকট ধর্ণা দেন চিকিৎসার জন্য। তার পরিবার ও রাজনৈতিক পরিবার এবং অগণিত গুণগ্রাহী এমন মহৎ কর্মবীর ও সরল ব্যক্তিত্ববান সুপুরুষ ইসলামের জন্য নিবেদিত বীরকে হারালাম। যিনি আর আসবেন না এ বসুধায়। আমাদের কাছে রেখে গেলেন কর্মের ঝলমলে রূপবান আদর্শগুলো ধারণ করবো। জান্নাতের সুশীতল আরামের ছায়াতলে আল্লাহ তাকে নিজ দয়ায় জায়গা করে দিন আমীন।