বৃহস্পতিবার-২২শে জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি-২২শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ভুল-স্বীকার: পরিশীলনের  সদরদরজা

ভুল-স্বীকার:পরিশীলনের  সদরদরজা

মুহাম্মাদ হাবীবুল্লাহ

একজন গ্রিক শিল্পীর গল্প পড়েছিলাম।

তিনি একসময় একটি ছবি আঁকলেন—একজন মানুষের ছবি, তার হাতে আঙুরের থোকা। প্রদর্শনীর জন্য বাজারে রাখলেন। শিল্পীর এক বন্ধুর নজরে পড়ল ছবিটি। তিনি শিল্পীবন্ধুকে ধন্যবাদ দিলেন খুব। বললেন, খুব দারুণ একটা শিল্পকর্ম হয়েছে এটি। তোমার হাত সত্যি শিল্পবোদ্ধা। আঙুরের ছবিটা এত যুতসই হয়েছে যে, চড়ুইরা বাস্তবে আঙুর মনে করে ঠোঁট বসাচ্ছে। বন্ধুর কথা শুনে হতচকিত হয়ে ওঠেন শিল্পী। ধন্যবাদের ভেতর চটচটে একটা তাচ্ছিল্য তিনি ধরতে পারলেন। কিন্তু তিনি বখাটে ব্যাখ্যার পথ না ধরে সাথে সাথেই বললেন, এ শিল্পকর্মে নিশ্চয় কোনো ত্রুটি থেকে গেছে। নইলে চড়ুইরা কখনও ঠোঁট বসাবার দুঃসাহস করত না।

একই ছবি পুনরায় আঁকলেন তিনি। আঙুরের থোকা হাতে আস্ত একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন ছবিতে। আঙুরের চিত্র অসম্ভব নিখুঁত হয়েছে, যা দেখে চড়ুই লালায়িত হয়ে আসবে, কিন্তু ঠোঁট বসাবার সাহস করবে না। কারণ, মানুষের ছবিতে এখন চোখগুলো লালটুকটুকে অগ্নিঝরা, যা দেখলেই চড়ুই ফুরুৎ করে উড়ে যাবে। বসার সাহস করবে না।

‘ভুল স্বীকার’ মানুষকে এভাবেই নিখুঁত ও পরিশীলিত করে তোলে। বাস্তবতা সপষ্ট হওয়ার পরও না মানা মানে নিজেকে বড় মনে করা আর বাস্তবতাকে ছোট মনে করা। মানুষ কখনও বাস্তবতার চেয়ে বড় হতে পারে না। ফলে যাই হবার তাই হয়। নিজেই ছোট হয়ে যায়—নিজের কাছেও, পরের কাছেও।

ভুল-স্বীকারে মানুষের স্বতঃস্ফর্ততার অভাব কেন? কারণ, মানুষ ভুল-স্বীকারকে মনে করে হীনম্মন্যতা, কাপুরুষতা এবং ইজ্জতের জলাঞ্জলি। অথচ মানুষ প্রকাশ করতে চায় বীরত্ব, আত্মসম্মান। চিন্তকরা বলেছেন, এ মানসিকতা নিতান্তই ভুল। কিঞ্চিৎ অসম্মানকে যে নিজের প্রাপ্য বলে বুক পেতে নেয় সে অসম্ভব সুন্দর ও সম্পন্ন মানুষ। মানুষের জন্য সবচেয়ে বাহাদুরি হচ্ছে ভুল স্বীকার করা। এটি সমস্ত সামাজিক অগ্রগতির মূল প্রাণ।

অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে যদিও, কিন্তু বাস্তবতা হলো, মেনে নিলে সমস্যা নিমিষেই চুকে যায়। অতিরিক্ত আঁধারির ঘনঘটা তৈরি হয় না। আলো ফুটে ওঠে। যে মেনে নেয় সে আসন্ন সম্ভাবনার চশমাটাকে রঙিন করে রাখে। পরিশেষে সফল সে-ই। শেষ হাসিটুকু তার জন্য বরাদ্দ।

‘মেনে নেওয়া’ হচ্ছে মানবীয় জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল বাস্তবতা। ঈমান কী? মেনে নেওয়া। মানুষ নিজেকে চাপিয়ে আল্লাহর বড়ত্বকে মেনে নেয়। অধিকার আদায় করা মানেও মেনে নেওয়া। মানবতার সপক্ষে বিশাল দায়িত্বের কথা সে মেনে নিল। তাওবার কথাও যদি বলি, সেটাও তো মেনে নেওয়া। তাওবার মাধ্যমে মানুষ কী স্বীকার করে? আল্লাহর কাছে যেটা শুদ্ধ সেটাই আসল শুদ্ধ। আল্লাহর কাছে যেটা ভুল সেটাই প্রকৃত ভুল। জীবনে সবকিছুর সংশোধনের আসল প্রাণ এই মেনে নেওয়ার মধ্যেই নিহিত।

এ জন্যই বলতে হয়, মেনে নেওয়ার মানসিকতা সমস্ত অগ্রগতির সদরদরজা। কিন্তু চরম আক্ষেপের বিষয় হলো, এ মানসিকতার মানুষ নিতান্ত অঙ্গুলিমেয়। স্বীকার করা বা মেনে নেওয়ার বিষয় যখন সামনে আসে তখন সবার দেমাগে শুধু দাপাদাপি করে আত্মসম্মানের নানা প্রশ্ন। ফলে সে নিজের ভুলের ওপর একটি ছাদ তৈরি করতে চায়। আর সে ছাদের নিচে চাপা পড়ে ধ্বংস হয়ে যায় তার জীবনের সবকিছুই।

… … … … …

‘তুমি ভুল করেছে।’

‘আমি ভুল করেছি।’

তিনটি করে শব্দের দুটি বাক্য। বাহ্যত দুটি বাক্যে পার্থক্যও সামান্য—একটিমাত্র শব্দে: আমি আর তুমি।

আসলে কি পার্থক্য সামান্যই? কিছুতেই না। তাৎপর্য ও প্রয়োগের দিক থেকে উভয়ের পার্থক্য আসমতল-হিমালয়। প্রথম বাক্যটি সদর্পে উচ্চারণ করে এমন লোক হবে লাখে-লাখে, কোটিতে কোটিতে। কিন্তু এ তিন শব্দের এক বাক্য অকাতরে উচ্চারণ করে, এরকম মানুষের সংখ্যা তিনজনও মেলা দায়। আমাদের অভিধানে এখন ‘আমি ভুল করেছি’ বাক্যটা নেই। আছে শুধু, ‘তুমি ভুল করেছ, তুমি ভুল করেছ’। মানুষ এখন যেকোনো বিনিময়ে নিজের ভুলটা না মানার জন্য প্রবৃত্ত। তার জন্য ‘অনিবার্য বাস্তবতা’কে জবাই করতেও রাজি। ফলে হয় কি, একটা ভুল না মানতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ে অজস্র ভুলে। সামান্য যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে গিয়ে দশ দিক থেকে তাকে ছেঁকে ধরে ঝাঁক ঝাঁক ভিমরুল।

কারণ প্রথম বাক্যটি নিজের পক্ষে কথা বলে, অপরকে নাকচ করে দেয়, আর দ্বিতীয় বাক্যটি স্বয়ং নিজেকে নাকচ করে দেয়। অন্যকে নীচ ও নাকচ করা পৃথিবীর সহজতর কাজ। নিজেকে নীচ ও নাকচ করা ভয়ঙ্কর কঠিন!

‘তুমি ভুল করেছ’ একটি মিথ্যা বাক্য। আর ‘আমি ভুল করেছি’ একটি সত্য বাক্য। স্রষ্টার বিধান হলো, এই পৃথিবীতে মিথ্যা শেকড় গজাতে পারে না। খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। পক্ষান্তরে সত্য কথা পৃথিবীর জমিনেও শেকড় গাড়তে পারে। আকাশেও বিস্তার করে তার শাখা-প্রশাখা।

اَلَمْ تَرَ كَيْفَ ضَرَبَ اللّٰهُ مَثَلًا كَلِمَةً طَيِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَيِّبَةٍ اَصْلُهَا ثَابِتٌ وَّفَرْعُهَا فِي السَّمَآءِۙ۰۰۲۴

‘তুমি কি দেখ নি, আল্লাহ কেমন দৃষ্টান্ত দিয়েছেন সত্য কালিমার? তা এক পবিত্র বৃক্ষের মতো, যার মূল (ভূমিতে) সুদৃঢ়ভাবে স্থিত আর শাখা-প্রশাখা বিসত্মৃত আকাশে।’ (সূরা ইবরাহীম: ২৪)

এবার বাক্যদ্বয়ের তাৎপর্য একটু গুছিয়ে বুঝি :

  • ‘আমি ভুল করেছি।’—একটি মারেফতি কালিমা, আধ্যাত্মিক বাক্য, যা অবনত মানুষকে উন্নত ও সম্পন্ন ব্যক্তিতে রূপান্তরিত করে।
  • ‘তুমি ভুল করেছে।’—সারশূণ্য এক ফাঁকা বুলি, যা কোনো ব্যক্তিকে গভীর অর্থজগতের সাথে পরিচিত করে না।
  • ‘আমি ভুল করেছি।’—বিনির্মাণী বাক্য।
  • ‘তুমি ভুল করেছ।’—ধ্বংসাত্মক দাবি।
  • ‘আমি ভুল করেছি।’—আল্লাহর ইবদাত।
  • ‘তুমি ভুল করেছি’—প্রবৃত্তিপূজা|
  • ‘আমি ভুল করেছি।’—নেককারি।
  • ‘তুমি ভুল করেছ’—নেতাগিরি।
  • ‘আমি ভুল করেছি।’—দীনদারি।
  • ‘তুমি ভুল করেছ।’—দুনিয়াদারি।

***

মানুষের স্বভাব হলো, হয় সে নিজের ভুল স্বীকার করে শানিত্ম পায়—যদি সে সুন্দরমনের মানুষ হয়; নতুবা অন্যের ভুল ধরে ঝাল মিটায়। প্রথম গুণটাই প্রশংসাযোগ্য, একজন পরিমার্জিত মানুষের ভূষণ।

তাই আসুন, আজ থেকে ‘আমি ভুল করেছি’ বাক্যটি বলার ‘রেওয়াজ’ করি। প্রতিদিন কমপক্ষে দশবার করে বলতে থাকি—আপনাতে আচ্ছন্ন হয়ে, ধ্যানমগ্ন হয়ে।

ঊর্ধ্বকমায়িত করে খুব সচেতনভাবে রেওয়াজ শব্দটি আমি ব্যবহার করেছি। তার কারণ, রেওয়াজ হলো খুব কঠিন সাধনা ও অধ্যবসায়ের কাজ। সঙ্গীত শেখার দুঃসাধ্য প্রশিক্ষণ।

দিনের পর দিন রেওয়াজ করে গায়কের গলা শুদ্ধ হয়। মিষ্টি হয়, মসৃণ হয়। সে মিষ্টি গলার গান মতিয়ে তোলে সুরপিপাসুদের, দুলিয়ে দেয় পুরো দুনিয়া। ঠিক সেভাবেই ভুল-স্বীকারের রেওয়াজ করতে আমাদের। তাহলেই আমরা শুদ্ধ হব, মিষ্টি হব, মসৃণ হব।

রেওয়াজের কথা যখন এসেছে, দেখি, কে কতটুকু গলার মকশো করতে পারি। কবি কায়কোবাদের কবিতাটি আমাদের কণ্ঠে-কণ্ঠে বেজে উঠুক,

বাস্তব ছাড়িয়া আমি

অবাস্তব পাছে

ঘুরিয়াছি নিশিদিন, এবে মোর অনুড়্গীণ

তুমি ভিন্ন এ জগতে

কে আমার আছে?

তুমিই আমার স্বামী, পথ ভ্রান্ত পাপী আমি

হাত ধরে প্রভু তুমি

কোলে তুলে নাও!

যে ভুলে তোমারে ভুলে, হীরা ফেলে কাঁচ তুলে

ভিখারী সেজেছি আমি—

—আমার সে ভুল প্রভু,

তুমি ভেঙে দাও!

(কবি কায়কোবাদ)

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ