জামেয়া ওয়েবসাইট

শুক্রবার-২৯শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিসবাহ (রহ.): হায়াত খেদমাত মামুলাত

হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিসবাহ (রহ.): হায়াত খেদমাত মামুলাত

হাফেয মাওলানা রফিকুল্লাহ

 

হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিসবাহ (রহ.) ছিলেন একজন সুপ্রসিদ্ধ দীনী ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন এই দেশের জনপ্রিয় একজন বুযুর্গ ও মুফাসসীরে কুরআন। বাংলাদেশের গ্রাম অঞ্চল থেকে শুরু করে শহরে-বন্দরে এমনকি বিদেশেও রয়েছে তাঁর অসংখ্য ভক্ত। তাঁর জানাযার নামাযকে উদ্দেশ্য করে হাজার হাজার মানুষের যে ঢল নেমেছিল এটাই তার বাস্তব প্রমাণ। আমি ছাত্রজীবন থেকে হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিসবাহ (রহ.)-কে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি।

আকাবিরদের প্রতি শ্রদ্ধা

কোথাও যদি কোনো আকাবির ও মুরব্বি জীবিত থাকতেন তিনি তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ করে দুআ চেয়ে নিতেন। আর যদি মৃত্যুবরণ করতেন, তবে সুযোগ হলে তিনি তাঁদের কবর যিয়ারত করতেন।

একবারের ঘটনা

আমি ১৪১১ হিজরীতে ভোলা চরসফি মাদরাসায় শিক্ষকতা করতাম। তখন ওই মাদরাসায় খতীবে আযম (রহ.)-এর বার্ষিক মাহফিলের প্রোগ্রাম হলো। মাহফিল শেষে সকালে আমাকে বললেন, ‘চল! চরখলিফা মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম বহুত বড় বুযুর্গ ছিলেন, তাঁর কবর যিয়ারত করে আসি।’ তখন আমরা উভয়ে গিয়ে কবর যিয়ারত করি। তিনি ওয়ায ও নসীহতের মধ্যে আকাবির এবং বুযুর্গদের কথা আযমত ও সম্মানের সাথে নকল করতেন, যা শুনে শ্রোতারা হয়রান হয়ে যেত।

চারিত্রিক গুণাবলি

যখন কোনো লোক খতীবে আযমের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আসত, তিনি এমনভাবে হাসিমুখে কথা বলতেন, মনে হত যেন বহুত বছর আগের পরিচিত মানুষ। সবাই মনে করতেন, হুযুর আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন, মুহাব্বত করেন। এটাই ছিল নববী আখলাক।

ওয়ায-নসীহত রাত্রিজাগরণ

হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিসবাহ (রহ.) যিননুরাইন মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করার পূর্বে যে এলাকায় মাহফিলে তাশরীফ নিতেন সে এলাকায় প্রায়সময় রাত্রে অবস্থান করতেন এবং মাহফিল শেষে যত রাত্রেই নিদ্রা যেতেন তাহাজ্জুদের সময় উঠে তাহাজ্জুদ পড়তেন এবং উম্মতের হেদায়েতের জন্য দুআয় কান্নাকাটি করতেন। ফযরের নামাযের ইমামতি করতেন। নামাযের পর সুরা ইয়াসিনসহ মামুলাত আদায় করে ওয়ায ও নসীহত করতেন। বলতেন, ‘এই সময়ের বয়ান অত্যন্ত ক্রিয়াশীল। কারণ হচ্ছে, মানুষ এ সময় চিন্তামুক্ত থাকে, যা শোনা হয় তাই অন্তরে বসে যায়।’

বর্তমানে তো অধিকাংশ বয়ান গাড়ি হাঁকিয়ে রেডিমেট ওয়ায করে (যা ওয়ায তো নয়, বরং আওয়াজ শুনিয়ে ২০/২৫ হাজার টাকা নিয়ে চলে যায়, যা একমাত্র কানসুক ছাড়া আর কিছুই নয়। উজানীর পীর হযরত মোবারক করীম পীর সাহেব (রহ.) বলতেন, ‘এখন তো ওয়ায নেই আছে কেবল আওয়াজ।’

ওলামা বাজারের হযরত এবং হযরত হাবীবুল্লাহ মিসবাহ (রহ.)সহ বড়দের ওয়াজে দেখেছি কান্নার আওয়াজ। বয়ানিরাও কাঁদতেন এবং শ্রোতারাও কাঁদতেন। বর্তমানে কোনো কোনো বয়ানী নিজেও হাসেন অন্যকেও হাসান। কেউ বলে ঠিক আর কেউ করে হৈ-হল্লা। কোনো কোনো বয়ানী প্রতিপক্ষকে গায়েল করে ওয়ায করেন কিন্তু খতীবে আযম (রহ.)-কে দেখেছি তার ব্যতিক্রম। প্রতিপক্ষকেও কোলে টেনে মুহাব্বতের ভাষায় ওয়ায-নসীহত করতেন।

(এ কথা মনে রাখা উচিৎ বর্তমান সময়ে সব প্রতিপক্ষ এক নয়, কিছুকিছু ক্ষেত্রে গোমরাহ প্রতিপক্ষদের গায়েল না করলে তারা নিজেদের বিজয়ী আর হক ভাবতে শুরু করে) এজন্য সর্বস্তরের মানুষ দলমত নির্বিশেষে তার ওয়ায ও নসীহত শুনতেন এবং তাঁকে মনে-প্রাণে ভালবাসতেন মুহাব্বত করতেন।

একদিনের ঘটনা

ফযরের নামাযের পর তিনি আমাকে নিয়ে হাঁটতে বের হলেন নোয়াখালী মিরওয়ারিশপুর হোসাইনিয়া মাদরাসার এলাকায়। হঠাৎ এক স্কুল পড়ুয়া ছাত্র এসে বলল, ‘হুযুর আমাদের ঘরে চলেন!’ তিনি আমাকে বললেন, ‘এরা যে আমাদের ভালবাসে তার মূল্যায়ন করা দরকার।’ সেই ছাত্র আজও গর্ব করে বলে, ‘হুযুরকে আমাদের বাসায় এনে হুযুরের কিছু খেদমত করতে পেরেছি।’

হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিসবাহ (রহ.) ও স্কুল-কলেজ ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্রদের ভালবাসতেন এবং স্কুল-কলেজ ভার্সিটিতে প্রোগ্রাম করাকে পছন্দ করতেন। আর আমাদের বলতেন, ওলামায়ে কেরাম তাদেরকেও দীন পৌঁছাতে হবে।

তিনি পুরো বছর ধারাবাহিকভাবে সারা দেশে তাফসীর মাহফিল করতেন। কিন্তু টঙ্গীর বিশ্বইজতেমার সময় কোনো প্রোগ্রাম না নিয়ে ইজতেমার ময়দানে অংশগ্রহণ করে তাবলীগী মুরব্বিদের বয়ান শুনতেন এবং বিশেষ করে ওলামাদের খাস বয়ানে অংশগ্রহণ করে তাবলীগী মুরব্বিদের তাশকীলের সময় নিজে তাশকীল হতেন এবং অন্য ওলামায়ে কেরামকেও তাশকীল করতেন।

খুলুসিয়াত লিল্লাহিয়াত

এত বড় খতীব হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ গাড়িতে চলাফেরা করতে দেখেছি। চুক্তি করে মাহফিলের কর্মকর্তাদের থেকে কোনো টাকা-পয়সা নিতে দেখিনি; বরং যে যা হাদিয়া দিতেন না দেখেই গ্রহণ করতেন। হায় আফসোস! আজ সেই তাফসীরুল কুরআন মাহফিলগুলো নিভু নিভু অবস্থায় !!

মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিসবাহ (রহ.) এই মাকামে পৌঁছার অনেক কারণ থাকতে পারে, আমার যা নজরে পড়েছে এবং শুনেছি, একমাত্র তার আব্বা ও আম্মার দুআ এবং তার চেষ্টা ও সাধনার পাশাপাশি উস্তাদের ভয়-ভক্তি ভালবাসার বরকতে। হযরত থেকে শুনেছি, আব্বা আমার জন্য সব সময় দুআ করতেন এবং আব্বাজানের কোনো ছাত্র আব্বাজানের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য আসলে বলতেন, ‘আমার হাবীবুল্লাহর জন্য দুআ করিও, আল্লাহ পাক যেন দীনের খেদমতের জন্য কবুল করেন।’ উস্তাদের ভক্তি-ভালবাসা হযরতের মুখ থেকে শুনেছি, ‘আমি যখন পাকিস্তানে আল্লামা ইদরীস কান্ধলভীর কাছ থেকে তাফসীর পড়ে দেশে ফিরবো তখন আমি বিদায় নেওয়ার জন্য হযরতের সাথে সাক্ষাত করার সময় জার জার করে কাঁদছিলাম আর উস্তাদে মুহতারাম আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। এই ছিল উস্তাদের ভক্তি ও ভালবাসা।

আমি স্বচক্ষে দেখেছি মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিসবাহ (রহ.) যখন জামিয়া যিননুরাইন প্রতিষ্ঠা করলেন সেই সময়ের মধ্যে হাটহাজারী মাদরাসার শায়খুল হাদীস আমাদের উস্তাদে মুহতারাম শাহ আবদুল আজিজ (রহ.) এবং আল্লামা শাহ আহমদ শফি (দা. বা.) বড়গাঁ মাদরাসায় বার্ষিক মাহফিলে তাশরীফ আনলেন। আল্লামা হাবীবুল্লাহ মিসবাহ (রহ.) উস্তাদে মুহতারামের পা টিপে দিচ্ছেন আর কথা বলছেন। উভয় বুযুর্গ জামিয়া যিননুরাইনে সকালের নাস্তার দাওয়াত কবুল করায় আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য জিম্মাদার বানিয়ে তিনি চলে গেলেন। আমি সকালে উভয়কে জামিয়া যিননুরাইন নিয়ে গেলাম। সেখানে দেখেছি ওস্তাদের খেদমত ও ভালবাসা কাকে বলে!!

হযরত মিসবাহ (রহ.)-এর আব্বাজান বদলকোট বাজার মসজিদে প্রত্যেক রমযানে তাফসীর করতেন। মিসবাহ সাহেব (রহ.) যখন পাকিস্তান থেকে আসলেন তখন আব্বাজান তাফসীর না করে আপন ছেলেকে তাফসীর করার হুকুম করলেন। আর তিনি পাশে থেকে ছেলের তাফসীর শুনতেন। ধীরে ধীরে তিনি চৌমুহনী বড় মসজিদেও তাফসীর করার সুযোগ পেলেন। এখান থেকেই তাঁর তাফসীর ওয়ায ও নসীহতের সুখ্যাতি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

বৈশ্বিক চিন্তাধারা

বিশ্বনবীর উম্মত হিসেবে আগের নবীদের একটা এলাকা ও কওম এবং গোত্রের জন্য আল্লাহপাক প্রেরণ করতেন; কিন্তু আমাদের নবীকে আল্লাহপাক বিশ্ববাসীর হেদায়েতের জন্য বিশ্বব্যাপী চিন্তাধারা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। সে জন্য এ উম্মতের ওলামায়ে কেরামেরও চিন্তাধারা বিশ্বব্যাপী হতে হবে, যা আমি হযরত হাবীবুল্লাহ মিসবাহ (রহ.)-এর মধ্যে দেখেছি। তিনি যখন জামিয়া যিযননুরাইন প্রতিষ্ঠা করেন তখন শুধু মাদরাসার জন্য জায়গা খরীদ করতেন, ঘর-দরজার দিকে মন দিতেন না। বলতেন জায়গা হয়ে গেলে একদিন ঘর-দরজা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আমার অনেক কিছু এখানে করার চিন্তাধারা আছে, যাতে করে বিশ্বব্যাপী দীনের কাজ এখান থেকে আঞ্জাম দিতে পারি।

আমরা যখন তাঁর সাথে সাক্ষাতে যেতাম, তখন আমাদের বলতেন, চলো! আমার মাদরাসার এরিয়াটা ঘুরে আসি। ঘোরার সময় পরিকল্পনাগুলো বলতেন এবং আমাদের শুনিয়ে দুআ চাইতেন। আল্লাহপাক যেন ভবিষ্যতে পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের তৌফিক দেন।

হযরত মিসবাহ (রহ.) স্বল্প থেকে স্বল্প নেয়ামতেরও কদর করতেন। ছাতারপাইয়া কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে প্রতিবছর আমাদের উদ্যোগে তাফসীর মাহফিল অনুষ্ঠিত হতো। সেখানে ধারাবাহিক তাফসীর করতেন। মাহফিল শেষ হওয়ার পর ভক্তবৃন্দ সালাম-মুসাফা করতেন। কেউ কেউ হাদিয়াও দিতেন। এক ব্যক্তি এক টাকার একটি কয়েন হাতে দিলেন। তিনি উচ্চৈঃস্বরে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ! অথচ বড় অংকের হাদিয়া পেয়েও এত জোরে আওয়াজ আমি কখনও শুনি নি। এই ছিল তাঁর স্বল্প থেকে স্বল্প নেয়ামতের কদর।

ইবাদত-বন্দেগি

আমি তাঁর সাথে ১৪১১ হিজরিতে চাটখিল বদলকোট মুন্সিবাড়ি মসজিদে ই’তিকাফ করেছি। তখন হযরতের পবিত্র জবানে শুনেছি, আমার আব্বাজান মরহুম বাড়ির মসজিদে ই’তিকাফ করতেন এবং ই’তিকাফকারীদের জন্য বড় একটা মশারী বানিয়ে সেই মশারীর ভেতরে ই’তিকাফকারীদের নিয়ে রাত্রিযাপন করতেন। আমিও তোমাদের জন্য বড় মশারীর ব্যবস্থা করেছি। ই’তিকাফকারীদের নিয়ে মশারির ভেতরে রাত যাপন করবো। তিনি সর্বপ্রথম ই’তিকাফ করতেন বাড়ির মসজিদে। পরে ঢাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হাজী আবদুল মালেক (রহ.)-এর অনুরোধে তেজগাঁও ই’তিকাফ করেন। পরবর্তীতে চাটখিল বদলকোট মুন্সিবাড়ি মসজিদেও ই’তিকাফ করেছেন। ই’তিকাফ অবস্থায় তাঁর মামুলাতসমূহ স্বচক্ষে দেখেছি।

হযরত তারাবীর পর বিভিন্ন মামুলাত আদায় করে কিছুক্ষণ ঘুমাতেন। ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর ই’তিকাফকারীদের নিয়ে তাহাজ্জুদের নামায পড়ে মাওলার দরবারে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে রোনাজারী করতেন। সেহরী খাওয়ার পর ফযরের নামাযের প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। ফযরের নামায শেষে বিভিন্ন মামুলাত আদায় করে একটু আরাম করতেন। পুনরায় ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ইসলাহী বয়ান করতেন। তারপর গোসল সেরে যোহরের নামাযের পর আম বয়ান করতেন। বয়ানের পর একটু আরাম করে আসরের নামাযের প্রস্তুতি নিতেন। আসরের নামাযের পর থেকে ইফতার পর্যন্ত বিভিন্ন মামুলাত ও দুআয় মশগুল থাকতেন।

আজ মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিসবাহ (রহ.) আজ আমাদের মাঝে নেই। আমাদেরও একদিন এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। তাই আমরা তাঁর জীবনের আদর্শ গ্রহণ করে নিজেদের জীবনকেও উদ্ভাসিত করে তোলার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করি। তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করি এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে তাঁর উচ্চ মর্যাদা নসীবের জন্য দুআ করি।

লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া দারুল উলুম মিরওয়ারিশপুর হুসাইনিয়া মাদরাসা, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ