স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব-কর্তব্য
উম্মে আইরিন
বর্তমান সমাজে বেশি বেশি আলোচনা হয় স্বামীর প্রতি স্ত্রীর দায়িত্ব কর্তব্য নিয়ে। মনে হয় যেন সংসারে স্ত্রীর কোন মূল্যই নেই, স্বামীর সংসারে মুখ বুজে খেটে যাবার জন্যই তার পয়দা। যখন সমাজে এই চিন্তা প্রবল হয় তখন এই সুখের সংসার, এ প্রেমের গার্হস্থ্য স্বামী-স্ত্রীর কাছে অত্যন্ত বিকট বীভৎস আকার ধারণ করে। এ বীভৎসতা থেকে সমাজকে মুক্তি দিতে রাসুল (সা.)-এর পথ গ্রহণ একমাত্র পথ।
হযরত ইবনে ওমর (রাযি.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) বলেছেন,
«أَلَا كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، فَالْإِمَامُ الَّذِيْ عَلَى النَّاسِ رَاعٍ وَهُوَ مَسْئُوْلٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلَىٰ أَهْلِ بَيْتِهِ، وَهُوَ مَسْئُوْلٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالْـمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَىٰ أَهْلِ بَيْتِ زَوْجِهَا، وَوَلَدِهِ وَهِيَ مَسْئُوْلَةٌ عَنْهُمْ».
‘শুনে রেখো, তোমরা প্রত্যেকেই রাখাল বা প্রহরী। আর প্রত্যেককেই তার অধিনস্তদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। ইমাম বা নেতা যিনি শাসন করেন সাধারণ মানুষকে তাকেও তার অধিনস্তদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। একজন পুরুষ তার বাড়ির লোকদের রাখাল বা প্রহরী। তাকে তার অধিনস্ত লোকদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। নারী তার স্বামীর ঘরের লোকদের এবং সন্তানদের রাখাল বা প্রহরী। তাকে তার অধিনস্ত লোকদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।’[1]
হাদীসের রাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.) আট বছর বয়সে তাঁর পিতার সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন। খন্দকের যুদ্ধসহ পরবর্তী প্রত্যেকটি যুদ্ধে তিনি শরীক হন। তিনি ছিলেন সুন্নাতে রসুলের একজন একনিষ্ঠ অনুসারী। পার্থিবতার প্রতি তাঁর কোন আকর্ষণ ছিল না। পদের প্রতিও তাঁর কোন লোভ ছিল না। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১৬৩০টি। তিনি অনেক সাহাবীদের থেকেও হাদীস বর্ণনা করেছেন। আর তাঁর থেকে রিওয়ায়ত করেছেন তাবেয়ীগণ। পুত্র হযরত সালিম (রহ.) ও গোলাম নাফি (রহ) তাঁর থেকে বেশি রিওয়ায়ত করেছেন। ৭৩ হিজরীতে ৮৫বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। রসুলে করীম (সা.)-এর ওফাতের পর তিনি ষাট বছর জীবিত ছিলেন।
আলোচ্য হাদীস খানাতে মানব জীবনের সর্বস্তরের দায়িত্বশীলদের দায়িত্বানুভূতি সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে। পরিবার ও সমাজ জীবনে নারীদের দায়িত্ব সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
নারী জাতিকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টির প্রবাহকে সচল রাখতে ও সন্তান সন্ততির লালন-পালনের প্রয়োজনে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রকৃতি প্রদত্ত দায়িত্ব হলো, এই কর্তব্যকে সে সর্বদা সুচারুরূপে সম্পাদনের জন্য চেষ্টা করবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, জাতীয় উন্নতির মূল প্রতিটি শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার ওপর নির্ভরশীল। মানব শিশু মাতার পরিচর্যার মাধ্যমে প্রথম জীবনে উন্নত মন ও চরিত্রের অধিকারী হয়ে থাকে। সন্তানের ওপর মায়ের প্রভাব বেশি। স্বামীর পরিবার ও সন্তান সন্ততির সার্বিক দায়িত্ব মায়ের উপরে বর্তায়। তাকেই এ ব্যাপারে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। আর তাকে এ ব্যাপারে সহায়তা প্রদান স্বামীর দায়িত্ব।
নারী জাতিকে যে প্রয়োজনে সৃষ্টি করা হয়েছে সে দায়িত্ব পালনে অংশ গ্রহণ করা পুরুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই নারী জাতির দায়িত্বকে খাট করে দেখার অবকাশ নেই।
স্বামী-স্ত্রীর যৌথ প্রচেষ্টায় সংসার ও সমাজ জীবন সুন্দরভাবে গড়ে ওঠে। কুরআন মজীদ বিশ্বমানবতাকে জানিয়ে দিচ্ছে যে, জীবনের সব রকম তৎপরতা ও উত্থান পতনের ক্ষেত্রে সর্বদাই নারী ও পুরুষ পরস্পরকে সহযোগিতা করছে। ঊভয়ে মিলে জীবনের কঠিন ভার বহন করছে এবং উভয়ের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় সভ্যতা ও তমদ্দুনের ক্রমবিকাশ ঘটছে। আল্লাহর ঘোষণা:
وَالْمُؤْمِنُوْنَ وَالْمُؤْمِنٰتُ بَعْضُهُمْ اَوْلِيَآءُ بَعْضٍ١ۘ يَاْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ ؕ ۰۰۷۱
‘আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু। তারা ভালো কাজের আদেশ দেয়, মন্দ কাজ করতে নিষেধ করে।’[2]
নবী (সা.) বলেছেন, ‘নারীরা পুরুষের অর্ধাংশ।’ (সুনানে আবু দাউদ ও তিরমিযী)
নারী পুরুষ প্রত্যেকেই সমপরিমানে পরস্পরের মুখাপেক্ষী। এতে লাঞ্ছনা ও অপমানের কিংবা মর্যাদা ও গৌরবের কোন প্রশ্নই আসে না। আল্লাহ বলেন,
هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَاَنْتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ١ؕ ۰۰۱۸۷
‘তারা তোমাদের পোশাক আর তোমরা তাদের পোশাক।’[3]
তাই স্ত্রীদের ইজ্জত-আবরু রক্ষা করার দায়িত্ব স্বামীর উপরে বর্তায়। তাদের কোন দুর্বলতাকে (যদি থাকে) মানুষের সামনে প্রকাশ না করা স্বামীর মহৎ গুণ। একইভাবে উত্তম স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর ইজ্জত সমাজে কীভাবে বৃদ্ধি পাবে তার দিকে নজর রাখা।
কুরআনের এ আয়াতের ঘোষণা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে নবী (সা.)-এর ঘোষণায়। গোটা বিশ্ব যখন নারীকে অপরাধের উৎস এবং সাক্ষাত পাপ ও গোণাহের কারণ মনে করে বসে ছিল তখন বিশ্ব জাহানের সর্ব কালের অতি পবিত্র ব্যক্তি পাপ ও অশ্লীলতায় ভরা চিন্তার মূলে পরিবর্তন আনতে ঘোষণা দিলেন,
«حُبِّبَ إِلَيَّ مِنَ الدُّنْيَا النِّسَاءُ وَالطِّيْبُ، وَجُعِلَ قُرَّةُ عَيْنِيْ فِي الصَّلَاةِ».
‘দুনিয়ার বস্তু নিচয়ের মধ্যে আমি ভালবাসি নারী এবং সুগন্ধি আর আমার চোখ শীতলকারী হল নামায।’[4]
পুরুষ সমাজের কর্তব্য, আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব পালনে মেয়েদের সহযোগিতা করা। মায়ের আত্মত্যাগের ফলেই জাতি সৎ ও সুসন্তান লাভ করে। তাই মায়েদের প্রতি অবহেলা দেখালে, তাদের প্রতি স্বামীর যে দায়িত্ব রয়েছে তা পালনে অবহেলা দেখালে পরিবার সমাজে ভাংগন নেমে আসে। ইসলাম নারীদেরকে যে অধিকার প্রদান করেছে তা অবহেলা করে মানবীয় নিয়ম ও আইন করে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বেইজিংয়ে ১৯৯৫ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর বিশ্বের ১৮৫টি দেশ ১০ হাজার সরকারি প্রতিনিধি এবং ২০ হাজারসহ বেসরকারি প্রায় ৩০ হাজার প্রতিনিধি অংশ নেয়। নারীদের অধিকার নিয়ে সেখানে আলোচনা হয়। ১৯৪৫ সালের জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। ১৯৪৬ সালে জাতিসংঘ গঠন করেছিল নারীর মর্যাদা বিষয়ক কমিশন, ১৯৫২তে নারীর রাজনৈতিক অধিকার সনদ। এতো কিছু করেও নারী মুক্তি আন্দোলনের প্রবর্তকরা নারীর অধিকার দিতে ব্যর্থ হয়েছে। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, ৮০ বর্ষ ৩য় সংখ্যা)
নারীর সামাজিক অধিকার আলোচনার আগে দেখা যাক আল্লাহ স্বামীদের প্রতি স্ত্রীর কী অধিকার দিয়েছেন,
- নারীদের হক রয়েছে স্বামীদের কাছ থেকে নৈতিক ও ইসলামি শিক্ষা লাভ করার। কুরআন বলেছে,
يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا قُوْۤا اَنْفُسَكُمْ وَاَهْلِيْكُمْ نَارًا ۰۰۶
‘হে ইমানদারগণ! তোমরা নিজেকে এবং তোমার পরিবার পরিজনকে দোজখের আগুন থেকে বাঁচাও।’[5]
দোযখের আগুন থেকে বাঁচার পথতো পরিবারের সদস্যদেরকে ইলমে দীন শিক্ষা দেওয়া এবং সে অনুসারে আল্লাহর দীন পালনে অভ্যস্ত করে গড়ে তোলা। স্ত্রী পুত্র দেরকে ইলমে দীন শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে প্রচুর হাদীস বর্তমান।
عَنْ مَالِكِ بْنِ الْـحُوَيْرِثِ، أَتَيْتُ النَّبِيَّ ﷺ فِيْ نَفَرٍ مِنْ قَوْمِيْ، فَأَقَمْنَا عِنْدَهُ عِشْرِينَ لَيْلَةً، وَكَانَ رَحِيمًا رَفِيقًا، فَلَمَّا رَأَى شَوْقَنَا إِلَى أَهَالِينَا، قَالَ: «ارْجِعُوْا فَكُوْنُوْا فِيْهِمْ، وَعَلِّمُوْهُمْ».
‘হযরত মালিক ইবনুল হুয়াইরিস বলেন, আমরা কয়েকজন যুবক দীন সম্পর্কে জ্ঞান লাভের জন্য নবী (সা.)-এর কাছে বিশ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। যে সময় তিনি উপলব্ধি করলেন আমরা বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছি তখন বললেন, ‘নিজের স্ত্রী পুত্রের কাছে ফিরে যাও এবং সেখানে অবস্থান করো। তাদেরকে দীন সম্পর্কে শিক্ষা দাও এবং তা মেনে চলতে নির্দেশ দাও।’’[6]
- স্ত্রীর রয়েছে স্বামীর প্রতি অর্থনৈতিক অধিকার। অর্থনৈতিক অধিকারের প্রথম স্তরে রয়েছে মোহর লাভের অধিকার। স্বামীর প্রথম দায়িত্ব হল স্ত্রীকে তার বংশ মর্যাদার দিকে খেয়াল রেখে স্বামীকে তার সাধ্য মত নির্দিষ্ট পরিমানে মোহর প্রদান করা। এ ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ:
وَاٰتُوا النِّسَآءَ صَدُقٰتِهِنَّ نِحْلَةًؕ ۰۰۴
‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীদেরকে মনের সন্তোষসহকারে তাদের মোহর প্রদান কর।’[7]
পরিবারে স্ত্রী ও অন্যান্য সদস্যদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা স্বামীর দায়িত্ব। এ ব্যাপারে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
لَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ اِنْ طَلَّقْتُمُ النِّسَآءَ مَا لَمْ تَمَسُّوْهُنَّ اَوْ تَفْرِضُوْا لَهُنَّ فَرِيْضَةً١ۖۚ وَّمَتِّعُوْهُنَّ١ۚ عَلَى الْمُوْسِعِ قَدَرُهٗ وَعَلَى الْمُقْتِرِ قَدَرُهٗ١ۚ مَتَاعًۢا بِالْمَعْرُوْفِ١ۚ حَقًّا عَلَى الْمُحْسِنِيْنَ۰۰۲۳۶
‘আর তাদেরকে (স্ত্রীদেরকে) খোরপোষ প্রদান কর, সচ্ছল ব্যক্তি তার সাধ্যানুযায়ী এবং অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি তার সাধ্যানুযায়ী ন্যায় সংগতভাবে কিছু খরচপত্রের ব্যবস্থা করে এ হল মুহসিনদের দায়িত্ব।’[8]
এ ব্যাপারে অল্লাহর রাসুল (সা.) ফরমান, ‘তোমাদের ওপর স্ত্রীদের অধিকার হলো তাদের জন্য পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাদ্যদ্রব্যের উত্তম ব্যবস্থা করা।’ (সুনানে তিরমিযী: ১১০১) কিন্তু বর্তমান সমাজে তাতো করেই না বরং অনেক অর্বাচীন স্বামী ও তার পরিবারের মা বাবারা বিয়ের পূর্বে ও পরে স্ত্রীর বাবা মার কাছ থেকে যৌতুক আদায় করে থাকে। তারা ভুলে যায় স্ত্রীরও মর্যাদা আছে। সে সংসারে ক্রীতদাস হয়ে আসেনি। যতক্ষণ টাকা থাকে ততক্ষণ তার দাম থাকে। এই শরীয়ত বিরোধী আচরণের কারণে সংসারে অশান্তি লেগে থাকে।
- স্বামীর ভালবাসা পাওয়ার অধিকার স্ত্রীদের মূল অধিকার। বিয়ে শুধুমাত্র শরীয়া ব্যবস্থা ও আইনের বিধান নয়। আইনের ঊর্ধ্বে প্রেম ভালবাসার এক সম্পর্ক সৃষ্টি হয় স্বামী স্ত্রীর মধ্যে। এই ভালবাসা আল্লাহ মেহেরবানী করে মানব মানবীর হৃদয়তলে পয়দা করে দিয়েছেন। আল্লাহর ঘোষণা:
وَمِنْ اٰيٰتِهٖۤ اَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِّنْ اَنْفُسِكُمْ اَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوْۤا اِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَّوَدَّةً وَّرَحْمَةًؕ ۠۰۰۲۱
‘এবং তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে তিনি তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা তাদের সাথে শান্তিতে বসবাস করতে পার এবং তোমাদের মাঝে ভালবাসা ও মেহেরবানি সৃষ্টি করে দিয়েছেন।’[9]
স্ত্রী-শিশু-কৈশোর ও যৌবনের ছোঁয়ায় বেড়ে ওঠা বাড়ি ঘর, বাবা মাকে, স্নেহের ভাই-বোন ছেড়ে চলে আসে স্বামীর ঘরে। এক নতুন পরিবেশে নিজেকে সামলিয়ে নিতে হয়। এ সময় সব চাইতে বেশি প্রয়োজন হয় স্বামীর ভালবাসা। তাই স্ত্রীর প্রতি স্বামীর থাকতে হবে আন্তরিক অনুরাগ ও আকর্ষণ। প্রত্যেক স্ত্রী কামনা করে স্বামী তার সমস্ত শরীরমন জীবন যৌবন তার ওপর বিন্যস্ত করে নিতান্ত নির্ভর করে চলুক। এই ইচ্ছার প্রতি স্বামীর সম্মান দেখান উচিত। স্বামীকে হতে হবে উদার চিত্তের অধিকারী। স্ত্রীর কোন দুর্বলতাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে স্ত্রীর মনে কষ্ট দেওয়া স্বামীর উচিৎ নয়। স্ত্রীর চাল চলনে কোন প্রকার সন্দেহ নিয়ে তাকে বিব্রত করা হলে পরস্পরের ভালবাসায় চির ধরে। ফলে সংসার বিষময় হয়ে ওঠে। তাই স্বামীকে ভালবাসার ডালি নিয়ে হাজির হতে হবে স্ত্রীর কাছে। বাইরের লোকে মেয়েদের জেঠামি সইতে পারে না, তাদের কথায় স্বামীকে কান দেওয়া চলবে না। স্বামীকে বুঝতে হবে স্ত্রীকে, তাকে ভালো বাসতে হবে অন্তর দিয়ে। এটাই স্বামীর প্রতি স্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ অধিকার।
- স্বামীর কাছ থেকে সদ্ব্যবহার পাওয়ার অধিকার। হযরত সামুরতা ইবনে জুনদুব (রাযি.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বরেছেন, ‘স্ত্রী লোকদেরকে পার্শ্বদেশের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। যদি তুমি তাকে সম্পূর্ণ সোজা করতে চাও তবে ভেঙে ফেলবে। সুতরাং তার সাথে নরম ব্যবহার কর, তাহলে সুখময় ও স্বাচ্ছন্দ জীবন যাপন করা যাবে।’ (তারগীব ও তারহীব)
পারিবারিক ব্যবস্থায় স্বামীর হাতে থাকে কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব, যদি কোন স্বামী নিজ স্ত্রীর ভাবাবেগ ও অনুভূতির প্রতি ভ্রক্ষেপ না করে শুধুমাত্র নিজের কথা মানাবার জিদ করে তবে পাবিারিক জীবন প্রকৃত সুখ ও আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে। তাই হুযুর (সা.) পুরুষদেরকে স্ত্রীদের সঙ্গে কোমল ও ভালবাসাপূর্ণ ব্যবহার করতে উপদেশ দিয়েছেন।
স্ত্রীদের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে তার একটি উত্তম উদাহরণ রয়েছে হযরত ওমর (রাযি.)-এর জীবনে। খলীফা হযরত ওমরের খেলাফত কালের ঘটনা। এক ব্যক্তির স্ত্রী ছিল বেশ মুখরা ও ঝগড়াটে। সব সময় সে স্বামীকে জ্বালাতন করত। স্বামী বেচারা স্ত্রীর দুর্ব্যবহারে অতিষ্ট হয়ে এ ব্যাপারে নালিশ জানাতে একদিন সে হাজির হল হযরত ওমর (রাযি.)-এর দরবারে। সে হযরত ওমরের বাড়ির ফটকে দাঁড়িয়ে খলীফার বের হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল। এ সময় সে শুনতে পেল খলীফাকে তাঁর বিবি কঠোর ভাষায় বকাবকি করছেন। কিন্তু হযরত ওমর (রাযি.) কোন জওয়াব দিচ্ছেন না, বরং নীরবে সব শুনে যাচ্ছেন। এভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে লোকটি চলে যেতে উদ্যত হল। সে মনে মনে ভাবল, এমন প্রতাপশালী খলীফার যখন এমন হাল তখন আমি আর কোন ছাই।
এমন সময় খলীফা বাড়ির বের হয়ে দেখতে পেলেন লোকটি চলে যাচ্ছে। তিনি লোকটিকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি হে বাপু! তুমি এলেই বা কেন, আর কিছু না বলে চলে যাচ্ছ কেন?’ লোকটি জওয়াব দিল, ‘হুযুর! আমার স্ত্রী আমার সাথে দুর্ব্যবহার করে, কথায় কথায় ঝগড়া করে। তার বিরুদ্ধে নালিশ করার জন্য আপনার দরবারে এসেছিলাম। কিন্ত দেখতে পেলাম আপনার হাল আমার চেয়ে ভালো নয়। তাই কিছু না বলেই চলে যাচ্ছি।’
হযরত ওমর (রাযি.) বললেন, ‘শোন ভাই, আমার ওপর আমার বিবি সাহেবার বেশ কিছু অধিকার আছে, আমি তাই তার এ বকাবকি সহ্য করছি। দেখ সে আমার খাবার রান্না করে, রুটি বানায়, কাপড় চোপড় ধোয়, বাচ্চাদেরকে দুধ খাওয়ায়। অথচ এ সব কাজ তার জন্য বাধ্যতামূলক নয়, সে স্বেচ্ছায় এ সব করে। এ সব কাজ করে সে আমাকে হারাম উপার্জন থেকে বাঁচিয়ে রাখে। এখন বল আমি কি তাকে সহ্য না করে পারি?’
লোকটি বলল, ‘আমিরুল মুমিনীন, আমার বিবিও তো এরূপ।’ হযরত ওমর (রাযি.) বললেন, ‘তা হলে তাকে সহ্য করতে থাক, ভাই। দুনিয়ার জীবনটা তো নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী।’
খলীফাতুল মুসলিমীনের এ ভাষণ থেকে স্বামীদের শিক্ষা গ্রহণ করে স্ত্রীদের প্রতি উত্তম ব্যবহার করা প্রয়োজন। কারণ নূর নবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যারা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে সব চেয়ে ভালো ব্যবহার করে।’
এ ছাড়াও স্বামীর ওপর স্ত্রীদের আরও হক রয়েছে, যা এ চারটি হক আদায় হলে তা সহজেই আদায় হয়ে যায়। মনে হয় পৃথিবীতে ঘরে ঘরে সমস্ত কুলকন্যারা এখনও গভীর সুষুপ্তিতে নিমগ্ন, তাদেরকে জাগাতে এ ছোট্ট আলোচনা কাজে লাগুক এ প্রার্থনা।
[1] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৯, পৃ. ৬২, হাদীস: ৭১৩৮, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.) থেকে বর্ণিত
[2] আল-কুরআন, সুরা আত-তাওবা, ৯:৭১
[3] আল-কুরআন, সুরা আলে ইমরান, ২:১৮৭
[4] আন-নাসায়ী, আল-মুজতাবা মিনাস-সুনান = আস-সুনানুস সুগরা, মাকতাবুল মতবুআত আল-ইসলামিয়া, হলব, সিরিয়া, খ. ৭, পৃ. ৬১, হাদীস: ৩৯৩৯, হযরত আনাস ইবনে মালিক থেকে বর্ণিত
[5] আল-কুরআন, সুরা আত-তাহরীম, ৬৬:৬
[6] আল-বুখারী, আস-সহীহ, খ. ১, পৃ. ১২৮, হাদীস: ৬২৮
[7] আল-কুরআন, সুরা আন-নিসা, ৪:৪
[8] আল-কুরআন, সুরা আন-নিসা, ৪:৪
[9] আল-কুরআন, সুরা আর-রুম, ৩০:২১