শুক্রবার-১৬ই জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি-১৬ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নতুন শিক্ষাবর্ষ: তালিবে ইলম ভাইদের প্রতি কিছু নসীহত

নতুন শিক্ষাবর্ষ: তালিবে ইলম ভাইদের প্রতি কিছু নসীহত

নতুন শিক্ষাবর্ষ: তালিবে ইলম ভাইদের প্রতি কিছু নসীহত

মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ আবদুল মালেক

 

ইতিমধ্যে আমাদের কওমি মাদরাসায় একটি নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে। আল-হামদু লিল্লাহ। এ শুভ মুহূর্তে দিল ও যবান যেমন আল্লাহর শোকরে সারশার হবে তেমনি বিগত জীবনের মুহাসাবা ও আগামীর জন্য পোখতা এরাদা করতে হবে। পিছনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান শিক্ষাবর্ষটিকে ইলম-আমল, আদব-আখলাক এবং যিকর-ফিকর সর্ববিষয়ে অধিক ফলপ্রসূ বানানোর একান্ত প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে আমার প্রথম দরখাস্ত এই যে, আস-সানাতাল আতিয়ার ধোঁকা থেকে নিজেকে হিফাযত করুন, অন্তত এই ধোঁকায় পতিত হওয়ার অনুভূতিটুকু সংরক্ষণ করুন। শায়খ যাহিদ আল-কাউসারী (রহ.) বলেছেন,

عندنا في تركية مثل يقول: لو شققت عن قلب طالب علم لوجدت فيه مائة مسئلة مكتوب عليها السنة الآتية.

‘তুরস্কে প্রবাদ আছে যে, তুমি যদি কোনো তালিবে ইলমের অন্তরকে বিদীর্ণ কর তাহলে দেখতে পাবে অন্তত ১০০টি মাসাআলার বিষয়ে লেখা রয়েছে, আগামী বছর।

আল্লাহ আমাদের হালত এমন না করুন।

দ্বিতীয় দরখাস্ত এই যে, আমি কিতাব বুঝি কি না তা নির্ধারণ করতে যেন ভুল না করি। অনেককে দেখা যায়, নিজের সম্পর্কে নিজেই ফায়সালা করে যে, আমি কিতাব বুঝি। অথচ তার বোঝাটা যথার্থ কি না তা সে কোনো উস্তায থেকে যাচাই করেনি। তাই অনেককে দেখা যায়, বোঝার ব্যাপারে ভুলবোঝাবুঝিতে থাকে। তাই আমার অনুরোধ, যেকোনো নতুন কিতাব মুতালাআয় এলে চাই তা দরসী হোক বা দরসী কিতাবের কোনো শারহ, তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বহছ সাথীদের সাথে মুযাকারা করুন এবং উস্তাযকে শুনিয়ে আপনার বোঝা যথার্থ কি না যাচাই করুন। এ মূলনীতি সেসব কিতাব বা শারহের ব্যাপারে বেশি প্রযোজ্য যেগুলোতে ফন্নী উসলূব গালেব। এ ধরনের কিতাবে শুধু তারকীব বা তরজমা বোঝা আলোচ্য বিষয় যথাযথ অনুধাবনের জন্য যথেষ্ট নয়। মুখতাছারুল মাআনী, হিদায়া, জালালাইন, ফাতহুল কাদীর, ফাতহুল বারী, ফাতহুল মুলহিম, ফয়যুল বারী, মাআরিফুস সুনানসহ এ ধরনের আরও অনেক কিতাবের ক্ষেত্রে এই মূলনীতি খুব গুরুত্বের সাথে মনে রাখা উচিত।

তৃতীয় দরখাস্ত এই যে, আমরা যেন কিতাবি ইসতি’দাদের অর্থ বুঝতে ভুল না করি। কিতাবি ইসতি’দাদের সঠিক অর্থ হল ইবারত বিশুদ্ধ পড়তে পারা, নাহবী তারকীব বোঝা, আলফাযের ছরফী রূপ ও লুগাবি মাফহুম বুঝতে পারা। অতপর ইবারত থেকেই তার মর্ম-মতলব এবং আলোচিত বিষয়ের সমাধান বুঝতে পারা। কোনো আরবী ইলমী শারহের সাহায্যে এই বুঝ অর্জন হওয়া দোষণীয় নয়। এমনকি প্রয়োজনে কারো সঙ্গে মুযাকারা করে বা নির্ভরযোগ্য উরদু বা বাংলা শারহের সাহায্য নেওয়ার পরও যদি মতলব ও মাফহুম ইবারতের ওপর মুনতাবিক করে নেওয়া যায় তা-ও এক ধরনের কিতাব বোঝা বলে গণ্য এবং একপর্যায়ে তা ইসতি’দাদে পরিণত হতে পারে। কিন্তু শুধু দরসী তাকরীর শুনে বা কোনো শারহের সাহায্য নিয়ে মতলব ও মাফহুম বা তার খুলাসা অনুমান করতে পারলেও ইবারতের সাথে মিলিয়ে নিতে না পারে তাহলে তা কিতাবি ইসতি’দাদের কোনো স্তরেই পড়ে না। তাই আমরা অনুমাননির্ভর বোঝাকে কিতাবি ইসতি’দাদ বা কিতাব বোঝার সমর্থক মনে করে ধোঁকায় না থাকি।

চতূর্থ দরখাস্ত এই যে, ইবারত হল্‌ করতে পারাকে ফন্নী ইসতি’দাদ মনে করে ধোঁকায় না পড়ি। এ বিষয়ে নিজের সমঝের জায়েযা দুইভাবে নেওয়া যায়:

এক. যে ফনের যে কিতাবটি আমি পড়ছি সে ফনের ঐ স্তরের আরেকটি কিতাব, যাতে বাস্তবমুখী প্রয়োগ ও অনুশীলনের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তা মুতালাআ করে দেখা। যদি তা সহজে বুঝে না আসে তাহলে সাবধান হতে হবে যে, কিতাবি ইসতি’দাদের সাথে ফন্নী ইসতি’দাদ পয়দা হচ্ছে না।

দুই. দরসী কিতাবের কোনো এমন শারহ মুতালাআ করা, যাতে ফন্নী উসলূব গালেব। যদি তা মুতালাআ করতে আগ্রহ না হয় বা শুধু লফযী তরজমা বুঝেই ক্ষান্ত থাকি তাহলেও বুঝতে হবে ফন্নী ইসতি’দাদ পয়দা হচ্ছে না। তবে এসকল মুহাসাবা ও জায়েযাও নিজের তা’লীমী মুরববীর হেদায়েত মোতাবেক এবং তাঁর নেগরানীতে হওয়া জরুরি।

পঞ্চম দরখাস্ত এই যে, শুধু ইমতিহানের নতীজার ভিত্তিতে নিজেকে ভালো ছাত্র মনে না করি। অন্যেরা যা-ই বলুক, যতই বলুক আমি যেন ধোঁকায় না পড়ি। অন্যের ধারণা বা বলাবলির কারণে নিজের বাস্তব অবস্থা ভুলে যাওয়া চরম নির্বুদ্ধিতা। তাই চেষ্টা করব শুধু ভালো ছাত্র নয়; বরং একজন আদর্শ ছাত্র হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে। একজন আদর্শ তালিবুল ইলমের পরিচয় কী-এ সম্পর্কে এই বিভাগে অনেক কিছু লেখা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা সে অনুযায়ী আমাকে ও আমাদের সকলকে আমল করার তাওফীক নসীব করুন।

ষষ্ঠ দরখাস্ত এই যে, শুধু ফাহমুন নুসূসে তুষ্ট না থেকে হিফযুন নুসূসের ইহতিমাম করি। বিষয়ভিত্তিক কুরআন মজীদের আয়াত, জামে অর্থবহ হাদীস, আদইয়ায়ে মা’সূরা অতপর দীনের উসূল ও কাওয়ায়েদ সম্পর্কিত সালাফে সালেহীনের ঐসব বাণী যা হাওয়ালার মর্যাদা রাখে সবই কিছু কিছু হিফয করা উচিত, মুযাককিরা (ইয়াদদাশত) এ লিপিবদ্ধ করার পাশাপাশি স্মৃতিতেও সংরক্ষণ করার চেষ্টাও শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই চালিয়ে যেতে হবে। সালাফের মতো প্রত্যেক ফনের কমপক্ষে একটি মুখতাছার রিসালা হিফয করা সম্ভব না হলেও উপরোক্ত পদ্ধতিতে কিছু কিছু নছ্‌ হিফয করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

সপ্তম দরখাস্ত এই যে, হযরত মাওলানা আবদুর রশীদ নু’মানী (রহ.) এর নসীহত মোতাবেক দৈনিক তাজদীদে নিয়তের চেষ্টা করি এবং শায়খ আবদুল ফাত্তাহ (রহ.)-এর কিমাতুয যামান ইনদাল উলামা কতাবে পেশকৃত হেদায়েত মোতাবেক সময়ের শুধু হিফাযত নয়, কাস্ব করারও চেষ্টা করি। অর্থাৎ অল্প সময় থেকেও বেশি বেশি ফায়দা হাসিল করার চেষ্টা করি।

আখেরী দরখাস্ত এই যে, মিন আদাবিল ইসলাম বা আদাবে মুআশারা মুতালাআ করে নিজের কথাবার্তা ও আচার-আচরণকে বা-আদব বানানোর চেষ্টা করি। ওয়াল্লাহুল মুয়াফফিক ওয়াহুয়াল মুসতাআন।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ