ঘুরে এলাম পূর্ব মালয়েশিয়ার ‘সাবাহ’ স্টেট
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন
২ মে’১৯ মালিন্দু এয়ারে কুয়ালালামপুর থেকে সকালে যাত্রা করে নিরাপদে সাবাহ প্রদেশের কুটা কিনাবালো বিমানবন্দরে পৌঁছি। দক্ষিণ চীন সাগরের উপর দিয়ে এখানে পৌঁছতে আমাদের সময় লাগে ২ ঘন্টা ৪৫ মিনিটি। পাহাড়, সমুদ্র, উপত্যকা, সমতল, শহর, গ্রাম মিলে এক অপূর্ব দেশ সাবাহ। একদেশ হলেও বিদেশিদের সফর করতে পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশনের প্রয়োজন হয়। এই অঞ্চলের মানুষগুলো বেশ ভদ্র ও বন্ধুবৎসল।
সাবাহ পূর্ব মালয়েশিয়ার একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রদেশ। বর্ণিও দীপপুঞ্জের উত্তরে অবস্থিত মালয়েশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম স্টেট। সমুদ্র পথে ভিযেতনাম ও ফিলিপাইনের সীমান্ত রয়েছে। রাজধানী কুটা কিনাবালো। মূল শহর কুদাত, সানদাকান, ওয়েস্ট কোস্ট ও তাওয়াউ। ৭৩ হাজার ৯০৪ কি.মি. আয়তনের এই দেশে ৩৮ লাখ ৭০ হাজার মানুষ বাস করে। ৩০ হাজার বছর আগে এখানে মানবজাতির বসবাস। সাবাহ কখনো ব্রুনাই, কখনো জাপান, কখনো ব্রিটিশের অধীনে শাসিত হয়। ১৯৬৩ সালের ৩১ আগস্ট ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সাবাহকে স্বায়ত্বশাসন প্রদান করে। ওই বছর সাবাহ মালয়েশিয়া ফেডারেশনের সদস্যভুক্ত হয়। ওয়েস্ট মিনিস্টার পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার চালু রয়েছে এখানে। একজন সাংবিধানিক সুলতান বা রাজা থাকলেও নির্বাহী ক্ষমতার মালিক হচ্ছেন চিফ মিনিস্টিার। তিনিই সরকার প্রধান।
সাবাহ প্রদেশে ৫টি বিভাগের অধীনে ২৭টি প্রশাসনিক জেলা রয়েছে। মালয় সককারি ভাষা এবং ইসলাম রাষ্ট্রীয় ধর্ম। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীগণ নির্বিঘ্নে তাঁদের ধর্ম ও কৃষ্টির অনুশীলন করার স্বাধীনতা ভোগ করেন। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ সাবাহ এর অর্থনীতি রপ্তানিনির্ভর। পেট্রোল, গ্যাস, টিম্বার, পামতেল ও কৃষিজাত পণ্য রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রধান উৎস।
নামকরণ
এখানে প্রচুর কলা উৎপন্ন হয়। তাগলিগ ও ভিসাইয়ান ভাষায় বিশেষ এক প্রজাতির কলাকে সাবাহ বলা হয়। এখান থেকে নামের উৎপত্তি। অনেকে মনে করেন সাবাক থেকে সাবাহ নামের জন্ম। সাবাক অর্থ এমন স্থান যেখানে পাম থেকে চিনি আহরিত হয়। কারো কারো ভাষ্য মতে আরবী শব্দ সাবাহ থেকে এর উৎপত্তি, যার অর্থ প্রভাত। আসলে কোথা থেকে সাবাহ নামের উৎপত্তি সত্যিকারভাবে চিহ্নিত করা কঠিন। সাবাহকে বলা হয় বায়ুপ্রবাহের নিম্নভূমি (The land below the wind)| মালয় ভাষায় বলা হয়, Negeri Di Bawah Bayu| কারণ পূর্ব এশিয়ার টাইফুন/ঘূর্ণিঝড় বেল্টের নিচে সাবাহ অবস্থিত।
ইসলামের আগমন
দশম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যে ব্রুনাই ও সুলু সালতানাতের প্রভাবে এখানে ইসলামের আগমন ঘটে। আরব ও ভারতীয় সুফিসাধক ও বণিকগণ এ অঞ্চলে ইসলামের বাণী প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সর্বপ্রথম বাজাও জনগোষ্ঠী ইসলাম কবুল করে। ধীরে ধীরে বিসায়া, ব্রুনাই, সুলুক, ককোস, ইরানুন, বুগিস ও ওরাং সুংগাই জনগোষ্ঠীর মাঝে ইসলামের আদর্শ ছড়িয়ে পড়ে। অধিকাংশ মুসলমান সুন্নী ও শাফিয়ী মাযহাবের অনুসারী। সাইয়েদ বংশীয় দরবেশ সাধকদের মাধ্যমে এখানে ইসলাম বিকশিত হয়। ৬৫% মুসলমান, ২৬.৬% খ্রিস্টান, ৬% বৌদ্ধ এবং ৪২ জাতের নৃতাত্ত্বিকগোষ্ঠী আছে সাবাহতে। তাঁদের রয়েছে নিজস্ব আচার, সংস্কৃতি, ভাষা ও বিশ্বাস।
উচ্চতর জিডিপির দিক দিয়ে মালয়েশিয়ার ১০টি স্টেটের মধ্যে সাবাহর স্থান ৬ষ্ট (৮০, ১৬৭ মিলিয়ন রিংগিত)। রাষ্ট্রীয় মসজিদ, প্রাচীন ন্যাশনাল পার্ক, নানা প্রজাতির বৃক্ষ, বিচিত্র সৌন্দর্য-সমন্বিত বন্যপ্রাণী, গরম পানির ঝর্ণাধারা, সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ, বনাচ্ছাদিত দ্বীপ, সমুদ্র সৈকত, পার্বত্য গুহা, যাদুঘর, নৌবিহার, বেলুনে আকাশভ্রমণ, ডুবুরিদের সাথে মুখে শ্বাসযন্ত্র লাগিয়ে সমুদ্র তলা পরিদর্শন (Scuba diving), নৌবিহার, প্রমোদ ভ্রমণ ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বর্ণাঢ্য জীবনরীতি সাবাহ স্টেটের মূল আকর্ষণ। ন্যাশনাল পার্ক কিনাবালো থেকে ৮৮ কি. মি. দূরে। ৭৫৪ বর্গ কি. মি.জুড়ে এ পার্কের অবস্থান। হাজার প্রজাতির বৃক্ষ, বিচিত্র পাখ পাখালি ও বর্ণিল অর্কিড ফুলের সমারোহ পর্যটকদের কাছে টানে। এটাকে UNESCO কর্তৃপক্ষ World Heritage Site ঘোষণা করে।
আমার প্রিয় মাতৃভূমি, দুর্ভাগা জাতি
২ মে সকাল মালিন্দো এয়ারে কুটা কিনাবালো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম সকাল ১০ টায়। এটা মালয়েশিয়ার অন্যতম প্রদেশ সাবাহ। রাজধানী কুটা কিনাবালো। এক দেশ হলেও স্বদেশিদের পরিচয়পত্র দেখাতে হয়। ৯০ দিন থাকার পারমিট দেওয়া হয়। আর বিদেশি হলে পাসপোর্ট বাধ্যতামূলক। যথারীতি বিদেশি পাসপোর্টধারীদের লাইনে দাঁড়ালাম ইমিগ্রেশন কাউন্টারে। বিভিন্ন দেশের যাত্রীদের এন্ট্রি স্ট্যাম্প দিয়ে বিদায় করা হচ্ছে। নিউজিল্যান্ডের একজন যাত্রীর পাসপোর্ট নেই। আছে ট্যুর পারমিট। কিছুকথা জিজ্ঞাসা করে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হলো।
বিভিন্ন লাইন থেকে সংগৃহীত বাংলাদেশি পাসপোর্টগুলো নিয়ে একজন কর্মকর্তা ভেতরে চলে গেলেন। এরপর ডাক পড়লো ঊর্ধতন এক কর্মকর্তার টেবিলে। তিনি জানালেন, আপনাদেরকে কুয়ালালামপুর ফেরত যেতে হবে। যেহেতু এখানে আসার আগে আপনারা সাবাহ প্রদেশের চিফ মিনিস্টারের দফতর থেকে অনুমতিপত্র আনেননি। এয়ারলাইনসের সাথে কথা বলে আমরা ফিরতি ফ্লাইট ঠিক করে দেব।
আমরা বিনয় সহকারে বললাম, এ নিয়ম আমাদের জানা ছিল না। আমি অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক। ইতিহাস –
ও ঐতিহ্যের সন্ধান আমার নেশা। কয়েকটা দিন এখানে অবস্থান করে ৫ মে কুয়ালালামপুর এবং ৭ মে ঢাকা ফিরে যাবো। সাথে আছে আমার ছোট ছেলে নাঈম তালহা। সে মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়া লেখা করে। তিনি বলেন, বাইরে অপেক্ষা করুন। অপেক্ষায় থাকলাম প্রায় ৪০ মিনিট। খানিকপর তিনি বাইরে এসে বলেন, এবারের মতো আপনাদের অনুমতি দেওয়া হলো। আগামীবার আসার সময় সিএম থেকে অবশ্য অনুমতি নিয়ে আসবেন। এটা আমরা কম্পিউটারে নোট দিয়ে রাখছি। খুশি মনে বিমানবন্দর ত্যাগ করলাম। সোফাতে বসা এক বাঙালি তরুণ উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, আমাকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। ফিরতি ফ্লাইটে কুয়ালালামপুর ফিরে যাবো।
বহু দেশের বিশেষত ব্রিটেনের পাসপোর্টধারীদের মালয়েশিয়া ঢুকতে ভিসা লাগে না। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমাদের জাতিগত মর্যাদা (National image) বৃদ্ধি পায়নি। আমরা নাগরিকরাই এর জন্য দায়ী। সরকারও দায় এড়াতে পারে না। আশাবাদী হতে চাই। আমরা একদিন গর্বিত জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো ইন শা আল্লাহ।
কিনাবালো: মালয় দ্বীপপুঞ্জের সর্বোচ্চ পর্বতমালা
আজ প্রত্যুষে প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে যাত্রা করি কিনাবালো পর্বতমালা দেখার জন্য। কুটা কিনাবালো থেকে এর দুরত্ব ৯৫ কি. মি.। আঁকাবাকা সর্পিল পথ বেয়ে গাড়ি উঠতে থাকে ওপরে আরও ওপরে। পীচঢালা পথ, মাঝেমধ্যে রেস্টুরেন্ট, হোমস্টে ও রিসোর্ট নজরে পড়ে। যত ওপরে উঠি তত শিহরিত হই। এক পর্যায়ে মেঘের দেখা। হাতে মুখে শরীরে মেঘের শীতল পরশ অনুভূতিকে চাঙ্গা করে দেয়। রাস্তা অস্পষ্ট হয়ে উঠে। আবহাওয়া শীতের মত ঠাণ্ডা। গহীন অরণ্য, দীর্ঘদেহী বৃক্ষরাজি, পাখ পাখালি ও পোকা পতঙ্গের সুরের লহরিতে মুহূর্তে নিজেকে হারিয়ে ফেলি।
হে আল্লাহ! তুমি কিছুই নিরর্থক সৃষ্টি করনি। সব তোমারই অফুরন্ত কুদরতের স্বাক্ষর। তোমার এই বৈচিত্র্যময় সৃষ্টি দেখে আমরা কেবল অভিভূত হই। সুবহানাল্লাহ!
বর্ণিও অঞ্চল ও মালয় দ্বীপপুঞ্জের সর্বোচ্চ পর্বতমালার নাম কিনাবালো। এটি মালয়েশিয়ার সাবাহ প্রদেশে অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩ হাজার ৪৩৫ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন সর্বোচ্চ পর্বতমালা এটি। পৃথিবীতে যত উঁচু পর্বত আছে তাদের মধ্যে কিনাবালোর অবস্থান বিশে। ইউনেস্কো এটাকে World Heritage Site ঘোষণা করে। ১৯৫১ সালে মানুষ সর্বপ্রথম এ পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ করতে সক্ষম হন।
কিনাবালো পর্বতমালার বৈশিষ্ট্য ও জীববৈচিত্র্য হলো এখানে ৬ হাজার প্রজাতির বৃক্ষ, ৩২৬ প্রজাতির পাখি, ১০০ প্রকার স্তন্যপায়ী প্রাণী চিহ্নিত হয়েছে। এ পর্বতমালার উপত্যকায় রয়েছে পৃথিবীর সবচে বড়ফুল Rafflesia-এর গাছ। একটি Rafflesia ফুল ১০০ সেন্টিমিটার ব্যাসের এবং ওজন হয় প্রায় ১০ কেজি। খুব সম্ভববত অনবরত গাড়ি চলাচল ও লোক সমাগমের ফলে স্বাপদ, সাপ ও হিংস্র প্রাণী রাস্তা ঘাটে হানা দেয় না। মালয়েশিয়ার বনে জঙ্গলে প্রচুর সরিসৃপ জাতীয় প্রাণী বাস করে। প্রতিদিন বৃষ্টি হওয়ার কারণে গাছপালা চির সবুজ এবং বনে প্রাণী বেঁচে থাকার জন্য অনুকুল।
১২ হাজার মানুষ একসাথে নামায আদায় করতে পারেসাবাহ সিটি মসজিদে
মালয়েশিয়ার অঙ্গরাজ্য সাবাহ এর রাজধানী কুটা কিনাবালোতে অবস্থিত দ্বিতীয় বৃহত্তর মসজিদ হলো সাবাহ সিটি মসজিদ। স্থানীয়দের কাছে এটি মসজিদ বান্দারায়া নামে পরিচিত। আজ এই মসজিদ দর্শন করি এবং জামায়াতের সাথে মাগরিবের নামায আদায় করি। তরূণ মালয় ইমামের কিরআত বেশ আকর্ষণীয়। নামায শেষে তাঁর সাথে পরিচিত হলাম। তিনি বাংলদেশ সফর করেছেন জানালেন।
১৯৯২ সালে এ মসজিদের ভিত্তি স্থাপিত হয় এবং আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘটে ২০০০ সালে। ৩ কোটি ৪০ লাখ রিংগিত ব্যয়ে নির্মিত এই মসজিদ মদীনার মসজিদে নববীর স্থাপত্যকাঠামো অনুসরণ করা হয়। নীল ও সোনালি বর্ণের গম্বুজে রয়েছে আরব স্থাপত্যের প্রভাব।
দক্ষিণ চীন সাগরের অন্তর্গত লিকাস উপসাগরের তীরে ১৪.৮৩ একর জমিজুড়ে অবস্থিত এই মসজিদ কমপ্লেক্স। চারদিকে খোলামেলা। অযুও টয়লেটের সুব্যবস্থা। বিশাল পার্কিং প্লেস। দূরের মুসল্লিদের সুবিধার্থে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি খাবারের দোকান। জামায়াতের সাথে ১২ হাজার মুসল্লির নামায আদায়ে সুযোগ রয়েছে।
মসজিদের ৩ দিকে রয়েছে কৃত্রিম হ্রদ ফলে দূর থেকে ভাসমান মসজিদ মনে হয়। কমপ্লেক্সের আওতায় রয়েছে এটিএম বুথ, ৩টি মাদরাসা, একটি স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক এবং মৎস্য খামার। দর্শনের জন্য দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভীড় লেগে থেকে সব সময়।
মালয়েশিয়ার সাবাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরি পরিদর্শন
সাবাহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সাগরের তীরে অবস্থিত ক্যাম্পাসের দৃশ্য বড্ড মনোরম। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ, অনুষদ ভবন, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, কেন্দ্রীয় মসজিদ, অডিটোরিয়াম, খেলার মাঠ ও চ্যান্সেলরের কার্যালয় ঘুরে ঘুরে দেখি।
৩ তলার সেন্ট্রাল লাইব্রেরি একাডেমিক ও রেফারেন্স গ্রন্থের বিপুল কালেকশনে ভরা। নোবেল বিজয়ীদের তথ্য উপাত্ত ও জীবনপঞ্জি নিয়ে সাজানো হয়েছে একটি কক্ষ। ই-লাইব্রেরি, মাল্টিমিডিয়া ল্যাব, স্ক্রিনিং কক্ষ, নামাযের কক্ষ, প্রশিক্ষণ কক্ষ, লকার, প্রিন্টিং ও ফটোকপি সার্ভিস, সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাঠকক্ষ ও পোস্ট গ্রাজুয়েটদের গবেষকদের জন্য রয়েছে ছোট ছোট কক্ষ। একান্ত নিরিবিলি পরিবেশে এখানে গবেষণা করার সুযোগ অবারিত। সেন্ট্রাল এসি থাকায় লেখা পড়ায় ক্লান্তি অনুভব হয় না। কোন গ্রন্থ বাসায় নিতে চাইলে ব্যবস্থা আছে। কম্পিউটারে তথ্য দিয়ে অনুমোদন নিতে হবে। অননুমোদিত গ্রন্থ নিয়ে বের হতে চাইলে ইলেকট্রনিক গেটে রিং বেজে উঠবে।
শিক্ষকগণ ৯০ দিনের জন্য ৩০টি, ম্যানেজমেন্ট স্টাফ ২৫টি, পোস্ট গ্রাজুয়েট গবেষকগণ ২০টি গ্রন্থ ৩০ দিনের জন্য নিতে পারেন। আন্ডার গ্রাজুয়েট ও ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীগণ যথাক্রমে ১০টি ও ৫টি বই ১৪ দিনের জন্য লাইব্রেরি হতে ধার নিতে পারেন।
নাছি লেমাক: মালয়েশিয়ার জাতীয় খাবার
মালয়েশিয়ার নাগরিকদের মধ্যে মালয় জাতিগোষ্ঠীর মূল খাবার হলো ভাত। তারা ৩ বেলায় ভাতে অভ্যস্ত। তবে নাছি লেমাক নামের খাবার তাদের বেশ পছন্দ। এটি জাতীয় খাবার হিসেবে প্রসিদ্ধি পেয়েছে। নারিকেলের দুধ ও পানদান পাতা দিয়ে চিকন সুগন্ধি চাল রান্না কর হয়। এর সাথে থাকে ডিম, সবজি, সালাদ, মাছ, মাংস, ভুট্টা, ও ঝাল সস।
সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, দক্ষিণ থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, সুমাত্রা এবং ফিলিপাইনের বাংসামরো ও মিন্দানাও অঞ্চলে বসবাসরত মালয় জনগোষ্ঠীরও প্রিয় খাবার নাছি লেমাক। প্রাচীন যুগে কলা পাতায় নাসি লেমাক পরিবেশন ছিল ঐতিহ্য। এখনো তারা এ ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। আমি সাবাহ প্রদেশের রাজধানী কুটা কিনাবালোর বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় সকালে মালয়দের কলাপাতায় মোড়ানো নাছি লেমাক দিয়ে ব্রেকফাস্ট করতে দেখেছি। নাছি লেমাক আমি খেয়েছি। বেশ উপাদেয়।
সাবাহ জাতীয় মসজিদ পরিদর্শন
আজ দুপুরে কুটা কিনাবালোর সেমবুলানে অবস্থিত সাবাহ স্টেট মসজিদ পরিদর্শন করি এবং যুহরের নামাযও আদায় করি। এটি স্থানীয়দের কাছে মসজিদ নিগারা নামে সমধিক পরিচিত। বিশাল এলাকাজুড়ে মসজিদের অবস্থান। মুসল্লিদের গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য রয়েছে সুব্যবস্থা। ১৯৭৫ সালে নির্মাণকাজ শেষ হলেও উদ্বোধন হয় ১৯৭৭ সালে। নির্মাণে সময় লেগেছে ৫ বছর। ৫ হাজার মানুষ এক সাথে নামায আদায় করতে পারে। মহিলাদের নামায আদায়ের জন্য রয়েছে পর্দাঘেরা পৃথক স্থান। মসজিদের অভ্যন্তরভাগে রয়েছে দামি কার্পেট, ঝুলন্ত বাতি, অলংকরণ ও পবিত্র কুরআনের উৎকীর্ণ আয়াতের ক্যালিগ্রাফি।
মালয়েশিয়ার রাজা সুলতান ইয়াহইয়া পেত্রা আনুষ্ঠানিকভাবে এ মসজিদ উদ্বোধন করেন। এ মসজিদে সোনালি বর্ণের গম্বুজ রয়েছে ১৭টি এবং মিনারা আছে ১টি, যার উচ্চতা ২১৫ ফুট। স্থাপত্যশৈলীতে ইসলামি, আধুনিক ও মধ্যপ্রাচ্যরীতি অনুসৃত হয়। এ মসজিদে ইংরেজি ও মালয় ভাষা জানা একজন গাইড রয়েছে। তাঁর সাথে পরিচিত হলাম। তিনি আমাদেরকে মসজিদের বিভিন্ন অংশ ঘুরে ফিরে দেখান।
মালয়েশিয়ার সাবাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিনন্দন কেন্দ্রীয় মসজিদ। ভেতরের অলংকরণ আরো মনোরম ও সুদৃশ্য। প্রতিদিন শত শত চীনা পর্যটক মসজিদ পরিদর্শনে আসেন। আমরা আজ আছরের নামায এ মসজিদে আদায় করি।
সাবাহ চা বাগান: একটি ঐতিহাসিক স্থান
আজ ৪ মে মালয়েশিয়ার সাবাহ প্রদেশের কুটা কিনাবালো থেকে প্রায় ১৩০ কি. মি. দূরে গগণস্পর্শী পর্বতঘেরা গভীর অরণ্যে রানাও এলাকায় অবস্থিত সাবাহ চা বাগান পরিদর্শন করি। গার্ডেন রিসোর্টে বাগান থেকে সদ্যতোলা পাতা দিয়ে চা পানের মজাই আলাদা। আমরা দারুচিনি মিশ্রিত চা পান করে পরিতৃপ্ত হই। এখানে নানা ফ্লেভারে বিশেষ করে ভ্যানিলা চা, জেসমিন চা, ল্যাভেন্ডার চা, আগরউড চা, ক্যামেলিয়া চা, লেমন চা, দারুচিনি চা, আদা চা, গ্রিন চা পাওয়া যায়। বিভিন্ন ব্রান্ডের কয়েক কেজি চাপাতা কিনি। গার্ডেন প্যাকেটজাত হওয়ায় এসব চাপাতার চাহিদা বেশি। বিস্তৃত উপত্যকাজুড়ে রয়েছে চা বাগান। এ বাগানের চাপাতা শতভাগ ক্যামিকাল ও কীটনাশকমুক্ত।
পাহাড়ের ওপর রয়েছে চা কারখানা। ওখানে দেখলাম চা প্রক্রিয়াজাত হচ্ছে। কিনাবালো পর্বতশৃঙ্গের মুখে এ চা-বাগান যা সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ২ হাজার ২৭২ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। প্রায় সময় বৃষ্টি, মেঘমালা ও শীতল পরিবেশ হওয়া কারণে চা গাছগুলো সতেজ, বসন্তকালের মত চা পাতার কুঁড়ি সংগ্রহ করা হয়। চা বাগান কমপ্লেক্সের ভেতরে রয়েছে রেস্টুরেন্ট ও আবাসিক রিসোর্ট। ১৯৮৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তুন ডা. মাহাথির মুহাম্মদ এ চা বাগানের উদ্বোধন করেন।
সাবাহ চা বাগানের সাথে একটি মর্মান্তিক ইতিহাস বিজড়িত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৪২-৪৫) সময় ৬৪১ জন ব্রিটিশ সৈন্য জাপানের হাতে গ্রেপ্তার হন। এসব সৈন্য ছিল রয়েল আর্টিলারি রেজিমেন্টের অন্তর্ভুক্ত। তাঁদের কমান্ডার ছিলেন মেজর ক্লেয়ার ক্যারি। জাপান এসব যুদ্ধবন্দির সাথে অমানবিক আচরণ করে। রানাও এলাকা থেকে এসব সৈন্যদেরকে বন-জঙ্গলের পথে হাঁটতে বাধ্য করে। এ পদযাত্রাকে বলা হয় Death march| ২২৬ কি. মি. জঙ্গলাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে সানদাকান নামক এলাকায় পৌঁছতে পৌঁছতে সব সৈন্য প্রাণ ত্যাগ করেন। তাঁদের সাথে খাবার ও পানি ছিল না। তাঁদের দেহ সমাধিস্থ করারও কোন ব্যবস্থা হয়নি। বন-বাদাড়ে তাঁদের লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল। নিহত সৈনিকদের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২০১১ সালে ৬৪১টি সামুদ্রিক পাথর দিয়ে সাবাহ চা বাগানের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। এ সংক্রান্ত একটি ফলক চা বাগানে রক্ষিত আছে। পরবর্তীতে জাপান সরকার এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে।
মালয়েশিয়ার বাজারে পলিথিনে মোড়ানো রসালো ফল
মালয়েশিয়ার বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় বাজারে পলিথিনে মোড়ানো নানা প্রজাতির খুচরো তাজা ফল বিক্রি হতে দেখা যায়। নিচে ট্রে এবং ওপরে পলিথিনের পাতলা আবরণে মোড়ানো যাতে ধুলোবালি থেকে সুরক্ষা থাকে। পর্যটকদের কাছে এগুলোর বেশ চাহিদা রয়েছে। খাওয়ার পর প্লাস্টিকের ট্রে ও পলিথিন যত্রতত্র না ফেলে নির্ধারিত ডাস্টবিনে ফেলার রেওয়াজ গড়ে উঠেছে। লাল ও হলুদ বর্ণের তরমুজ, কাঁঠাল, দুরিয়ান, জাম্বুরা, পেঁপে, শাম্মাম, আম, আনারস,আঙ্গুর, আতা ও শরিফার চাহিদা বেশি। ছোট এক ট্রে ফল ৫ রিংগিত বা বাংলাদেশি ১০০ টাকা।
বিশালায়তনের তিমির কংকাল
আল্লাহ তায়ালা মহাসমুদ্রে কত বিচিত্র, কত প্রজাতির, কত বিশালদেহী প্রাণী তৈরি করেছেন ভাবতে অবাক লাগে। সমুদ্র বিজ্ঞানীদের মতে চীন সাগরে প্রায় ৬০০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। এখানে শৈবালের উপস্থিতি অধিক হারে থাকায় মাছের প্রজননও বেশি। মালয়েশিয়ার সাবাহ জাতীয় যাদুঘরে ঢুকতেই চোখ পড়লো বিশালায়তনের এক তিমির কংকাল। তিমিটি ব্রাইড প্রজাতির (Brzde Whale)| দৈর্ঘ ১৮.৬ মিটার। মাথার খুলি ৪.৮ মিটার। ২০০৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর সাবাহ প্রদেশের কুটা কিনাবালোর অধীন গয়া দ্বীপ সাগরে এটি পাওয়া যায়।
দুরিয়ান: ফলের রাজা
মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের পথে ঘাটে একটি ফল বেশ দৃষ্টিগোচর হয় তার নাম দুরিয়ান। এ ফল সব বয়সী মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয় এবং ফলের রাজা হিসেবে খ্যাত। এটি Malvaceae গোত্রভুক্ত বৃক্ষ। ২/৩ শত প্রজাতির দুরিয়ান ফল আছে। এর মধ্যে মাত্র ৩০ প্রজাতির ফল খাবারের উপযোগী। ওজনে প্রায় ১ কেজি থেকে ৪ কেজি পর্যন্ত হয়। বাইরে দেখতে কাঁঠালের মত তবে কোষগুলো বেশ বড়। এর মিষ্টি সুগন্ধির তীব্রতা অনেকের কাছে অসহনীয়। যার কারণ ট্রেনে, বাসে, লঞ্চে ও বিমানে দুরিয়ান পরিবহণ নিষিদ্ধ।
১৫৮০ সাল থেকে মানুষ দুরিয়ান ফল-
খাওয়া শুরু করে। দুরিয়ান গাছ ৮২ থেকে ১৬৪ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। মালয়েশিয়া প্রতিবছর ২ লাখ ৬৫ হাজার টন দুরিয়ান উৎপন্ন করে। থাইল্যান্ডে সবচে বেশি দুরিয়ান উৎপন্ন হয় এবং প্রতিবছর ৪ লাখ টন দুরিয়ান চীন ও হংকংয়ে রপ্তানি করা হয়।
দুরিয়ানের ব্যবহার বহুমুখী। পাকা ফল হিসেবে খাওয়া যায়। আবার এত্থেকে চকোলেট, বিস্কুট ও আইসক্রিম তৈরি হয়। থাইল্যান্ডে দুরিয়ান ভাতের সাথেও অনেকে খেতে পছন্দ করেন। দুরিয়ান ফলের বিচি সেদ্ধ করে খাওয়া যায়। দুরিয়ান ফলের রয়েছে বেশ পুষ্টিগুণ। ৩৩% থায়ামিন বি১, ২৪% ভিটামিন বি-১ ও ম্যাঙ্গানিজ।
আমি মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার ফলের বাজারে দুরিয়ান কিনতে মানুষের ভীড় দেখেছি। সাবাহ প্রদেশেট কুটা কিনাবালোতে ফলমণ্ডিতে একটি দোকান দেখেছি যেখানে মানুষ চেয়ারে বসে বন্ধুূদের নিয়ে দুরিয়ান কিনে খাচ্ছে। সারা দুনিয়ায় আল্লাহ তায়ালা কত সুমিষ্ট ফল তৈরি করেছেন তা ভাবতে গা শিউরে ওঠে। একেক দেশের মাটি ও আবহাওয়া একেক ফলের জন্য উপযোগী।
ফিস মার্কেটের বৈচিত্র্য
মালয়েশিয়ার সাবাহ প্রদেশের কুটা কিনাবালো ফিস মার্কেট পরিদর্শন করি সন্ধ্যাবেলায়। বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক জীবন্ত মাছ, চিংড়ি, বাগদা, গলদা, শামুক, অক্টোপাস, কোরাল, কাঁকড়া বিক্রি হয়। অর্ডার দিলে তাৎক্ষণিক পরিস্কার করে রান্না অথবা ফ্রাই করে দেয়া হয়। শামুকের স্যুপ এখানে বেশ জনপ্রিয়। সাগরের পাড়ে শত শত মানুষ বিকেল ও সন্ধ্যাবেলা টেবিলে বসে সামুদ্রিক মাছ খেতে দেখলাম। এতদঞ্চলের ৫০ ভাগ মানুষ মুসলমান আর বাকি ৫০ ভাগ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী।
ভিন্ন মাযহাবের ইমামদের মতে সমুদ্রে মৎস্যজাতীয় যেসব প্রাণী বাস করে এগুলো মাছের হুকুম, হালাল। ইমাম আওযায়ী এর মতে যেসব সাপ বিষাক্ত নয় এগুলো খাওয়া জায়েয।
মালয়েশিয়ায় তো নুডলসের সাথে অক্টোপাসের বাচ্চাও ফ্রাই করে বিক্রি করা হয়, আমাদের দেশে তরকারির সাথে যেমন ছোট চিংড়ি রান্না করা হয়। ইসলামি আইনবিদ ও ফকিহদের মতে গুইসাপ খাওয়া জায়েয। তবে মহানবী (সা.) নিজে খাননি কিন্তু সাহাবিদের খেতে নিষেধ করেননি। এখনো আরবদেশে গুইসাপ খাওয়ার রেওয়াজ আছে।
মালয়েশিয়ার সাবাহ প্রদেশের কুটা কিনাবালো সিটি মসজিদের ইমামের সাথে
২ মে’১৯ সাবাহ প্রদেশের কুটা কিনাবালো জামে মসজিদে মাগরিবের নামায আদায় করি। এটি প্রদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর জামে মসজিদ। ইমামের কিরআত বেশ আকর্ষণীয়। নামায শেষে তিনি বেশ কিছুক্ষণ মাইকে দোয়া দরুদ পড়েন মুসল্লিদের নিয়ে। নামায শেষে আমি তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে কুশল বিনিময় করি। তাঁর নাম হাফেয মাওলানা যুবায়ের। পড়া লেখা করেছেন শ্রী পাতালিং তাবলীগ মারকায মাদরাসায়।
আলাপচারিতায় তিনি আমাকে জানালেন এখানকার বহু মুসল্লি প্রতি বছর বাংলাদেশের কাকরাইলের তাবলীগ মসজিদে যায়।