কওমি মাদরাসার নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু আগামীর পথচলা সুন্দর ও স্বার্থক হোক
রেওয়াজমাফিক প্রতি বছর হিজরী সালের শাওয়াল থেকে বাংলাদেশসহ গোটা উপমহাদেশে কওমি মাদরাসার নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়। যারা ফারিগ হন তারা অন্য কোন দীনী প্রতিষ্ঠানে অথবা অন্যকোন হালাল পেশায় যোগ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। নতুন শিক্ষার্থীগণ পছন্দের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন স্তরে ভর্তি হয়ে নবউদ্যমে তালিম গ্রহণ করেন।
ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ প্রণীত অষ্টনীতিমালা (উসুলে হাশতগানা), ক্যারিকুলাম ও কার্যপ্রণালি মতে সারা দুনিয়ার কওমি মাদরাসা পরিচালিত হয়। দারসে নিযামী এ শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি। কওমি মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থা আবাসিক। এখানে শিক্ষার সাথে আছে দীক্ষা, তালিমের পাশাপাশি আছে তারবিয়ত। পুরো দিনরাত রুটিনমাফিক পরিচালিত হয়। নির্ধারিত সময়ে নামায, শয্যাত্যাগ, শয্যাগ্রহণ, নাশতা, গোসল, খাবার, সবকে অংশগ্রহণ, কুতুবখানায় অধ্যয়ন, খেলাধুলা প্রভৃতি নির্দিষ্ট উস্তাদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।
কওমি মাদরাসার শিক্ষা ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘তাকরার’। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Group Study (সামষ্টিক পাঠ)। ২০/৩০ জন অথবা কমবেশি ছাত্র গ্রুপ করে মাগরিবের পর মাদরাসার বারান্দায় অথবা হলে বসে দিনের বেলা ক্লাশে উস্তাদপ্রদত্ত সবকের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। প্রতিটি গ্রুপে একজন মেধাবী ছাত্র গ্রুপ লিডার হিসেবে থাকে। পুরো ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণে থাকেন একজন উস্তাদ। মাদরাসা বোর্ডিংয়ে যেসব শিক্ষার্থী থাকে তাদের দেখবালের জন্য আছেন একজন তত্ত্বাবধায়ক। তিনি নাযিম দারুত তালাবা নামে পরিচিত। শিক্ষা কার্যক্রম ও খাবারের যিম্মাদারগণ যথাক্রমে নাযিম তালিমাত ও নাযিম মাতবাখ নামে খ্যাত। এসব যিম্মাদারগণ মুহতামিমের কাছে দায়াবদ্ধ। ছাত্ররাজনীতি না থাকায় কওমি মাদরাসার পরিবেশ একান্ত শিক্ষাবান্ধব।
নতুন শিক্ষাবর্ষে যারা মাদরাসায় দাখিলা নিয়েছে আমরা তাদেরকে স্বাগত জানাই। বস্তুবাদী এ দুনিয়ায় পবিত্র কুরআন-হাদীস ও ফিকহে ইসলামির ইলম অর্জন করে আমলের মাধ্যমে জীবন পরিবর্তন করতে পারলে আল্লাহ তাআলার রেযামন্দি হাসিল হবে এবং জীবন হবে স্বার্থক ও সুখময়। নিজের, পরিবারের, সমাজের ও রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। শিক্ষার্থীদের মনে রাখতে হবে,
- বিনাশ্রমে কিছু পাওয়া যায় না। যে যত বেশি মেহনতি সে তত বেশি সফল। দৈনন্দিন কাজের রুটিন তৈরি করে সে মাফিক চলতে হবে। ছাত্রজীবন কাজে লাগাতে না পারলে, কর্মজীবনে আর সুযোগ আসবে না। ইলমে দীন আহরণ ও বিতরণে ব্যস্ত থাকার কারণে পৃথিবীর বহু আলিম বিয়ে পর্যন্ত করেন নি। বিশ্বখ্যাত সিরিয়ার হানাফী আলিম শায়খ অবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ) এ বিষয়ে একটি কিতাব লিখেন, যার নাম: আল-উলামাউল উয্যাব।
- তালিবে ইলমদেরকে সময় কাজে লাগাতে হবে। প্রতিটি নিঃশ্বাস মূল্যবান। সময়ের আয়তন কম, জীবনের পরিধি সীমিত। হেলায় ফেলায় সময় নষ্ট করে দিলে জীবন উচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, ব্যর্থতা আমৃত্যু যাতনা দেবে। পৃথিবীর সফল ব্যক্তিগণ সময়কে কাজে লাগিয়েছেন। আকাবেরিনে দেওবন্দ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
- নাহু, সারাফ, ইনশা তথা আরবি ভাষা ও সাহিত্যের ওপর সবিশেষ জোর দিতে হবে। ইলমে দীনের বুনিয়াদ আরবির ওপর। তাফাসির, শারুহাতে হাদীস, ফিকহের সব কিতাব আরবি। আরবি ভাষায় পারঙ্গমতা থাকলে মূল কিতাব থেকে উপকৃত হওয়া যাবে।
- উস্তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। যে সব উস্তাদের সাথে কোন স্বীকৃত বুযুর্গের নিসবত আছে তাঁদের খিদমত করতে হবে। উস্তাদের নেক নযরের বরকতে শিক্ষার্থীদের জীবনে ইতিবাচক মৌলিক পরিবর্তন আসবে।
- বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। ভাষাকে অবজ্ঞা করা যাবে না। এই ভাষায় আলিমদেরকে তালিম, লেখালেখি, দাওয়াত-তাবলীগ, ওয়ায-নসীহত করতে হবে। তাই বাংলাভাষা শিক্ষা ও চর্চায় ছাত্রদেরকে সচেতন থাকতে হবে।
- মাদরাসার রেওয়াজ, শর্ত, নিয়ম কানুনের প্রতি যত্নবান থাকতে হবে।
- মাদরাসায় অবস্থানকালীন মোবাইল, ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম ও নেট পরিচালনা বন্ধ রাখতে হবে। ছুটিতে বাড়িতে অবস্থানকালীন মোবাইল ও ফেসবুক সীমিত রাখতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে ফেসবুকের আসক্তি কোকেইন নামক মাদকের চাইতেও বেশি।
- সর্বদা সুন্নাতের পায়রবি করতে হবে। বিদআত ও পাপ থেকে বিরত থাকতে হবে। মাদরাসার অভ্যন্তরে নেককার ছেলেদের সাথে মিশতে হবে। চরিত্রে ঘাটতি আছে এমন ছেলে থেকে সযত্নে দূরে থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে ইলম আল্লাহ তাআলার নুর। আল্লাহ তাআলা গোনাহগারকে ইলম দান করেন না। দয়া করে ইলম দান করলেও ‘ইফাদিয়ত’ কেড়ে (সালাব) নেন। সমাজে এরকম নযির ভুরিভুরি।
- নতুন বছরে শিক্ষার্থীদের জীবন ফলে ফুলে ভরে উঠুক। যোগ্য ও দক্ষ আলিমে বা আমল হিসেবে তারা গড়ে উঠুক। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রে পরিবর্তন আসুক। আল্লাহ তাআলার দরবারে এটাই প্রার্থনা।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন