সিয়াম সাধনা: হিকমত ও দর্শন
সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী
দয়াময় মহান প্রভু মু’মিন নর-নারীর ওপর রোযা ফরজ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَۙ۰۰۱۸۳
‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরজ করা হয়েছে। যেমনি তোমাদের পূর্ববর্তীগণের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যেন তোমরা তাকওয়া (খোদাভীতি) অবলম্বন করতে পারো।’[1]
উক্ত আয়াতে ইসলামের অন্যতম রুকন রোযা ফরজ হওয়ার বিধান বর্ণনা করা হয়েছে।
রোযার তাৎপর্য ও বাস্তবতা
আরবী ভাষায় রোযাকে صوم (সওম) বলা হয়। صوم শব্দের অর্থ বিরত থাকা, থামা, ঘোড়াকে টানিয়ে ধরা। আরবি ভাষায় صوم শব্দটি إمساك শব্দের সমার্থক। আরবে প্রচলন আছে যে, ঘোড়াকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া থেকে বিরত রাখা হয়। সম্পূর্ণরূপে ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত রাখা হয়। ধীরে ধীরে সেই ঘোড়ার ক্ষুধা ও পিপাসার সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়। যেন, যুদ্ধের ক্ষেত্রে কিছুক্ষণ পরপর খাওয়া-দাওয়ার প্রয়োজন না হয়। যদি ঘোড়াগুলো দীর্ঘ সময় পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া থেকে বিরত থাকতে অভ্যস্ত না হয়, ক্ষুধা ও পিপাসা সহ্য করতে সক্ষম না হয়, তাহলে যুদ্ধে ওই ঘোড়া দুর্বল ও ভীত হয়ে যায়। তখন যুদ্ধক্ষেত্রে বড় ধরণের সমস্যা সৃষ্টি হয়। তাই, আরবরা ঘোড়ার মধ্যে ধৈর্য ও ক্ষটভোগ করার যোগ্যতা বৃদ্ধি করার জন্য কয়েক দিন যাবত এমনকি একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত রাখে। এমন ঘোড়াকে আরবীতে বলা হয় فرس صائمة অর্থাৎ যে ঘোড়া নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে অভ্যস্ত হয়েছে। বলা হয়, আল্লাহ তাআলা রোযার জন্য এমন একটি শব্দ চয়ন করেছেন যা আরবে পূর্ব থেকে প্রচলিত ছিল। আরবরা এই শব্দটি খাওয়া-দাওয়া ও যৌনকর্ম থেকে বিরত থাকতে অভ্যস্ত ঘোড়ার জন্য ব্যবহার করতো। ঐ ঘোড়া না খেয়েও নিজ মালিকের অনুগত্যশীল ও অনুগামী হয়।
মূলত এ বিরত থাকার চেষ্টা,সংযমের অনুশীলনকে-ই রোযা বলা হয়। বিরত থাকা ও সংযমের অনুশীলনের ফলাফল হিসাবে যে বস্তুটি সৃষ্টি হয় তাকে তাকওয়া বলা হয়। অর্থাৎ রমযান মাসের দিবা-রাত্রিগুলো বিধি অনুযায়ী যথাযথভাবে পালন করার মাধ্যমে মানুষের আত্মিকশক্তি বিজয় লাভ করে পাশবিকশক্তির ওপর। তখন মানুষের মধ্যে অপরাধ ও পাপ থেকে বিরত থাকার যোগ্যতা অর্জিত হয়। মূলতঃ তাকে-ই ‘তাকওয়া’ বলা হয়। আর এই ‘তাকওয়া’ অর্জনের উদ্দেশ্যেই আল্লাহ তাআলা রমযানের রোযার বিধান দিয়েছেন। ইসলামী পরিভাষায় রোযা বলা হয়, সূর্য উদয় হওয়া থেকে নিয়ে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তে পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা।
সর্বযুগে রোযার বিধান
প্রিয় নবী (সা.) বলেন, হে ঈমানদারগণ! এই রোযা কেবল তোমাদের ওপর ফরজ করা হয়নি, বরং তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপরও রোযা ফরজ করা হয়েছিল। হ্যাঁ, রোযার পরিমাণ ও সংখ্যার ক্ষেত্রে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন রকম ছিল। যেমন- হযরত আদম (আ.) প্রতিমাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে (আইয়ামে বীজের) রোযা রাখতেন। এই রোযাগুলো উম্মতে মুহাম্মদিয়ার জন্য মুস্তাহাব। অথচ আদম (আ.)-এর জন্য ছিল ফরজ। অনুরূপভাবে হযরত নুহ (আ.)-এর উম্মত বড় কঠোর স্বভাবের ছিলেন। তাদের মধ্যে পাশবিকতার পরিমাণ তুলনামূলক অধিক ছিল। তা হ্রাস করার জন্য ঐ উম্মতের ওপর গোটা বছর রোযা পালন করতে হতো। হযরত দাউদ (আ.) এক দিন রোযা রাখতেন এবং অপর দিন ইফতার করতেন। আল্লাহ তাআলা শেষ যামানার উম্মতের জন্য বৎসরে এক মাস রোযা ফরজ করেছেন। আল্লাহ বলেন, اَيَّامًا مَّعْدُوْدٰتٍؕ ۰۰۱۸۴ (অল্প কয়েক দিন)[2] অর্থাৎ ৩৬০ দিনের মধ্য থেকে ২৯-৩০ দিন রোযা রাখা ফরজ করা হয়েছে।
ইসলামে রোযার গুরুত্ব
রোযা ইসলামের তৃতীয় রুকন। রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা আবশ্যকীয় মনে করে রোযা পালন করো। কেননা রোযার মত অন্য কোন ইবাদত নেই।
আল্লামা ইবনে আব্দুল বার (রহ.) বলেন, ‘প্রত্যেক ইবাদতে রিয়া বা লোক দেখানোর সম্ভাবনা রয়েছে। কেবলমাত্র রোযা-ই এমন ইবাদত যেখানে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। এটি গোপন ইবাদত। রোযার সর্ম্পক একদিকে আল্লাহ আর অপরদিকে বান্দা, মধ্যখানে কোন মাধ্যম নেই। নামায, হজ-যাকাত, এমন ইবাদত যেখানে অন্য মানুষ দেখতে ও অনুধাবন করতে পারেন। বরং যাকাত দ্বারা তো অন্যরা উপকৃত হন। কিন্তু রোযার সাথে এমন কোন বিষয় সংযুক্ত নয়। তার সম্পর্ক কেবলমাত্র রোযাদারের সাথেই হয়ে থাকে। অন্যরা তা দেখে না, অনুধাবন করতে পারে না। যদি কোন ব্যক্তি মানুষের সামনে পানাহার করে না, কিন্তু পর্দার আড়ালে চুপিসারে পানাহার করে তাহলে তার রোযা কি হবে? সে যদিও শত-সহস্র দাবি করে ‘আমি রোযাদার’ কিন্তু সে নিজেই জানে, সে রোযাদার নয়। তেমনি সে আল্লাহর নিকটও কখনো রোযাদার হতে পারে না। রোযার সর্ম্পক সরাসরি আল্লাহর সাথে। তাই আল্লাহ তাআলা বলেন, প্রত্যেক ইবাদতের প্রতিদান দেয়া হবে, তবে রোযা এমন ইবাদত যার প্রতিদান ¯^qs আমি-ই প্রদান করবো। হাদীসে কুদসীতে এসেছে, ‘রোযা আমার জন্য এবং আমিই তার প্রতিদান দেব [আত-তামহীদু, খ. ১৯, পৃ. ৬০]।’
রোযার উপকার
রোযার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকার হলো রোযা মানুষকে নীতির অনুগামী করে। রোযার মাধ্যমে মানুষ নির্ধারিত সময় পর্যন্ত হালাল পানাহার থেকে বিরত থাকে। উদ্দেশ্য হলো মানুষ যেন নিয়ম-নীতির অনুগামী হয়। যখন নিয়ম মেনে চলার জন্য হালাল বস্তু থেকে বিরত থাকবে তাহলে হারাম বস্তু থেকেও বিরত থাকবে। খাওয়া-দাওয়া ও প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণের মাধ্যমে মানুষের নফস আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে। তা দূর্বল করার জন্য ইসলাম রোযার বিধান জারি করেছে। যেন ক্ষুধার মাধ্যমে মানুষের প্রবৃত্তিকে দুর্বল করা যায়। لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَۙ۰۰۱۸۳-এর উদ্দেশ্যও তাই। যেন রোযার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ভালো স্বভাব (তাকওয়া) অর্জিত হয়।
হযরত শায়খুল হিন্দ (রহ.) বলেন, রোযার মাধ্যমে নফস যখন আর্কষণীয় বস্তু থেকে বিরত থাকতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে তখন তার জন্য শরিয়ত কর্তৃক নিষিদ্ধ হারাম বস্তু থেকে বিরত থাকাও সহজ হয়ে যাবে। যখন রোযার কারণে নফস এবং প্রবৃত্তির শক্তি হ্রাস পাবে তাহলে মুত্তাকি (খোদাভীরু) হওয়া সহজ হয়ে যাবে। রোযার মধ্যে বড় হিকমত লুকায়িত আছে যে, তাতে বিদ্রোহী নফসের সংশোধন হয়। শরিয়তের বিধি-বিধান পালনে অভ্যস্ত হয়। মুত্তাকি হওয়ার অর্থ হল, নফস বা প্রবৃত্তি মানুষের অনুগামী হওয়া এবং শরিয়তের বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা সহজ হওয়া।
রোযার হিকমত ও দর্শন:
প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আল্লাহ তাআলা দুটি সাংর্ঘষিক শক্তি, দুটি বিপরীত যোগ্যতা এবং দুটি সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী স্বভাব একত্রিত করেছেন:
প্রথমত প্রত্যেক মানুষের মধ্যে জীব-জন্তুর স্বভাব-চরিত্র, কামনা ও অভিলাষ এবং চাহিদা ও প্রয়োজন বিদ্যমান রয়েছে। তাই যে সকল বস্তু একটি জন্তুর জন্য প্রয়োজন তা একজন মানুষের জন্যও প্রয়োজন। কারণ, মানুষের মধ্যেও বিদ্যমান রয়েছে পশুত্বের সেই উপাদান। যেমন- জীব-জন্তুকে খাওয়া-দাওয়া করতে হয়, ঠাণ্ডা-গরম থেকে দূরে থাকার প্রয়োজন হয়, ঘুম ও বিশ্রামের প্রয়োজন হয়, নরের জন্য নারীর এবং নারীর জন্য নরের প্রয়োজন হয়; এই সবকিছু পশুত্বের চাহিদা ও পাশবিক দাবি। এই সব চাহিদা ও দাবি মানুষের জন্যও প্রয়োজন।
দিতীয়ত প্রত্যেক মানুষকে আল্লাহ তাআলা পাশবিকতার সাথে সাথে অন্য একটি বস্তু দান করেছেন, তা হলো স্বর্গীয় অস্তিত্ব বা ফেরেশতার উপাদান, তা হলো মানুষের আত্মিক অস্তিত্ব। প্রত্যেক মানুষ এ দু’উপাদান (পাশবিক ও আত্মিক অস্তিত্ব) দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে।
পাশবিক শক্তির প্রভাব
পাশবিক ও আত্মিক উভয় শক্তির কিছু নিজস্ব চাহিদা ও দাবি আছে। তা থেকে সৃষ্ট কিছু কামনা ও অভিলাষ রয়েছে। সুতরাং মানুষ পৃথিবীতে বসবাস করার দুটি পন্থা রয়েছে। হয়তো পাশবিকতাকে শক্তিশালী করে আধ্যাত্মিকতাকে দূর্বল করবে, অথবা আধ্যাত্মিকতাকে শক্তিশালী করে পাশবিকতাকে দুর্বল করবে, যেন লাগাম (নিয়ন্ত্রণ) আত্মিক শক্তির হাতে থাকে। এ দু’যোগ্যতার মধ্যে যে-ই শক্তিশালী হবে সে-ই মানুষকে পারিচালনা করবে। সে নিজ দাবির প্রতি মানুষকে টানবে, নিজের স্বভাব অনুযায়ী মানুষের স্বভাবকে রূপান্তরিত করবে। যদি কোন মানুষের পাশবিকতা সুস্থ ও শক্তিশালী হয়, এবং আধ্যাত্মিকতা অসুস্থ ও দুর্বল হয়, তখন পাশবিকতার দাবি মানুষের ওপর বিস্তার লাভ করবে। তার জল্পনা-কল্পনা তাই হয় যা জীব-জন্তুর হয়ে থাকে। তার কাছে সদা তাই স্মরণ হতে থাকবে যা জীব-জন্তুর অন্তরে স্মরণ হয়। জীব-জন্তুর মনে কখনো গরীব-দুঃখীদের সেবার কথা স্মরণ হয় না। জীব-জন্তু অশ্রু প্রবাহিত করে দুয়া করে না। জীব-জন্তুর মধ্যে কামনা-বাসনা থেকে নিজেকে বিরত রাখার যোগ্যতা নেই। যদি কোন ক্ষুধার্ত জন্তুর সামনে শাক-সবজি রাখা হয়, তখন সে সেখানে মুখ দেবে-ই। এটি কার? তার মালিক কে? তা আমার জন্য বৈধ কি না? আমার জন্য হালাল না হারাম?
নিরুপায়ী জীব-জন্তু এই সকল বস্তু নিয়ে ভাবে না। সে পিপাসার্ত হলে নালা-নর্দমায় প্রবাহমান পানি পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করে। অথবা তার অন্তরে যখন কামভাব সৃষ্টি হয়, তখন সে যেভাবেই হোক তা পুরণ করে। কে কি বলবে, বা মানুষ তা দেখছে,এগুলোর প্রতি তার কোন ভ্রক্ষেপ নেই। এটি লজ্জার বিষয়, এটি মন্দ কাজ, এটি অশ্লীল কাজ, এটি আমার জন্য অবৈধ, এমন ভাবনা জীব-জন্তুর নিকট থাকে না।
অনুরূপভাবে যে মানুষের স্বভাবে পাশবিকতার উপাদান অধিক হয়, তার চিন্তা-চেতনা জীব-জন্তুর ভাবনার মত হয়ে যায়। সে কাউকে কষ্ট দিতে, কারো মানহানি করতে অথবা অশ্লীল কর্ম-কাণ্ডে লিপ্ত হতে কোন অসুবিধা মনে করে না। আল্লাহ যে সকল বস্তুকে মানুষের জন্য ক্ষতিকর বানিয়েছেন তা থেকে বেঁছে থাকতে উৎসুক হয় না।
পাশবিকতা দুর্বল ও শক্তিশালী হওয়ার উপকরণ
পাশবিকতা কিভাবে শক্তিশালী হয়? এবং আধ্যাত্মিকতা কিভাবে দূর্বল হয়? এটি অত্যন্ত সহজ বিষয়, সুক্ষ্ম দর্শন নয়। উভয়টির আহার্য রয়েছে। যদি কোন ব্যক্তি আধ্যাত্মিকতার আহার্য কমিয়ে দেয় এবং পাশবিকতার আহার্য বাড়িয়ে দেয় তখন নিজে নিজেই পাশবিকতা শক্তিশালী হয়ে যায় এবং আধ্যাত্মিকতা দুর্বল হয়ে যায়। দিনের বেলা কয়েক দফা পানাহার করলে, নর-নারীর মিলনে অথবা পাশবিকতার অন্যান্য চাহিদাসমূহ পূর্ণ করার মাধ্যমে পাশবিকতা শক্তিশালী হয়,পশুত্ব বৃদ্ধি পায়, কামভাব জাগ্রত হয়, প্রচণ্ড ক্রোধে উত্তেজিত হয়, প্রতিশোধের স্বভাব সৃষ্টি হয়। অন্যের দুঃখে দুখী হয় না। যেমন সাপ কাউকে দংশন করলে তাতে তার কিছু আসে যায় না। সাপ মানুষকে খায় না। তবে দংশন করে স্বাদ পায়। তেমনি মানুষের পাশবিকতা যখন শক্তিশালী হয়, তখন সে কঠোর ও জালিম হয়। বোন ও মেয়ের হক নষ্ট করে। প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়। কারো দুঃখ অনুভব করেনা। সদা নিজ স্বার্থে মত্ত থাকে।
পাশবিকতা দুর্বল ও শক্তিশালী হওয়ার উপকরণসমূহ
এখন আমাদের জানার বিষয় হলো, পাশবিকতা কিভাবে শক্তিশালী হয়? মূলত পাশবিকতার যত উপাদান রয়েছে সবগুলো যমিনের নীচ থেকে উৎপাদিত হয়। পানাহারের বস্তুসমূহ যেমন- শাক-সবজি, চা-পান, গোস্ত-মাংশ, দুধ-কলা, ফল-মূল ইত্যাদি সবকিছু যমিনের ভিতর থেকে উৎপন্ন হয়। সুতরাং পাশবিকতার উপাদান যে যত বেশি গ্রহণ করে তা মানুষকে তত বেশি নিম্নে নিয়ে যায়। তার স্বভাব-চরিত্রে হীনতা, তার কল্পনা-জল্পনায় দীনতা এবং তার উচ্চাঙ্ক্ষা ও উচ্চাভিলাষে নীচতা; এমনকি সকল ক্ষেত্রে নিম্নপন্থা পরিলক্ষিত হয়। মানুষ সৃষ্টির সেরা হওয়া সত্ত্বেও সর্বনিম্নস্থরে চলে আসে।
আধ্যাত্মিকতা শক্তিশালী করার উপকরণ
মানুষের মধ্যে যে আধ্যাত্মিকতা বা স্বর্গীয় উপাদান আছে তারও কিছু আহার্য রয়েছে। তার আহার্য আসমান থেকে আল্লাহর নির্দেশরূপে আসে। মানুষ যতবেশী আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলবে, আল্লাহকে স্মরণ করবে, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করবে, আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্তু থেকে নিজেকে বিরত রাখবে তাতে তার আধ্যাত্মিকতা ও স্বর্গীয় শক্তি মজবুত হবে। যখন যে কোন নারী-পুরুষের মধ্যে আধ্যাত্মিকতা শক্তিশালী হবে তখন তার মধ্যে একটি যোগ্যতা অর্জিত হবে। মনে করুন, ফেরেশতাদের একটি বিশেষ স্বভাব রয়েছে যা আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন,
لَا يَعْصُوْنَ اللّٰهَ مَاۤ اَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُوْنَ مَا يُؤْمَرُوْنَ۰۰۶
‘তাঁরা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে না। তাঁরা গুনাহ করে না। তাঁরা তাই করে যা তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়।’[3]
অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশ পালন করা এবং আল্লাহর নিষেধ থেকে বিরত থাকা ফেরেশতাদের বিশেষ স্বভাব তেমনি মানুষ যখন নিজের আধ্যাত্মিক শক্তিকে সবল করে, আত্মিক কর্ম পরিধি বাড়িয়ে দেয়, স্বর্গীয় শক্তিকে সমৃদ্ধ করার উপকরণ গ্রহণ অধিকহারে গ্রহণ করে, তখন আল্লাহ তাআলা মানুষের মধ্যে ফেরেশতাদের যোগ্যতা দান করেন। তখন মানুষ পাপ-পঙ্কিলতা থেকে খুব সহজেই বিরত থাকতে সক্ষম হয় এবং অত্যন্ত সহজে পূণ্যের কাজ আঞ্জাম দেয়। যার আধ্যাত্মিকতা শক্তিশালী হবে কেবলমাত্র সেই পাপ থেকে বেঁচে থাকতে পারবে। যার আত্মিকশক্তি সমৃদ্ধ হবে সেই ধারাবাহিকভাবে একাকি অবস্থায় হোক কিংবা জনসম্মুখে সকল ক্ষেত্রে সদা উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে পূণ্যের কাজ করতে সক্ষম হবে। যার আধ্যাত্মিকতা দূর্বল হবে এবং পাশবিকতা শক্তিশালী হবে তার পক্ষে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা কখনো সম্ভব হবে না।
আল্লাহর রহমত ও দয়ার মাস রমযান
আল্লাহ তাআলা আপন দয়া ও রহমতের বশীভূত হয়ে বান্দা-বান্দীদের পাশবিকতা দুর্বল করার সম্ভাব্য সকল কৌশল নিশ্চিত করেছেন এবং আধ্যাত্মিকতা শক্তিশালী করার সকল পন্থা স্পষ্ট করেছেন। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে দয়ালু প্রভুর পক্ষ থেকে নিত্যনতুন প্রোগ্রাম প্রদান করা হয়েছে। রমযান মাসে দিবা-রাত্রির বিশেষ আমল নির্দিষ্ট করে দেয়া, অন্যান্য মাসের চেয়ে ভিন্ন করে রমযান মাসকে বিশেষায়িত করা; মুলত আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে একটি সুবর্ণ সুযোগ। যারা গোটা বছর উশৃঙ্খল, ভারসাম্যহীন, নির্ভয় ও অগ্রাহ্যকারী ছিল, যাদের পাশবিকতা শক্তিশালী ও আধ্যাত্মিকতা দুর্বল, যারা নিজেদের পাশবিকতাকে অনেক আহার্য দিয়েছে এবং আধ্যাত্মিকতাকে খুবই কম আহার্য দিয়েছে। এমন বান্দা-বান্দিদের আধ্যাত্মিকতাকে শক্তিশালী করার জন্য আল্লাহ বিশেষ এক বিধান দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি সাধারণ বান্দা-বান্দিদের সুবিধার্থে তাদের আধ্যাত্মিকতাকে শক্তিশালী ও পাশবিকতাকে দুর্বল করার জন্য একমাসের একটি প্রোগ্রাম ফরজ করেছি। সারা বছর আমার জন্য কাজ করোনি, এখন করো। সারা বছর খেয়েছো, তাতে তোমার আধ্যাত্মিকতা দূর্বল হয়েছে এবং পাশবিকতা সবল হয়েছে। অনেক বেশি কথা বলেছো, অনেক বেশি খেয়েছো, অনেক বেশি ঘুমিয়েছো; এই সবকিছু পশুত্বের স্বভাব। এখন রমযান মাসের প্রোগ্রাম ফরজ করছি, তোমাদের জন্য সাধারণ পরিবেশ তৈরি করছি, এ মাসের দিবা-রাত্রির জন্য একটি বিশেষ তারতীব ঘোষণা করছি এবং ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত ও নফল সংবলিত বিধি-বিধান দিচ্ছি। যদি কেউ সঠিকভাবে তা পালন করে তাহলে সারা বছরের বিকৃতরুচি ও (disbalance) অনিয়ন্ত্রিত জীবনধারাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সফলকাম হবে।
[1] আল-কুরআন, সুরা আল-বাকারা, ২:১৮৩
[2] আল-কুরআন, সুরা আল-বাকারা, ২:১৮৪
[3] আল-কুরআন, সুরা আল-বাকারা, ২:১৮৩