জামেয়া ওয়েবসাইট

মঙ্গলবার-১০ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-১৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)-এর ভূমিকা

শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)-এর ভূমিকা

শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)-এর ভূমিকা

ড. খালিদ হোসেন

জীবিকা অর্জনের অন্যতম উপায় হচ্ছে শ্রম। শ্রমই মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের চালিকা শক্তি। শ্রম ব্যতীত জাতীয় জীবনের উন্নতি ও অগগ্রতি কল্পনা বিলাসমাত্র। এ কারণেই রাসুলুল্লাহ (সা.) শ্রম বিনিয়োগের ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। তাঁর মতে নিজ হস্তের উপার্জনের চেয়ে উত্তম উপার্জন আর কিছু হতে পারে না। অপরের নিকট হস্ত প্রসারের চেয়ে নিজ পিঠে জ্বালানী কাঠের বোঝা বহন করা অনেক বেশি উত্তম। মানুষ নিজের খাতে, পরিবারের খাতে, নিজের সন্তানদের এবং নিজের চাকরের খাতে যা কিছু ব্যয় করে, তা আল্লাহ তাআলার দরবারে সাদকা হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মতে প্রথম স্তরের ফরযের পর (সালাত, সাওম, হজ, যাকাত) দ্বিতীয় স্তরের ফরয হল হালাল জীবিকা অর্জন।[1]

রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হল কোন উপার্জনটি সর্বাধিক পবিত্র ও সর্বোত্তম? তিনি বললেন, ‘মানুষের নিজের হাতের উপার্জন এবং প্রতিটি হালাল ব্যবসা।[2]

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মতে, যে ব্যক্তি নিজ হস্তে উপার্জন করে ক্লান্ত অবস্থায় সন্ধ্যায় উপনীত হল, সে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে সন্ধ্যা করল। যে কোন বৈধ পেশা Aej¤^b করে অর্থ উপার্জন ইবাদতের সমতুল্য। তিনি বলেন,

«إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْـمُؤْمِنَ الْـمُحْتَرِفَ».

‘নিশ্চয় আল্লাহ পেশাজীবী মুমিনকে ভালো বাসেন।[3]

একদিন এক আনসারী ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট এসে কিছু চাইলেন। তিনি বললেন, তোমার ঘরে কি কিছুই নেই? উত্তরে সে বলল, জি হ্যাঁ। একখানা কম্বল আছে, যার একাংশ আমি পরিধান করি এবং অপর অংশ শয্যারূপে ববহার করি। তা ছাড়া পানি পান করার জন্য একটি পানপাত্রও আছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তাহলে এই দুইটি জিনিসই আমার নিকট নিয়ে এস। সে উক্ত দুইটি জিনিস নিয়ে আসলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তা নিজ হস্তে নিয়ে উপস্থিত লোকদের মধ্যে এসবের নিলাম ডাকলেন এবং বললেন, এগুলো কে ক্রয় করবে? জনৈক সাহাবী বললেন, আমি এইগুলি এক দিরহাম দিয়ে নিতে রাযী আছি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, এক দিরহামের চেয়ে অধিক দিয়ে নেওয়ার জন্য কে রাযী? এ কথাটি তিনি দুইবার বা তিনবার বললেন। তখন এক সাহাবী বললেন, দুই দিরহাম দিয়ে নেওয়ার জন্য আমি রাযী। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে উক্ত দুই বস্তু প্রদান করে দুই দিরহাম গ্রহণ করলেন। অতঃপর তিনি এই দিরহাম দুইটি আনসারীকে দিয়ে বললেন, এর একটি দিয়ে তোমার পরিবার পরিজনের জন্য খাদ্য ক্রয় করে তাদেরকে দিয়ে এস। আর অপর দিরহামের বিনিময়ে একটি কুড়াল ক্রয় করে আমার নিকট নিয়ে এস। সে কুড়াল ক্রয় করে রাসুলুল্লাহ (সা.) নিকট আসলে তিনি নিজ হস্তে কুড়ালের হাতল লাগিয়ে দিলেন এবং বললেন, জঙ্গলে যাও কাঠ সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রয় করতে থেক। আর আমি যেন তোমাকে পনের দিনের মধ্যে না দেখি। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশে সাহাবী জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করে তা বাজারে বিক্রয় করতে লাগলেন। কিছু দিন পর দশ দিরহাম উপার্জন করে তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট ফিরে আসলেন এবং এর অর্ধেক দিয়ে কাপড় বাকি অর্র্ধেক দিয়ে খাদ্যদ্রব্য খরিদ করলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন,

«هَذَا خَيْرٌ لَّكَ مِنْ أَنْ تَجِيءَ الْـمَسْأَلَةُ نُكْتَةً فِيْ وَجْهِكَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ».

‘অপরের নিকট ভিক্ষার দরুন কিয়ামতের দিন তোমার চেহারায় দাগ নিয়ে আসা অপেক্ষা জীবিকার্জনের এটি অনেক বেশি উত্তম পন্থা।[4]

এখানে লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হচ্ছে যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) উক্ত সাহাবীকে ভিক্ষার পরিবর্তে পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জনের প্রতি উৎসাহিত করেন। তা ছাড়া তিনি শ্রমবিনিয়োগের কার্যকরী পন্থা নির্ধারণ করে দেন। এমনিভাবে সমাজের বেকার সমস্যা সমাধানেও রাসুলুল্লাহ (সা.) বাস্তব ভূমিকা রাখেন। ভিক্ষাবৃত্তি ইসলাম অনুমোদন করে না। সমাজে ভিক্ষুকের কোন মর্যাদা নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) ভিক্ষাবৃত্তির বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, যেই ব্যক্তি ধন-সম্পদ বৃদ্ধির জন্য মানুষের নিকট ভিক্ষা করে সে যেন জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড ভিক্ষা করে, পরিমাণে তা কম বা বেশি হোক। যে মানুষের নিকট সব সময় ভিক্ষা করে বেড়ায় কিয়ামতের দিন সে এমন অবস্থায় উপস্থিত হবে যে, তার মুখমন্ডলে কোন গোশত থাকবে না।[5]

সমাজ থেকে ভিক্ষাবৃত্তি উচ্ছেদের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেন,

«مَنْ يَّكْفُلُ لِيْ أَنْ لَّا يَسْأَلَ النَّاسَ شَيْئًا، وَّأَتَكَفَّلُ لَهُ بِالْـجَنَّةِ».

‘যে মানুষের নিকট ভিক্ষা না করার নিশ্চয়তা দেবে আমি তাকে জান্নাতের নিশ্চয়তা দেব।[6]

আত্মকর্মসংস্থানের জন্য পূর্ববর্তী সব নবী-রাসুলগণ ছাগল চরিয়েছেন এবং সর্বশেষে রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বয়ং ব্যবসা পরিচালনা করেন, ছাগল চরাইতেন এবং কিছু কালের জন্য কৃষিকর্মে নিয়োজিত ছিলেন।[7]

ইসলামের দৃষ্টিতে হালাল কর্মে ও হালাল পথে শ্রম বিনিয়োগ কিছুমাত্রও লজ্জার ব্যাপার নয় বরং এটি নবীগণের সুন্নাত। প্রত্যেক নবীই দৈহিক পরিশ্রম করে উপার্জন করেছেন বলে হাদীসে বর্ণিত আছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত দাউদ (আ.) বর্ম তৈরি, হযরত আদম (আ.) কৃষিকাজ, হযরত নুহ (আ.) কাঠমিস্ত্রীর কাজ, হযরত ইদরীস (আ.) সেলাই কাজ এবং হযরত মুসা (আ.) রাখালের কাজ করতেন।[8]

শ্রম যদি ক্ষুদ্র ও নিচু ধরনের বিষয় হত, তা হলে নবী-রাসুলগণ সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা এই জাতীয় কাজ সম্পাদন করাতেন না। প্রতিটি নবী ও রাসুল ছিলেন আত্মনির্ভরশীল। সবাই নিজ হাতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কেউ কারও গলগ্রহ বা পরনির্ভরশীল হয়ে থাকেন নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) ভিক্ষাবৃত্তি বা পরজীবী হিসেবে জীবন যাপনকে কেবল নিরুৎসাহিত করেননি বরং তা বন্ধের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। শ্রম বিমূখ হয়ে বসে থাকার সুযোগ ইসলামে নাই। বেকার জীবন মানব জীবনের জন্য অভিশাপ। সুতরাং নিরলস শ্রম দরিদ্রতার ঘনঘটা দূর করে সফলতার সূর্যালোকের সন্ধান দেয়। উপর্যুক্ত হাদীসসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমের গুরুত্ব ও মর্যাদা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।

শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক

ইসলামে শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ক প্রভু-ভৃত্যের নয়। এই সম্পর্ক সহমর্মিতা, মানবিকতা ও ভ্রাতৃত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলাম মানুষকে হৃদয়বান হতে উদ্বুদ্ধ করে কারণ দুর্ভাগা ব্যক্তির অন্তরে দয়া-মায়া থাকে না। রাসুলু­ল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে না আল্লাহও তার প্রতি দয়া করেন না। মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব এবং মতবৈষম্য বর্তমান পৃথিবীকে বিক্ষুদ্ধ করে তুলেছে এর সঠিক সমাধান এবং উভয়ের মধ্যে ইনসাফপূর্ণ সমন্বয় একমাত্র ইসলামই করতে পারে। শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে পাষ্পরিক সম্পর্ক নিরূপন করে রাসুলু­ল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেন,

«إِخْوَانُكُمْ جَعَلَهُمُ اللهُ تَحْتَ أَيْدِيْكُمْ، فَأَطْعِمُوْهُمْ مِمَّا تَأْكُلُوْنَ، وَأَلْبِسُوْهُمْ مِمَّا تَلْبَسُوْنَ، وَلَا تُكَلِّفُوْهُمْ مَا يَغْلِبُهُمْ، فَإِنْ كَلَّفْتُمُوْهُمْ فَأَعِيْنُوْهُمْ».

‘তারা (অধীনস্ত ব্যক্তিবর্গ) তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তোমাদের অধীনস্ত করেছেন। আল্লাহ তাআলা কারও দীনি ভাইকে তার অধীনস্ত করে দিলে সে যা খাবে তাকে তা থেকে খাওয়াবে এবং সে যা পরিধান করবে তাকে তা থেকে পরিধান করতে দেবে। আর যে কাজ তার জন্য কষ্টকর সাধ্যাতীত তা করার জন্য তাকে বাধ্য করবে না। আর সেই কাজ যদি তার দ্বারাই সম্পন্ন করতে হয়, তবে তাকে অবশ্যই সাহায্য করবে।[9]

উপর্যুক্ত হাদীস থেকে নিম্ন বর্ণিত মূলনীতিসমূহ প্রতীয়মান হয়:

  1. মুসলমান পরস্পর একে অন্যের ভাই। শ্রমিক হলে সে ক্ষেত্রেও এ হুকুম প্রযোজ্য। সুতরাং দুই সহোদর ভাইয়ের মধ্যে যেই রূপ সম্বন্ধ থাকে মালিক ও শ্রমিকের মাঝেও অনুরূপ সম্পর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়।
  2. খাওয়া পরা প্রভৃতি মৌলিক প্রয়োজন পূরণের মান মালিক ও শ্রমিকের উভর সমান হতে হবে। মালিক যা খাবে ও পরিধান করবে শ্রমিককেও তা থেকে খাতে ও পরতে দেবে অথবা অনুরূপ মানের ও অনুরূপ পরিমাণের অর্থ মজুরিস্বরূপ প্রদান করবে।
  3. সময় ও কাজ উভয় দিক দিয়েই যা সাধ্যাতীত এমন দায়িত্ব শ্রমিকের ওপর চাপানো যাবে না। এভাবে এত দীর্ঘসময় পর্যন্তও একাধারে কাজ করতে তাকে বাধ্য করা যাবে না, যা করতে শ্রমিক অক্ষম।
  4. শ্রমিকের পক্ষে কষ্টকর এমন কাজ শ্রমিকের দ্বারা সম্পন্ন করতে হলে প্রয়োজন অনুপাতে তাকে সাহায্য করতে হবে। অধিক সময়ের প্রয়োজন হলে সে জন্য তার শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। এমনকি অধিক মজুরির (Over Time) প্রয়োজন হলে তাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাকে প্রদান করতে হবে।[10]

রাসুলু­ল্লাহ (সা.) শ্রমিকদের প্রতি সহৃদয়তা পূর্ণ ব্যবহার করার নির্দেশ দেন, কারণ দুর্বব্যহারকারীদের জন্য জান্নাতের দ্বার বন্ধ। অধীনস্তদের প্রহার করা ও গালিগালাজ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। নির্দোষ কোন শ্রমিককে অকারণে অভিযুক্ত করা হলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা মালিকের প্রতি কঠোর শাস্তি আরোপ করবেন।

মজুর ও চাকরের অপরাধ অসংখ্যবার ক্ষমা করা তিনি মহত্ত্বের লক্ষণ বলে ঘোষণা দেন। কৃত অপরাধের জন্য অধীনস্তদের ক্ষমা করার পাশাপাশি শিষ্টাচার শিক্ষা প্রদানের ওপরও তিনি সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। তিনি নিজেও তাদের প্রতি হৃদ্যতাপূর্ণ আচরণ করতেন। হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাযি.) দীর্ঘ দশ বছর পর্যন্ত তাঁর খিদমত করেছেন এবং ছায়ার মতো তাঁর পাশে রয়েছেন। কিন্তু এই দীর্ঘকালের মধ্যে তিনি তার নিকট কোন কৈফিয়ত তলব করেননি এবং কোন কাজের দরুন তাকে কখনো ভর্ৎসনাও করেননি। জনৈক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট এসে বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! কর্মচারীকে (খাদিম) কতবার ক্ষমা করব? রাসুলুল্লাহ (সা.) নিশ্চুপ রহিলেন। লোকটি আবারও বলল, কর্মচারীকে (খাদিম) কতবার ক্ষমা করব? তিনি বললেন,

«كُلَّ يَوْمٍ سَبْعِيْنَ مَرَّةً».

‘প্রতিদিন সত্তর বার।[11]

মোটকথা শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ক হবে ভাইয়ের মত। শ্রমিক-মালিক কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব ভাই হিসেবে আঞ্জাম দেবে। আর মালিক থাকবে তার প্রতি সহানুভূতিশীল, দয়াবান ও দরদি। মালিক শ্রমিককে শোষণ করবে না এবং সাধ্যাতীত কোন কাজের দায়িত্বও তার ওপর চাপাইয়া দেবে না। এভাবে শ্রমিক ছাটাই করে তাদেরকে অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দেবে না।

মালিকের অধিকার কর্তব্য

শ্রমিক ও মালিকের অধিকার কর্তব্যের বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমান পৃথিবীতে মালিক-শ্রমিক অসন্তোষ, শ্রমিক ছাটাই ও আন্দোলন ইত্যাদি অনভিপ্রেত অবস্থার উদ্ভব হচ্ছে এবং অবস্থা দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর আকার ধারণ করছে।

বস্তুত এসব বিষয়ে ইসলামের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট। মালিকের প্রধান কর্তব্য হল, কর্মক্ষম, সুদক্ষ ও শক্তিমান এবং আমানতদার বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে বা ব্যক্তিদেরকে কাজে নিয়োজিত করা। কর্মক্ষম ও আমানতদারী এ দুই গুণ ব্যতীত কোন কাজে বা শিল্পে সফলতা অর্জন সম্ভব নয়। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে,

اِنَّ خَيْرَ مَنِ اسْتَاْجَرْتَ الْقَوِيُّ الْاَمِيْنُ۰۰۲۶

‘তোমার মজুর হিসেবে উত্তম হবে সেই ব্যক্তি যে শক্তিশালী বিশ্বস্ত।[12]

মালিকের দ্বিতীয় কর্তব্য হচ্ছে সময় ও মজুরি নির্ধারণ করে শ্রমিককে কাজে নিয়োগ করা। অন্যথায় শ্রমিক-মালিক অসন্তোষ দেখা দেয় এবং উৎপাদন বিঘ্নিত হয়। মজুরের মজুরি নির্ধারণ না করে তাকে কাজে নিয়োগ করতে রাসুলুল্লাহ (সা.) নিষেধ করেছেন। ইসলামী অর্থনীতির মজুরী নির্ধারণ সূত্র হল, ন্যূনতম মজুরি প্রত্যেক শ্রমিকের প্রয়োজনানুসারে নির্ধারিত হবে। অর্থাৎ প্রত্যেক শ্রমিককে কমপক্ষে এমন মজুরি দিতে হবে, যেন সে এর দ্বারা তার ন্যায়ানুগ ও স্বাভাবিক চাহিদা মিটাতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা.) অধীনস্থদের খোরপোষ দিতে নির্দেশ প্রদান করেন।

উপর্যুক্ত হাদীসের আলোকে এ কথা বোঝা যায় যে, মালিক শ্রমিকদের ভরন-পোষণের দায়িত্ব লইবে অথবা এমন মজুরি দেবে, যাতে তাদের প্রয়োজন মিটিয়া যায়। প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যক্তির দক্ষতা, যোগ্যতা, পরিবেশ, চাহিদা, জীবনযাত্রা ইত্যাদি পর্যালোচনা করে নির্ধারণ করতে হবে। আর এসব যেহেতু পরিবর্তনশীল, তাই শ্রমিকের মজুরির ক্ষেত্রেও পরিবর্তন সাধিত হতে পারে।

মালিক শ্রমিক থেকে কি ধরণের কাজ নিতে চায় তাও পূর্বে আলোচনা করে লওয়া মালিকের কর্তব্য। কোন শ্রমিককে এক কাজের জন্য নিয়োগ করে তার সম্মতি ছাড়া তাকে অন্য কাজে নিয়োজিত করা জায়িয নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে কাজ করা মাত্রই শ্রমিককে তার পারিশ্রমিক প্রদান করা মালিকের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। তবে অগ্রীম বা অন্য কোন রকম কোন শর্ত থাকলে ভিন্ন কথা। বস্তুত মজুর সমপ্রদায় হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে কাজ করে থাকে। তারা তাদের নিজেদের এবং পরিবারবর্গের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের জন্য এই পরিশ্রম করে এবং এই মজুরিই তাদের একমাত্র অবলম্বন। এমতাবস্থায় তারা যদি পরিশ্রম করে ন্যায্য মজুরি না পায় কিংবা প্রয়োজন অপেক্ষা কম পায় অথবা নির্দিষ্ট পারিশ্রমিক সময়মত না পায়, তবে তাদের দুঃখের কোন অন্ত থাকে না। দুঃখ ও হতাশায় তাদের হৃদয়-মন চূর্ণ ও ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। এমনকি তাদের অপরিহার্য প্রয়োজন পূরণ না হওয়ার কারণে জীবন ও সমাজের প্রতি তাদের মন বীতশ্রদ্ধ ও বিতৃষ্ণ হয়ে উঠে এবং নিজেদের জীবন সম্পর্কে নৈরাশ্যের ভাব সৃষ্টি হয়। আর এটিই স্বাভাবিক। এই সব অচলাবস্থার সমাধানকল্পে শ্রমিকদের মজুরি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রয়েছে স্পষ্ট ঘোষণা:

‘শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।

অপর এক হাদীসে আছে, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অভিযোগ উত্থাপন করবেন। তন্মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি হচ্ছে, যেই ব্যক্তি কাকে মজুর হিসেবে খাটাইয়া তার দ্বারা পূর্ণ কাজ আদায় করা সত্ত্বেও শ্রমিকের মজুরী দেয় না।

রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, শ্রমিকের পারিশ্রমিক ও ঋণ পরিশোধ নিয়ে ধনী ব্যক্তিদের টালবাহানা করা যুলুম; শ্রমের ব্যাপারে শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন করে লওয়া বাঞ্ছনীয়। চুক্তি মুতাবিক শ্রমিক থেকে কাজ উসূল করে লওয়ার পূর্ণ অধিকার মালিকের থাকবে। এই ক্ষেত্রে কোন শৈথিল্য ও উদাসীনতা গ্রহণযোগ্য হবে না।

শ্রমিকের অধিকার কর্তব্য

ইসলাম যেমনিভাবে শ্রমিক মালিকদের ওপর বিভিন্ন দায়িত্ব-কর্তব্য ও বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে, তেমনিভাবে শ্রমিক ও মজুরদের ওপরও বিভিন্ন দায়িত্ব-কর্তব্য আরোপ করেছে। কারণ সুসম্পর্ক কোন দিনই একতরফাভাবে কায়েম হতে পারে না। এর জন্য উভয় পক্ষের সদিচ্ছার প্রয়োজন। পারস্পরিক সমঝোতা ব্যতিরেকে তা কোনক্রমেই সম্ভব হতে পারে না। ইসলামের দৃষ্টিতে একজন শ্রমিক নিজের ওপর মালিকের কাজের দায়িত্ব নিয়ে এমন এক নৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয় যে, এর পর সে এই কাজ শুধু পেটের জন্য করে না। বরং করবে আখিরাতের সফলতার আশায়। কেননা চুক্তি পূর্ণ করার ব্যাপারে কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে,

وَاَوْفُوْا بِالْعَهْدِ١ۚ اِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْـُٔوْلًا۰۰۳۴

‘তোমরা প্রতিশ্রুতি পালন করবে। প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।[13]

শ্রমিকের দায়িত্ব হচ্ছে চুক্তি মুতাবিক মালিকের দেওয়া যিম্মাদারী অত্যন্ত আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার সহিত সম্পাদন করা। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে:

اِنَّ خَيْرَ مَنِ اسْتَاْجَرْتَ الْقَوِيُّ الْاَمِيْنُ۰۰۲۶

‘মজুর হিসেবে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে শক্তিশালী, বিশ্বস্ত।[14]

মজুর বা শ্রমিক দায়িত্ব গ্রহণের পর কাজে কোনরূপ গাফিলতি করতে পারবে না। ইসলামের দৃষ্টিতে এ এক মারাত্মক অপরাধ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

وَيْلٌ لِّلْمُطَفِّفِيْنَۙ۰۰۱ الَّذِيْنَ اِذَا اكْتَالُوْا عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُوْنَٞۖ۰۰۲ وَاِذَا كَالُوْهُمْ اَوْ وَّزَنُوْهُمْ يُخْسِرُوْنَؕ۰۰۳

‘মন্দ পরিণাম তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়, যারা লোকের নিকট থেকে মাপিয়া লওয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে এবং যখন তাদের জন্য মাপিয়া অথবা ওযন করে দেয়, তখন কম দেয়।[15]

মুফাসসিরগণের মতে এই আয়াতের মধ্যে মাপে কম-বেশি করার ভাবার্থে ওইসব মজুরও শামিল করা হয়, যারা নির্ধারিত পারিশ্রমিক পুরোপুরি উসূল করে এবং কাজে গাফিলতি প্রদর্শন করে।

যেই কাজ যেভাবে করা উচিত সেই কাজ সেইভাবে আঞ্জাম দেওয়া শ্রমিকের দায়িত্ব। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন,

‘যখন কোন বান্দা কাজ করে তখন আল্ল­াহ তাআলা চান সে যেন সেই কাজ যেইভাবে করা দরকার ঠিক সেই ভাবেই আঞ্জাম দেয়।

যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলা এবং নিজ মালিকের হক আদায় করতে থাকে সে ইসলামের দৃষ্টিতে দ্বিগুণ সওয়াবের অধিকারী হবে। এ প্রসঙ্গে নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তিন প্রকারের লোকদেরকে দ্বিগুণ সওয়াব দেওয়া হবে। তাদের মধ্যে একজন সেই ব্যক্তি যে নিজের মালিকের হক আদায় করে এবং আল্লাহর হকও আদায় করে।

যেভাবে শ্রমিকের ওপর কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে এমনিভাবে তার কিছু অধিকারও রয়েছে। ইসলাম শ্রমিকের অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করেছে এবং এর জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ঘোষণা করেছে। এ ব্যাপারে ইসলামের প্রথম কথা হল শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি দিতে হবে। কোনরূপ টালবাহানা করা যাবে না। তার প্রতি তার ক্ষমতার অধিক কোন দায়িত্ব চাপানও যাবে না। শ্রমিক সমপ্রদায় উৎপাদনে শরীক থাকলেও মুনাফায় তাদেরকে অংশীদার করা হয় না। কিন্তু ইসলামী ব্যবস্থায় লাভের মধ্যেও তাদেরকে অংশীদার করার বিধান রয়েছে। রাসুলুল্লাহহ (সা.) বলেন,

‘শ্রমিকদেরকে তাদের শ্রমার্জিত সম্পদ (লভ্যাংশ) থেকেও অংশ দেবে। কারণ আল্লাহর মজুরকে বঞ্চিত করা যায় না।

লেখক: সম্পাদক, মাসিক আত-তাওহীদ

[1] আল-বায়হাকী, আস-সুনান, খ. ২, পৃ. ২৪

[2] হাকিম, মুসতাদারাক, খ. ২, পৃ. ১২

[3] তাবারানী, আল-মু’জামুল আওসাত, দারুল হারামাইন, কায়রো, মিসর, খ. ৮, পৃ. ৩৮০, হাদীস: ৮৯৩৪

[4] আবু দাউদ, আস-সুনান, আল-মাকতাবাতুল আসরিয়া, বয়রুত, লেবনান, খ. ২, পৃ. ১২০Ñ১২১, হাদীস: ১৬৪১

[5] মুসলিম, আস-সহীহ, খ. ২., পৃ. ৭২০

[6] আবু দাউদ, প্রাগুক্ত, খ. ২, পৃ. ১২১, হাদীস: ১৬৪৩

[7] আল-বুখারী, আস-সহীহ, খ. ২, পৃ. ৭৮৯; আল-বায়হাকী, আস-সুনান, খ. ২, পৃ. ৪৫৮-৯

[8] (ক) ইবনে হাজর আল-আসকলানী, ফাতহুল বারী শরহু সহীহ আল-বুখারী, খ. ৪, পৃ. ৩০৬; (খ) আত-তারগীব ওয়াত তারহীব [স], খ. ২, পৃ. ১৪০

[9] ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, দারু ইয়াহইয়ায়িল কুতুব আল-আরাবিয়া, বয়রুত, লেবনান, খ. ২, পৃ. ১২১৬, হাদীস: ৩৬৯০

[10] দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, পৃ. ৪৯৬-৪৯৭

[11] আত-তিরমিযী, আস-সুনান, মাকতাবাতু ওয়া মাতবাআতু মুস্তাফা আলবাবী, হলব, মিসর (১৩৯৫ হি. = ১৯৭৫ খ্রি.), খ. ৪, পৃ. ৩৩৬, হাদীস: ১৯৪৯

[12] আল-কুরআন, সূরা আল-কাসাস, ২৮:২৬

[13] আল-কুরআন, সূরা আল-ইসরা, ১৭:৩৪

[14] আল-কুরআন, সূরা আল-কাসাস, ২৮:২৬

[15] আল-কুরআন, সূরা আল-মুতাফ্ফিফীন, ৮৩:১-৩

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ