রোযার আধুনিক মাসআলা: শরয়ী সমাধান
তত্ত্বাবধানে: আল্লামা মুফতী হাফেজ আহমদুল্লাহ (দা. বা.)
আল্লামা মুফতী মুজাফ্ফর আহমদ (রহ.)
সংকলন: মুফতী মাওলানা মিজান সিরাজ
রোযা কখন কার ওপর ফরয
১. মাসআলা: রামাযান মাসের রোযা রাখা ফরজে আইন, যা কিতাবুল্লাহ, সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং ইজমায়ে উম্মতের দ্বারা সু-প্রমাণিত। রামাযানের রোযা ফরয হওয়ার বিষয়টি অস্বীকারকারী কাফের ও ইসলামের গণ্ডি থেকে বহির্ভূত হবে। বিনা ওজরে রামাযানের রোযা পরিত্যাগকারী ফাসিক ও কবিরা গুনাহে লিপ্ত ভয়ানক গোনাহগার এবং চরম হতভাগ্য বলে গণ্য হবে। এমনকি আখিরাতে তাকে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে।[1]
রোযা কাকে বলা হয়
২. মাসআলা: সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযার নিয়তে সকল প্রকার আহার-পানাহার ও জৈবিক চাহিদা পূরণ করা থেকে বিরত থাকাকে শরীয়তের পরিভাষায় রোযা বলা হয়।[2]
রোযা কার ওপর ফরয
৩. মাসআলা: রামাযানের রোযা প্রত্যেক মুসলিম, আকেল, বালেগ (প্রাপ্তবয়স্ক) ও সুস্থ নর-নারীর ওপর রাখা ফরয। সুতরাং কাফির, পাগল ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়ের ওপর রোযা রাখা ফরয নয়।[3]
রোযা রাখার নিষিদ্ধ দিনসমূহ
৪. মাসআলা: বছরে মোট পাঁচ দিন রোযা রাখা নিষিদ্ধ। এ পাঁচ দিন আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য মেহমানদারির দিন। তাই এই পাঁচ দিন রোযা রাখা হারাম। পাঁচ দিন যথা: ১. ঈদুল ফিতরের দিন। ২. কুরবানির দিন। ৩. ঈদুল আযহার পরবর্তী তিন দিন তথা ১১, ১২ ও ১৩ জিলহজের দিন।[4]
অসুস্থ ও মুসাফির ব্যক্তির ওপর রোযা
৫. মাসআলা: যে রোগের দ্বারা জান বা অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, এমন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ওপর রোযা রাখা আবশ্যক নয়। এমনিভাবে শরয়ি সফরে থাকাবস্থায় মুসাফির ব্যক্তির ওপরও রোযা আবশ্যক নয়। হ্যাঁ, তবে অসুস্থ ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার পর ও মুসাফির ব্যক্তি সফর থেকে ফেরার পর উক্ত রোযা গুলোর কাযা করতে হবে। অতএব সফরে যদি কষ্ট না হয়, তাহলে মুসাফির ব্যক্তির জন্য রোযা রাখা উত্তম। যাতে সে কুরআন-হাদিসে বর্ণিত ফযীলতের অধিকারী হতে পারে এবং পরবর্তীতে ক্বাযা রোযা রাখার কষ্ট অনুভব করতে না হয়।[5]
মহিলাদের ঋতুস্রাব অবস্থায় রোযা
৬. মাসআলা: মহিলাদের হায়েয (ঋতুস্রাব) এবং নিফাস অবস্থায় রোযা ছেড়ে দিতে হবে। আর যদি রামাযান মাসের মধ্যে তারা পাক পবিত্র হয়ে যায়, তাহলে অবশিষ্ট রোযাগুলো তাদেরকে রাখতে হবে এবং রামাযানের পর ছুটে যাওয়া রোযাগুলোর কাযা করে নিতে হবে।[6]
পাগলামী রোযা ভাঙ্গার প্রতিবন্ধক নয়
৭. পাগলামির সংজ্ঞা: পাগলামি বলা হয় বিবেক-বুদ্ধি স্বাভাবিক অবস্থা থেকে লোপ পাওয়া ও মস্তিস্কে বিকৃতি ঘটা অথবা কোন ব্যাধির কারণে এমনভাবে বিবেক-বুদ্ধিতে ত্রুটি দেখা দেওয়া যা বুদ্ধি-বিবেচনা সম্মত কথা ও কাজ করতে অধিকাংশ সময় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
পাগলামির হুকুম: পাগলামি রোযা ভঙ্গের গ্রহণযোগ্য প্রতিবন্ধক নয়। অতএব কেউ যদি সুস্থ অবস্থায় রোযা রাখে। অতঃপর পাগল হয়ে যায়, তাহলে সে পাগল অবস্থায় কিছু পানাহার বা স্ত্রী সহবাস করলে, তার রোযা নষ্ট হয়ে যাবে।[7]
রোযা অবস্থায় মস্তিস্ক অপারেশন করা
৮. মাসআলা: রোযা অবস্থায় মস্তিস্ক অপারেশন করলে রোযা ভাঙ্গবে না, যদিও মস্তিস্কে কোন তরল কিংবা শক্ত ওষুধ ব্যবহার করা হয়। কেননা মস্তিস্ক থেকে গলা পর্যন্ত সরাসরি কোন নালি পথ নেই। তাই মস্তিস্কে কোন কিছু দিলে তা গলায় পৌঁছে না।[8]
রোযা অবস্থায় চোখে ওষুধ বা ড্রপ ব্যবহার
৯. মাসআলা: চোখে ড্রপ, ওষুধ, সুরমা বা মলম ইত্যাদি ব্যবহার করলে রোযা নষ্ট হবে না। যদিও এগুলোর স্বাদ গলায় উপলদ্ধি হয়। কারণ চোখে ওষুধ ইত্যাদি দিলে রোযা না ভাঙ্গার বিষয়টি হাদীস ও ফিকাহ শাস্ত্রের মূলনীতি দ্বারা প্রমাণিত।[9]
মুখে ওষুধ ব্যবহার করা
১০. মাসআলা: মুখের অভ্যন্তরে কোন ওষুধ ব্যবহার করে তা গিলে ফেললে রোযা ভেঙে যাবে। চাই তা যত স্বল্প পরিমানই হোক না কেন। অতএব কেউ যদি রামাযানে ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু গিলে ফেলে, তাহলে তার ওপর উক্ত রোযার কাযা-কাফ্ফারা উভয়টা ওয়াজিব হবে।[10]
রোযা অবস্থায় অক্সিজেন ব্যবহার
১১. মাসআলা: নাকে অক্সিজেন নিলে রোযা ভেঙে যাবে। যেহেতু শরীরের ভিতর বাহির থেকে কোন কিছু প্রবেশ করার যে চার নালি রয়েছে নাক তার মধ্যে অন্যতম।[11]
রোযা অবস্থায় ওষুধ সেবন করে ঋতুস্রাব বন্ধ রাখা
১২. মাসআলা: মহিলাদের ঋতু আসা একটি স্বভাবজাত বিষয়। সৃষ্টিগতভাবে ঋতুস্রাব চলাকালীন সময় শরীয়ত কর্তৃক তাদেরকে মাযুর গণ্য করে তাদের থেকে নামায-রোযা ইত্যাদির দায়িত্ব উঠিয়ে নিয়েছেন। সনাতন ও আধুনিক চিকিৎসার দৃষ্টিতেও নিয়মিত ঋতুস্রাব মহিলাদের সুস্থতার প্রমাণ বহন করে। এর ব্যতিক্রম ঘটলে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, এমন কাজ থেকে বিরত থাকা চাই। তারপরেও যদি কোন মহিলা ওষুধ সেবনের মাধ্যমে ঋতুস্রাব বন্ধ করে রোযা আদায় করে, তাহলে কোন গোনাহ হবে না, বরং তার রোযা শুদ্ধ হয়ে যাবে।[12]
রোযা রেখে রক্ত দেওয়া ও নেওয়া
১৩. মাসআলা: শরীরে রক্ত নিলে বা নিজ শরীর থেকে কাউকে রক্তদান করলে কোন অবস্থাতেই রোযা নষ্ট হবে না। কারণ রক্ত দেওয়ার কারণে কোন বস্তু দেহের অভ্যন্তরে ঢুকেনি, তাই তাতে রোযা নষ্ট হওয়ার প্রশ্নই আসে না। আর রক্ত নিলে যেহেতু উক্ত রক্ত শরীরের উল্লেখ যোগ্য চার নালি হতে কোন নালি দিয়ে প্রবেশ করা হয় না, বরং শরীরের অন্যান্য ছোট ছিদ্রের মাধ্যমে প্রবেশ করা হয়ে থাকে। সুতরাং রোযাবস্থায় কারো শরীরে রক্ত দান করলে বা নিজে রক্ত গ্রহণ করলে রোযা নষ্ট হবে না।[13]
রোযা অবস্থায় অ্যান্ডোসকপি করার হুকুম
১৪. মাসআলা: অ্যান্ডোসকপি বলা হয়, চিকন একটি পাইপ মুখ দিয়ে ঢুকিয়ে পাকস্থলিতে পৌঁছানো। পাইপটির মাথায় বাল্ব জাতীয় একটি বস্তু থাকে। পাইপটির অপর প্রান্তে থাকা মনিটরের মাধ্যমে রোগীর পেটের অবস্থা নির্ণয় করা হয়। একে ‘অ্যান্ডোসকপি’ বলা হয়। সাধারণত অ্যান্ডোসকপিতে নল বা বাল্বের সাথে কোন মেডিসিন লাগানো থাকে না। তাই এন্ডোসকপি করালে রোযা ভাঙ্গবে না। তবে যদি নল বা বাল্বে মেডিসিন লাগানো হয়, তাহলে রোযা ভেঙে যাবে। তেমনিভাবে টেস্টের প্রয়োজনে কখনও পাইপের সাহায্যে ভেতরে যদি পানি ছিটানো হয়। তখনও রোযা ভেঙে যাবে।[14]
রোযা অবস্থায় ইনজেকশন নেওয়ার হুকুম
১৫. মাসআলা: ইনজেকশন নিলে রোযা নষ্ট হবে না। চাই তা গোস্তে নেওয়া হোক বা রগে। কারণ ইনজেকশনের সাহায্যে দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশকৃত ওষুধ গোস্ত বা রগের মাধ্যমেই প্রবেশ করানো হয়ে থাকে, যা অস্বাভাবিক প্রবেশ পথ, তাই এটি রোযা ভঙ্গের গ্রহণযোগ্য কারণ নয়।[15]
এনজিওগ্রাম করার হুকুম
১৬. মাসআলা: এনজিওগ্রাম করালে রোযা নষ্ট হবে না।
এনজিওগ্রাম বলা হয়, হার্টের রক্তনালী ব্লক হয়ে গেলে উরুর গোড়ার দিকে কেটে একটি বিশেষ রগের ভিতর দিয়ে (যা হার্ট পর্যন্ত পৌঁছে) ক্যাথেটার ঢুকিয়ে পরীক্ষা করাকে। উক্ত ক্যাথেটারে কোন মেডিসিন লাগানো থাকলেও যেহেতু তা রোযা ভঙ্গের কোন গ্রহণযোগ্য রাস্তা দিয়ে গ্রহণযোগ্য স্থানে পৌঁছায় না। তাই তার দ্বারা রোযা ভঙ্গ হবে না।[16]
রোযা অবস্থায় এমআর করার হুকুম
১৭. মাসআলা: এমআর করলে রোযা ভেঙে যাবে। এমআর মাসিক নিয়মিতকরণ। গর্ভধারণের পাঁচ থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে যোনিদ্বার দিয়ে জরায়ুতে এমআর সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে জীবিত কিংবা মৃত ভ্রূণ বের করে নিয়ে আসাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এমআর বলে। গর্ভধারণের কারণে ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়, এমআরের কারণে ঋতুস্রাব নিয়মিত হয়ে যায় বিধায় এ পদ্ধতিকে সংক্ষেপে এমআর বলে। এমআর করার পর যেই মাসিক স্রাব নির্গত হয়, তা যদি তিন দিন বা তার বেশি স্থায়ী হয়, তখন তা হায়েয বা মাসিক স্রাব হিসেবে গণ্য হবে। আর যদি তার চেয়ে কম হয়, তাহলে তা ইস্তেহাজা হিসেবে গণ্য হবে। সুতরাং এমআর করার পর যদি তিন দিন বা তার বেশি মাসিক স্রাব স্থায়িত্ব হয়, তাহলে রোযা ভেঙে যাবে।[17]
নাকে ওষুধ বা ড্রপ ব্যবহার
১৮. মাসআলা: নাকে ড্রপ, ওষুধ বা পানি ইত্যাদি দিয়ে ভেতরে টেনে নিলে রোযা ভেঙে যাবে। কারণ নাক রোযা ভেঙে যাওয়ার গ্রহণযোগ্য রাস্তা। নাকে ড্রপ ইত্যাদি নিলে তা গলা পর্যন্ত পৌঁছে যায়।[18]
রোযা অবস্থায় ইনহেলার ব্যবহার
১৯. মাসআলা: সালবুটামল, ইনহেলার ব্যবহার করলে রোযা ভেঙে যাবে। শ্বাসকষ্ট দূর করার জন্য ওষুধটি মুখের ভেতর ভাগে সেপ্র করা হয়। এতে যে জায়গায় শ্বাসরুদ্ধ হয় সেই জায়গাটি প্রশস্ত হয়ে যায়। ফলে শ্বাস চলাচলে আর কষ্ট থাকে না। উল্লেখ্য ওষুধটি যদিও সেপ্রর সময় গ্যাসের মত দেখা যায়। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে তা দেহ বিশিষ্ট তরল ওষুধ। অতএব মুখের অভ্যন্তরে সেপ্র করার দ্বারা রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। হ্যাঁ, মুখে সেপ্র করার পর না গিলে যদি থুথু দিয়ে ফেলে দেওয়া হয় তাহলে রোযা ভঙ্গ হবে না। এভাবে কাজ চললে বিষয়টি অতি সহজ হয়ে যাবে। এতে শ্বাস কষ্ট থেকে রেহাই পাওয়ার পাশাপাশি রোযা ভঙ্গ হবে না। অনেককে বলতে শুনা যায় যে, ইনহেলার অতি প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়, তাই এতে রোযা ভঙ্গ হবে না। তাদের এ উক্তিটি একেবারে হাস্যকর। কেননা কেহ যদি ক্ষুদার তাড়নায় মৃত্যু মুখে পতিত হয়ে অতি প্রয়োজনে কিছু খেয়ে ফেলে তাহলে অতি প্রয়োজনে খাওয়ার কারণে তার রোযা কি ভঙ্গ হবে না? অবশ্যই ভেঙে যাবে। সুতরাং ইনহেলার অতি প্রয়োজনে ব্যবহার করলেও তার দ্বারা রোযা ভেঙে যাবে এবং পরে তার কাযা দিতে হবে।[19]
রোযা অবস্থায় ইনহেলার ব্যবহারের নিয়ম
২০. মাসআলা: কোন কোন চিকিৎসক বলেন, সাহরীতে এক ডোজ ইনহেলার নেওয়ার পর সাধারণত ইফতার পর্যন্ত আর ইনহেলার ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। তাই এভাবে ইনহেলার ব্যবহার করে রোযা রাখা চাই। হ্যাঁ, কারো যদি বক্ষব্যাধি এমন মারাত্মক আকার ধারণ করে যে, ইনহেলার নেওয়া ব্যতীত ইফতার পর্যন্ত অপেক্ষা করা দায় হয়ে পড়ে তাহলে তাদের ক্ষেত্রে শরিয়তে এ সুযোগ রয়েছে যে, তারা প্রয়োজনভেদে ইনহেলার ব্যবহার করবে ও পরবর্তীতে রোযা কাযা করে নিবে। আর কাযা করা সম্ভব না হলে ফিদিয়া আদায় করবে। আর যদি ইনহেলারের বিকল্প কোন ইনজেকশন থাকে, তাহলে তখন ইনজেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করবে। কেননা রোযা অবস্থায় ইনজেকশন নিলে রোযা ভাঙ্গবে না।[20]
রোযা অবস্থায় নাইট্রোগ্লিসারিন ব্যবহার
২১. মাসআলা: নাইট্রোগ্লিসারিন ব্যবহার করলে রোযা ভেঙে যাবে। এ্যারাসল জাতীয় একটি ওষুধ যা হার্টের রোগীদের এভাবে ব্যবহার করানো হয় যে, ২/৩ ফোটা ওষুধ জিহ্বার নিচে দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখা হয়। এতে সেই ওষুধটি যদিও শিরার মাধ্যমে রক্তের সাথে মিশে যায়। তারপরেও ওষুধের কিছু অংশ গলায় পৌঁছে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। তাই তাতে রোযা ভেঙে যাবে। আর এর মধ্যেই রয়েছে সতর্কতা। তবে যদি ওষুধটি ব্যবহারের পর না গিলে থুথু দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়, তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না। কারণ, না গিলে শুধু শিরার মাধ্যমে কিছু ঢুকলে রোযা ভাঙ্গে না।[21]
রোযা অবস্থায় স্যালাইন ব্যবহার
২২. মাসআলা: স্যালাইন নিলে রোযা ভাঙ্গবে না। কারণ, স্যালাইন নেয়া হয় রগে। আর রগ রোযা ভঙ্গের গ্রহণযোগ্য কোন ছিদ্র ও রাস্তা নয়। তবে রোযার দুর্বলতা দূর করার উদ্দেশ্যে স্যালাইন নেওয়া মাকরুহ।[22]
রোযা অবস্থায় ইনসুলিন ব্যবহার
২৩. মাসআলা: রোযা অবস্থায় ডায়াবেটিস রোগী ইনসুলিন নিলে রোযা নষ্ট হবে না। কারণ ইনসুলিন রোযা ভাঙ্গার গ্রহণযোগ্য রাস্তা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে না এবং গ্রহণযোগ্য কোন খালি স্থানেও পৌছে না।[23]
রোযাবস্থায় প্রশ্রাবের রাস্তায় ওষুধ ব্যবহার
২৪. মাসআলা: পুরুষের প্রস্রাবের রাস্তা ও মহিলাদের যোনিদ্বারে ওষুধ ইত্যাদি ব্যবহার করলে এতে রোযা নষ্ট হবে না। তেমনিভাবে প্রশ্রাবের রাস্তা দিয়ে বা যোনিদ্বার দিয়ে কোন ওষুধ ভেতরে প্রবেশ করালেও রোযা ভঙ্গ হবে না। কেননা সেখান থেকে এমন কোন স্থানে তা পৌঁছে না যেখানে পৌছলে রোযা ভেঙে যায়। বরং মুত্রনালী বা জরায়ু তথা গর্ভাশয়ে পৌছে মাত্র। আর মুত্রনালী বা গর্ভাশয় রোযা ভঙ্গের গ্রহণযোগ্য খালি জায়গা নয়। তাই রোযা নষ্ট হবে না।[24]
রোযা অবস্থায় কপার-টি করা
২৫. মাসআলা: কপার-টি করলে রোযা ভাঙ্গবে না। কপার-টি বলা হয়, যোনিদ্বারে প্লাষ্টিক ফিট করা। যাতে সহবাসের সময় বীর্যজরায়ুতে পৌছতে না পারে। এমন করলে রোযা ভাঙ্গবে না। কারণ, যোনিদ্বার রোযা নষ্ট হওয়ার গ্রহণযোগ্য রাস্তা নয়। তবে কপার-টি লাগিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে সহবাস করলে রোযা ভেঙে যাবে এবং কাযা ও কাফ্ফারা উভয়টিই ওয়াজিব হবে।[25]
রোযা অবস্থায় মলদ্বারে ঢুস ব্যবহার
২৬. মাসআলা: ঢুস নিলে রোযা ভেঙে যাবে। কারণ ঢুস মলদ্বারের মাধ্যমে ভেতরে প্রবেশ করে। আর মলদ্বার রোযা ভাঙ্গার গ্রহণযোগ্য রাস্তা ও পথ।[26]
রোযা অবস্থায় প্রক্টোসকপি করা
২৭. মাসআলা: প্রক্টোসকপি করলে রোযা ভেঙে যাবে। পাইলস, ফিশার, ফিস্টুলা, অর্শ, বুটি ও হারিশ ইত্যাদি রোগের পরিক্ষাকে প্রক্টোসকপি বলে। মলদ্বার দিয়ে নল ঢুকিয়ে এ পরীক্ষা করা হয়। যদিও নলটি পুরাপুরি ভেতরে ঢোকে না কিন্তু যাতে ব্যাথা না পায় সেজন্য নলের মধ্যে গ্লি-সারিন জাতীয় পিচ্ছিল কোন বস্তু ব্যবহার করা হয়। ডাক্তারদের মতানুসারে যদিও সেই পিচ্ছিল বস্তুটি নলের সাথে চিমটে থাকে ও নলের সাথেই বেরিয়ে আসে ভেতরে থাকে না। আর থাকলেও তা পরবর্তীতে বেরিয়ে আসে, শরীর তা চোষে না তা ছাড়া সেই বস্তুটি ভেজা হওয়ার কারণে এবং কিছু সময় ভেতরে থাকার দরুণ রোযা ভেঙে যাবে। আর এর মধ্যেই রয়েছে সতর্কতা।[27]
রোযা অবস্থায় ল্যাপারসকপি বায়োপসি
২৮. মাসআলা: পেট ছিদ্র করে সিক জাতীয় একটি মেশিন ঢুকিয়ে পেটের ভেতরের কোন অংশ, গোস্ত ইত্যাদি পরীক্ষার জন্য বের করে আনাকে ল্যাপরসকপি বলে। এমন করলে এতে রোযা নষ্ট হবে না। কারণ রোযা ভাঙ্গার জন্য রোযা ভঙ্গকারী বস্তু শরীরের ভেতরে পরিপুর্ণভাবে প্রবেশ করা ও প্রবেশের পর সাথে সাথে বের না হয়ে ভেতরে ততক্ষণ সময় পর্যন্ত স্থায়ী থাকা আবশ্যক, যতক্ষণ ভেতরে থাকলে এ বস্তু বা তার অংশ বিশেষ হজম হয়ে যায়, এখানে এর কোনটি পাওয়া যায়নি। তবে সিকের মধ্যে কোন প্রকার মেডিসিন লাগানো থাকলে এবং তা মলদ্বার পর্যন্ত নাড়ি ভুড়ির যে কোন জায়গায় পৌঁছলে রোযা ভেঙে যাবে।[28]
রোযা অবস্থায় সিরোদকার অপারেশন
২৯. মাসআলা: সিরোদকার অপারেশন করলে রোযা ভাঙ্গবে না। সিরোদকার অপারেশন হলো, অকাল গর্ভপাতের আশংকা থাকলে জরায়ুর মুখের চতুর্দিক সেলাই করে মুখকে আটকে রাখা। এতে অকাল গর্ভপাত রোধ হয়। এর মধ্যে যেহেতু রোযা ভাঙ্গার মতো কোন কিছু পাওয়া যায় না। তাই এর কারণে রোযা নষ্ট হবে না। উল্লেখ্য যে, সেলাই করার সময় সাধারণত কিছু রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে। এতেও রোযা ভাঙ্গবে না। কেননা রক্ত বের হওয়া রোযা ভঙ্গের কোন কারণ নয়।[29]
রোযা অবস্থায় ডিএন্ডসি করা
৩০. মাসআলা: ডিএন্ডসি করলে রোযা ভেঙে যাবে। গর্ভধারনের আট সপ্তাহ থেকে দশ সপ্তাহের মধ্যে ডিলেটর এর মাধ্যমে জীবিত কিংবা মৃত বাচ্চা বের করে নিয়ে আসাকে সংক্ষেপে ডিএন্ডসি বলে। যেহেতু গর্ভধারনের দুই মাসের মধ্যে সাধারণত সন্তানের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ভালো ভাবে সৃষ্টি হয় না। কেননা, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সৃষ্টি হওয়ার জন্য কমপক্ষে গর্ভধারনের পর থেকে একশত বিশ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে হবে। এমতাবস্থায় কোন ব্যক্তি যদি অসুস্থতার কারণে বা ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যাথার কারণে গর্ভপাত করা হয়, অত:পর যদি রক্তস্্রাব হয়, তাহলে ইহা নিফাস হিসেবে গণ্য হবে না। বরং উক্ত স্্রাব যদি তিন দিন বা ততোধিক স্থায়ী হয়, তখন তা হায়েয হিসেবে গণ্য হবে। আর যদি তিন দিন থেকে কম হয়, তখন তা ইস্তেহাজা হিসেবে গণ্য হবে। সুতরাং যদি হায়েয হয়ে থাকে, তখন রোযা সহিহ হবে না। আর যদি ইসতিহাযা হয়, তখন তার রোযা নষ্ট হবে না, বরং শুদ্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং এভাবে গর্ভপাতের পর সঙ্গে সঙ্গে রোযা নষ্ট হবে না, বরং তাকে রোযা রাখতে হবে।[30]
[1] (ক) আল-কাসানী, বাদায়িউস সানাই ফী তারতীবিশ শারায়ি, এইচএম সাঈদ কোম্পানি, করাচি, পাকিস্তান, খ. ২, পৃ. ৭৫; (খ) আল-মারগীনানী, আল-হিদায়া ফী শরহি বিদায়াতুল মুবতাদী, দারুল মাআরিফ, বয়রুত, লেবনান, খ. ১, পৃ. ২১১
[2] (ক) ইবনে আবিদীন, রদ্দুল মুহতার আলাদ দুররিল মুখতার = হাশিয়াতু ইবনে আবিদীন = ফতোয়ায়ে শামী, এইচএম সাঈদ কোম্পানি, করাচি, পাকিস্তান, খ. ২, পৃ. ৩৭১; (খ) মুফতী রশীদ আহমদ, আহসানুল ফতোয়া, এইচএম সায়ীদ কোম্পানি, করাচি, পাকিস্তান, খ. ৪, পৃ. ৭০
[3] (ক) মোল্লা নিযাম উদ্দীন, আল-ফত্ওয়ালা আল-হিন্দিয়া = ফতওয়ায়ে আলমগীরী, খ. ১, পৃ. ১৯৫; (খ) আবু দাউদ, আস-সুনান, খ. ১, পৃ. ৭০; (গ) ইবনু নুজাইম, আল-বাহরুর রায়িক শরহু কানযিদ দাকায়িক, খ. ২, পৃ. ২৫৭; (ঘ) আলিম ইবনুল আলা, আল-ফাতাওয়া আত-তাতারখানিয়া, খ. ২, পৃ. ৩৪৫
[4] আত-তাবরীযী, মিশকাতুল মাসাবীহ, খ. ১, পৃ. ১৭৩
[5] (ক) ইবনে আবিদীন, প্রাগুক্ত, খ. ২, পৃ. ৪২১; (খ) আল-মারগীনানী, প্রাগুক্ত, খ. ১, পৃ. ২১১; (গ) আলিম ইবনুল আলা, আল-ফাতাওয়া আত-তাতারখানিয়া, খ. ২, পৃ. ৩৮৩
[6] (ক) আল-কাসানী, প্রাগুক্ত, খ. ২, পৃ. ২৩৬; (খ) আল-মারগীনানী, প্রাগুক্ত, খ. ১, পৃ. ২২৪; (গ) মোল্লা নিযাম উদ্দীন, আল-ফত্ওয়ালা আল-হিন্দিয়া, খ. ১, পৃ. ২০৭; (ঘ) ইবনু নুজাইম, প্রাগুক্ত, খ. ২, পৃ. ২৫৭
[7] ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান, পৃ. ৩২০
[8] (ক) ইবনে আবিদীন, প্রাগুক্ত, খ. ২, পৃ. ৩৯৫; (খ) মোল্লা নিযাম উদ্দীন, আল-ফত্ওয়ালা আল-হিন্দিয়া, খ. ১, পৃ. ২০৩
[9] (ক) জাদীদ ফিকহী মাসায়িল, খ. ১, পৃ. ১৮৩; (খ) আলিম ইবনুল আলা, আল-ফাতাওয়া আত-তাতারখানিয়া, খ. ২, পৃ. ৩৬৬
[10] ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান, পৃ. ২২৩
[11] (ক) ইবনে আবিদীন, প্রাগুক্ত, খ. ২, পৃ. ২০০; (খ) খুলাসাতুল ফাতাওয়া, খ. ১, পৃ. ২৫৩
[12] ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান, পৃ. ৩২৫
[13] (ক) আল-কাসানী, প্রাগুক্ত, খ. ২, পৃ. ৯২; (খ) ইবনে আবিদীন, প্রাগুক্ত, খ. ৩, পৃ. ৪০০; (গ) মোল্লা নিযাম উদ্দীন, আল-ফত্ওয়ালা আল-হিন্দিয়া, খ. ১, পৃ. ২০০
[14] (ক) জাদীদ ফিকহী মাসায়িল, খ. ১, পৃ. ১৮৬; (খ) ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান, পৃ. ৩২৪
[15] (ক) ইবনে আবিদীন, প্রাগুক্ত, খ. ২, পৃ. ৩৯৫; (খ) ইবনু নুজাইম, প্রাগুক্ত, খ. ২, পৃ. ২৭৮; (গ) আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল, খ. ৩, পৃ. ২১৪
[16] আল-মালাকাতুল ফিকহিয়া, পৃ. ১, খ. ১২৪
[17] ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান, পৃ. ৩২৮
[18] (ক) ইবনে আবিদীন, প্রাগুক্ত, খ. ২, পৃ. ২০০; (খ) খুলাসাতুল ফাতাওয়া, খ. ১, পৃ. ২৫৩
[19] (ক) ইবনে আবিদীন, প্রাগুক্ত, খ. ২, পৃ. ৩৯৫; (খ) ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান, পৃ. ৩২৫
[20] ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান, পৃ. ৩২৪
[21] ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান, পৃ. ৩২৫
[22] (ক) আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল, খ. ৩, পৃ. ২৮৮; (খ) ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান, পৃ. ৩২৭
[23] (ক) ইবনে আবিদীন, প্রাগুক্ত, খ. ৩, পৃ. ৩৬৭; (খ) ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান, পৃ. ৩২৭
[24] (ক) আল-মালাকাতুল ফিকহিয়া, পৃ. ১, খ. ১১৪-১১৫; (খ) ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান, পৃ. ৩২৭
[25] ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান, পৃ. ৩২৯
[26] (ক) ইবনে আবিদীন, প্রাগুক্ত, খ. ৩, পৃ. ৩৭৬; (খ) আল-মারগীনানী, প্রাগুক্ত, খ. ১, পৃ. ২২০
[27] ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান, পৃ. ৩৩০
[28] (ক) আল-মালাকাতুল ফিকহিয়া, পৃ. ১, খ. ১২৪Ñ১২৫; (খ) ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান, পৃ. ৩৩০
[29] ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান, পৃ. ৩২৯
[30] (ক) ইবনে আবিদীন, প্রাগুক্ত, খ. ১, পৃ. ৩০২; (খ) মুফতী রশীদ আহমদ, প্রাগুক্ত, খ. ২, পৃ. ৭১