জামেয়া ওয়েবসাইট

সোমবার-৭ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-১১ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৬শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পবিত্র রমযানের রোযার জরুরি মাসায়েল

পবিত্র রমযানের রোযার জরুরি মাসায়েল

পবিত্র রমযানের রোযার জরুরি মাসায়েল

মুফতি ইবরাহীম আনোয়ারী

 

ইফতার সাহরীর মাসায়েল

সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর কোনো কিছু খাওয়া বা পানাহারের মাধ্যমে রোযা ভেঙে দেওয়াকে শরীয়তের পরিভাষায় ইফতার বলা হয়। সূর্যাস্তের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর কোনো প্রকার বিলম্ব না করে দ্রুত ইফতার করে নেওয়া মুস্তাহাব। অকারণে বিলম্বে ইফতার করা মাকরুহ। ইফতারের তাৎপর্য ও গুরুত্ব সম্পর্কে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কয়েকটি হাদীস এখানে উল্লেখ করা হলো:

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ : «قَالَ اللهُ b: إِنَّ أَحَبَّ عِبَادِيْ إِلَيَّ أَعْجَلُهُمْ فِطْرًا».

‘হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ পাক বলেন, ‘আমার বান্দাদের মধ্যে আমার নিকট অধিকতর প্রিয় তাঁরাই যারা শীঘ্রই ইফতার করে।’’[1]

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ : «لَا يَزَالُ الدِّيْنُ ظَاهِرًا مَا عَجَّلَ النَّاسُ الْفِطْرَ لِأَنَّ الْيَهُوْدَ وَالنَّصَارَىٰ يُؤَخِّرُوْنَ».

‘হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দীন শক্তিশালী থাকবে যতোদিন লোক শীঘ্রই ইফতার করবে। কেননা ইহুদি ও খ্রিস্টানগণ বিলম্বে ইফতার করে।’’[2]

অপর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, ইফতার সামনে নিয়ে অপেক্ষা করাও মুস্তাহাব। ইফতারের পূর্বমুহূর্তে দুআ কবুল হয়। তাই ইফতারের পূর্বমুহূর্তে দুআর প্রতি বেশি বেশি মনোনিবেশ হওয়া চাই।

নবী করীম (সা.) বলেন, ‘৩ ব্যক্তির দুআ কোনো সময় বৃথা যায় না। তাঁদের মধ্যে ইফতারের সময় রোযাদারের দুআ।’ (মিশকাত শরীফ, ১/১৭৩)

রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো রোযাদারকে ইফতার করানোর দ্বারা  সেই পরিমাণ সওয়াব পাওয়া যায়, যে পরিমাণ সাওয়াব রোযাদারের জন্য রোযার বিনিময় দেওয়া হয়ে থাকে। আর কোনো রোযাদারকে খানা খাওয়ানোর দ্বারা আরও বেশি সাওয়াব পাওয়া যায়। এই নেক আমলের দরূন আল্লাহ তাআলা হাউযে কাউসার থেকে পানি পান করা ও জান্নাতে প্রবেশ করানোর ওয়াদা করেছেন।’ (মিশকাত, ১/১৭৪)

রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রোযাদারকে ইফতার করাবে তার জীবনের সগীরা গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। সে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পাবে এবং তাকে সেই পরিমাণ সাওয়াব দেওয়া হবে যে পরিমাণ রোযাদার ব্যক্তি রোযা রাখার কারণে পেয়ে থাকে। তবে এতে রোযাদারের বিন্দুপরিমাণ সাওয়াবও হ্রাস করা হবে না।’ (মিশকাত, ১/১৭৩)

ইফতার সংক্রান্ত জরুরি মাসায়েল

যা দিয়ে ইফতার করা সুন্নত: খেজুর, দুধ, পানি ইত্যাদি দ্বারা ইফতার করা সুন্নত। তাছাড়া কোনো মিষ্টি জিনিস দ্বারাও ইফতার করা ভালো। ইফতার সামনে নিয়ে এ দুআ পড়বে:

يَا وَاسِعَ الْفَضْلِ اغْفِرْ لِيْ.

অর্থ: হে মহা অনুগ্রহশীল প্রভু! আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।

আবার নিম্নোক্ত দুআটিও পড়া যায়:

«اللَّهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ بِرَحْمَتِكَ الَّتِيْ وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ أَنْ تَغْفِرَ لِيْ».

অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার দরবারে আপনার সর্বময়বেষ্টিত রহমতের প্রার্থনা করছি যে, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।[3]

ইফতারের দুআ পড়ে ইফতার করা মুস্তাহাব। কেননা রাসূল (সা.) দুআ পড়ে ইফতার করতেন। বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত মুআয ইবনে যুহরা (রহ.) বলেন, রাসূল (সা.) যখন ইফতার করতেন তখন পড়তেন,

«اللَّهُمَّ لَكَ صُمْتُ، وَعَلَىٰ رِزْقِكَ أَفْطَرْتُ».

অর্থ: হে আল্লাহ আপনার উদ্দেশ্যেই রোযা রেখেছি এবং আপনার দেওয়া রিযিক দ্বারাই ইফতার করছি। সুতরাং প্রত্যেক রোযাদারের জন্য ইফতারের সময় উল্লেখিত দুআটি পড়া উত্তম।[4]

সূর্য অস্তমিত হওয়ার পূর্বে ইফতার করা: রোযাদার ব্যক্তির জন্য এতো দ্রুত ইফতার না করা উচিৎ। কখনো সূর্য অস্তমিত হয়ে গেছে মনে করে ইফতার করলে উক্ত রোযা ভেঙে যাবে এবং রমযানের পর ওই রোযার কাযা ওয়াজিব হবে।

মেঘাচ্ছন্ন দিনে বিলম্বে ইফতার করা উত্তম: আকাশ মেঘাচ্ছন্ন দিনে কিছু দেরি করে ইফতার করা উত্তম। মেঘের দিনে রোযাদার ব্যক্তির জন্য সূর্যাস্ত হয়ে গেছে বলে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা উত্তম। (মাকতাবায়ে রহমানিয়া, ১/২০৭)

যাকাতের টাকা দিয়ে ইফতারের আয়োজন: যদি ইফতারকারীগণ সবাই গরীব ও যাকাতের উপযোগী হয় এবং প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে ইফতার সামগ্রী তাদের হাতে দিয়ে উক্ত ইফতারীর মালিক বানিয়ে দেওয়া হয়, এমতাবস্থায় যাকাতের টাকা দিয়ে ইফতারের ব্যবস্থা করা জায়েয ও বৈধ হবে। আর যদি ইফতারকারীগণ যাকাতের উপযোগী না হয়, অথবা ব্যক্তিগতভাবে মালিক না বানিয়ে সম্মিলিতভাবে যাকাতের টাকা দিয়ে ইফতারের আয়োজন করা হয়, তখন তা বৈধ হবে না এবং যাকাতও আদায় হবে না। (ফতওয়ায়ে শামী, ২/২৫৭)

মসজিদে ইফতারের আয়োজন করা: মসজিদে ই’তিকাফের নিয়ত বিহীন আহার বা পানাহার করা মাকরূহ। যদি বিশেষ ঠেকা বশত মসজিদে ইফতার করতে হয়, তাহলে নফল ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে প্রবেশ করতে হবে। তবে ইফতার শেষে মসজিদ পরিস্কার করা জরুরি, যাতে মসজিদ অপবিত্র ও অপরিস্কার অবস্থায় না থাকে। সাথে সাথে উচ্চ আওয়াজে ও অনর্থক কথা-বার্তা বর্জন এবং মসজিদের আদব রক্ষা করা অপরিহার্য। (ফতোয়ায়ে আলমগীরী)

অমুসলিমদের প্রেরিত জিনিস দিয়ে ইফতার করা: সেচ্ছায় হাদীয়াস্বরূপ অমুসলিমদের দেওয়া ইফতার সামগ্রী যদি হালাল ও পবিত্র হয়, তাহলে তা গ্রহণ করা এবং তা দিয়ে ইফতার করা জায়েয ও বৈধ হবে।

সাহরীর তাৎপর্য ফযীলত: সাহরী খাওয়া সুন্নত। রোযার উদ্দেশ্যে রাতের শেষাংশে সুবহে সাদিকের পূর্বে কোনো কিছু আহার করাকে শরীয়তের পরিভাষায় সাহরী বলে। এটি অত্যন্ত বরকতময় খাবার।

হাদীস শরীফে এর অনেক ফযিলত বর্ণিত হয়েছে। আমাদের রোযা ও ইহুদি নাসারাদের রোযার মধ্যকার পার্থক্য বর্ণনা দিতে গিয়ে একদিন রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ইহুদী ও আমাদের রোযার মধ্যে একমাত্র পার্থক্য হল, তারা সাহরী খায় না, আমরা সাহরী খেয়ে থাকি।’ (মুসলিম শরীফ ১/৩৫০)

অন্য বর্ণনায় আছে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা সাহরী খাও। কেননা, তাতে তোমাদের জন্য বরকত রয়েছে।’ হযরত ইরবায ইবনে সারিয়া (রাযি.) বলেন, একদিন রমযানে রাসূল (সা.) আমাকে সাহরী খেতে ডাকলেন এবং বললেন, ‘এসো এ মোবারকখানার দিকে।’ (সুনানে আবু দাউদ নাসায়ী)

রাসূল (সা.) আরও বলেন, সাহরী খেয়ে রোযার জন্য শক্তি সঞ্চার কর আর দুপুরে শয়ন করে শেষ রাত্রে উঠার জন্য প্রস্তুত হও।

সাহরী সংক্রান্ত জরুরি মাসায়েল

সাহরীতে বিশেষ কোনো খাদ্য খাওয়া জরুরি নয়। খাদ্য ও পানীয় থেকে যা সহজসাধ্য হবে, তা দিয়ে আহার-পানাহার করার মাধ্যমে সাহরীর সুন্নত আদায় হয়ে যাবে। (সুনানে আবু দাউদ)

বিলম্বে সাহরী খাওয়া উত্তম: বিলম্বে সাহরী খাওয়া উত্তম। তবে সাহরীকে এত বেশি বিলম্ব করে খাওয়া মাকরূহ, যার দরুণ সুবহে সাদিক উদয় হওয়ার আশঙ্কা হয়ে যায়। (ফতওয়ায়ে রশিদিয়া, ১/২০০)

রোযার জন্য সাহরী খাওয়া শর্ত নয়: রোযা শুদ্ধ হওয়ার জন্য সাহরী খাওয়া জরুরী নয়। যদি নিদ্রার কারণে সাহরী খাওয়ার সুযোগ নাও হয়, তারপরেও নিয়ত করে রোযা রাখলে রোযা আদায় হয়ে যাবে। (হিদায়া, ১/২২৫)

সন্দেহ অবস্থায় সাহরী খাওয়া: সাহরীর সময় আছে বা নেই এ নিয়ে সন্দেহ হলে সাহরী না খাওয়া উচিৎ। এরূপ সময়ে সাহরী খেলে পরে ওই রোযা কাযা করা ভালো। আর যদি পরে নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে, তখন সাহরীর সময় ছিল না, এ অবস্থায় রোযা কাযা করা ওয়াজিব। (আদ-দুররুল মুখতার)

সাহরী খাওয়ার পর কুলি করা: সাহরী খাওয়ার পর ভালোভাবে কুলি করা বা খিলাল করা উত্তম। যদি সম্ভব হয়, তাহলে মিসওয়াক করাও উত্তম। যাতে দাঁতসহ মুখ পরিস্কার হয়ে যায়।

সাহরী খাওয়ার সঠিক সময়: রোযাদার ব্যক্তির জন্য রাত্রের শেষাংশে সুবহে সাদিক হওয়ার পূর্বমুহূর্তে সাহরী খাওয়া সুন্নত। তবে রাত্রের অর্ধ ভাগের পর থেকে সুবহে সাদিকের পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত যে কোনো সময় সাহরী খেলে সাহরীর সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে। (ফতওয়ায়ে আলমগীরী, রশিদিয়া, ১/২০০)

সাহরীর সময় সাইরেন বা মাইকের মাধ্যমে এলান করা: সাহরীর সময় সাইরেন বা মাইকের মাধ্যমে এলান করা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং সাহরীর সময় মুসলমান ভাই বোনদেরকে অবগত করার উদ্দেশ্যে সাইরেন বা মাইকে এলান করা জায়েয ও বৈধ। কিন্তু লাগাতার এলান, ওয়াজ, নসিহত বা সংগীত পাঠ করা জায়েয নয়। কেননা এতে মুসলমান ভাই-বোনদের ইবাদত, তাহাজ্জুদ, কুরআন তিলাওয়াত, দুরূদ ইস্তেগফার করার মধ্যে বিগ্ন ঘটে। (ফতওয়ায়ে শামী, কিতাবুল হাজরে ওয়াল ইবাহা)

লাইলাতুল কদর

সূরা কদরের শানে নুযুল: ইবনে আবী হাতেম (রহ.)-এর রেওয়ায়েতে আছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) একবার বনী ইসরাঈলের জনৈক মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি এক হাজার মাস পর্যন্ত অবিরাম জিহাদে মশগুল থাকেন। সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) একথা শুনে বিস্মিত হলে এ সূরা অবতীর্ণ হয়। এতে এ উম্মতের জন্যে শুধু এক রাতের ইবাদত জনৈক মুজাহিদের এক হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করা হয়েছে।

ইমাম ইবনে জরীর (রহ.) অপর একটি ঘটনা এভাবে উল্লেখ করেছেন যে, বনী ইসরাঈলের জনৈক ইবাদতকারী ব্যক্তি পুরো রাত ইবাদতে মশগুল থাকত ও সকাল হতেই জিহাদের জন্য বের হয়ে যেত এবং সারা দিন জিহাদে লিপ্ত থাকত। সে এক হাজার মাস এভাবে কাটিয়ে দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আলাহ তাআলা সূরা কদর অবতীর্ণ করে এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। এ ঘটনা থেকে আরও প্রতিয়মান হয় যে, শবে কদর উম্মতে মোহাম্মদীরই একটি বৈশিষ্ট্য। (তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন)

বিখ্যাত মুফাসসিরে কুরআন আল্লামা ইবনে আবি হাতেম (রহ.) বলেন, পবিত্র রমযান মাসের এক অনন্য শ্রেষ্ঠত্ব হল লাইলাতুল কদর। মহানবী (সা.) একবার এ রাতটিকে খোঁজার জন্যই একমাস ই’তিকাফ করেন। একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) বনী ইসরাইলের ৪জন সাধকের কথা বললেন যে, তারা সুদীর্ঘ ৮০ বছর ধরে এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করেছেন যে, সেই সময় চোখের পলক মারার মত সময়ও তারা আল্লাহর নাফরমানী করেননি। তাঁরা হলেন আইয়ুব, যাকারিয়া, হিযকিল ইবনে আজুয ও ইউশা ইবনে নুন (আ.)। কথাগুলো শুনে সাহাবায়ে কেরাম খুবই আশ্চার্যান্বিত হলেন। ফলে নবী (সা.) এর নিকট হযরত জিবরাঈল (আ.) এলেন এবং বললেন, আপনার উম্মত সেই সাধকের ৮০ বছরের ইবাদতের কথা শুনে বিস্ময়ে বিমূঢ় হচ্ছে। তাই আল্লাহ তাআলা এর চেয়েও উত্তম ইবাদত আপনার উম্মতের জন্য নাযিল করেছেন, তা হল সূরা আল-কদর।

যাতে বলা হয়েছে যে লাইলাতুল কদরে মাত্র একটি রাতের ইবাদত এক হাজার অর্থাৎ ৮৩ বছর চার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম। এ সুসংবাদ শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম খুব খুশি হন। কুরআন হাদিস বিশ্লেষণ করলে এ রাতের যেসব বিশেষ গুণ পাওয়া যায় তা হল, এ রাতে কুরআন অবতীর্ণের সূচনা হয়, এ রাতে আল্লাহপাক বিশেষ নির্দেশে অগণিত ফেরেশতা ও জিবরাঈল (আ.) অবতরণ করেন এবং ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত এ রাতের প্রত্যেক বিষয় শান্তিময় হয়। অন্য বর্ণনায় আছে আকাশের তাঁরা যত তার চেয়েও বেশি ফেরেশতা অবতরণ করে।

উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাযি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) রমযানের শেষ দশকে অন্য সময়ের তুলনায় অধিকতর ইবাদত ও সাধ্য-সাধনা করতেন। তিনি কেবল একা নন, বরং পরিবারবর্গকেও সেই ইবাদতে শামিল করতেন। যেমন- হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাযি.) বলেন, যখন রমযানের শেষ দশক আসতো তখন তিনি নিজে রাত জাগতেন এবং পরিবারবর্গকেও জাগাতেন।

হাদীস শরীফে লায়লাতুল কদর: হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি বিশ্বাস স্থাপন করত: সাওয়াব প্রাপ্তির আশায় কদরের রজনীতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করবে তার পিছনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ (মেশকাত শরীফ, ১/২৭৩)

শবে কদরে পড়ার দোয়া:

«اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّيْ».

অর্থ: হে আল্লাহ, নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালবাসেন। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন।

আল্লাহ তাআলা শবে কদরের সুনির্দিষ্ট তারিখটি গোপন রেখেছেন অনেকগুলো হিকমতের কারণে। এর মধ্যে একটি হল যাতে আল্লাহ প্রেমিক বান্দাগণ সর্বদা এর অনুসন্ধানে থাকে এবং প্রতি রজনীতেই অধিক ইবাদতের মাধ্যমে অসংখ্য নেকি অর্জন করতে পারে।

শবে কদরে আমল: এ রাতে নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির, দরুদ শরীফ ইত্যাদি যে কোন ইবাদত করা যায়। নফল নামায মোট কত রাকাআত পড়তে হবে ও কোন কোন সূরা দিয়ে পড়তে হবে এর কোন সুনির্দিষ্টতা নেই। যত রাকাআত ইচ্ছা, যে সূরা ইচ্ছা তা পড়া যায়। পুরো রাত জেগে ইবাদত সম্ভব না হলে যতটুকু সম্ভব ইবাদত করব। ইশা ও ফজরের নামায অবশ্যই জামাআতের সাথে আদায় করব। এতেও পুরো রাত্র জেগে ইবাদত করার সাওয়াব পাওয়া যায়। তবে এই রজনিতে অধিক হারে নফল নামায আদায় করার জন্য চেষ্টা করব। দু’রাকাআত নফল নামায যদি আল্লাহ তাআলার দরবারে কবুল হয় আমরা জান্নাতে যাওয়ার জন্য সে দু’রাকাআতই যথেষ্ট হয়ে যাবে। বোখারী এবং মুসলিম শরীফের হাদীস অর্থাৎ এমনভাবে তুমি এবাদত করবে আল্লাহকে যেন তুমি দেখছো। অতটুকু যেতে না পারলেও অন্তত মনে করবে যেন আল্লাহ তোমাকে দেখছেন। আমি আল্লাহ তাআলার দরবারে দাঁড়িয়েছি শুরু থেকে সালাম ফিরানো পর্যন্ত পুরা দু’রাকাত নামাযে যদি আমার এই মনোভাব থাকে অবশ্যই তিনি আমাদের নামায কবুল করবেন। বৎসরের প্রতি রাতেইতো আমরা ঘুমাচ্ছি। অন্তত কয়েকটি রাত, শা’বানের মধ্য রাত, বরাতের রাত, কদরের রাত এবং দু’ঈদের রাত জাগ্রত থেকে ইবাদত করে আল্ল­াহর দরবারে যদি কাটিয়ে দিই তাহলে আমাদের কোন ক্ষতি হবে না। কাজেই পুরা রাত আমরা এবাদত করার চেষ্টা করব। এরপর সুন্দরভাবে শুদ্ধ করে কুরআন তিলওয়াত করার চেষ্টা করতে করবো। যখন জান্নাতের কথা আসবে ‘জান্নাত’ শব্দ আসবে তখন আল্লাহ তাআলার কাছে ফরিয়াদ করব, হে আল্লাহ, তুমি আমাকে জান্নাতের অধিকারী করে দাও। আর যখন জাহান্নাম শব্দ আসবে তখনও আল্লাহর কাছে বলব, হে আল্লাহ তুমি আমাকে জাহান্নাম হতে পরিত্রাণ দাও। এভাবে কুরআন করীমের তেলাওয়াত করব। এরপর বেশি করে আল্লাহর নবীর ওপর দরুদ শরীফ পাঠ করব। একবার যে ব্যক্তি আল্লাহর নবীর ওপর দরুদ পাঠ করবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার ওপর দশটি রহমত নাজিল করবেন। যে দোয়ার শুরুতে আল্লাহর নবীর ওপর দরুদ পড়া হয় না আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তা কবুল করেন না। এজন্য দোয়ার শুরুতেও দরুদ পাঠ করতে হবে এবং শেষেও দরুদ পাঠ করতে হবে। সংক্ষিপ্ত দরুদ আছে যেমন- ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ বা ‘আস-সালাতু ওয়াস সালামু আলা সাইয়িদিল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন’ ছোট-বড় দরুদ শরীফ বেশি করে আমরা পড়ব। শবে কদরে আমরা ‘ইস্তেগফার’ করব। হে আল্লাহ অনেক গোনাহ করেছি, সে গোনাহ থেকে আমরা ক্ষমা চাই এটাকে বলা হয় ‘ইস্তেগফার’। কারণ শবে কদর তাওবার রাত, গোনাহ মাফ চাওয়ার রাত। এ জন্য দরুদ এবং ইস্তেগফার বেশি বেশি আদায় করতে হবে। আর রাতে আমরা কবর যিয়ারতও করব।

সদ্‌কায়ে ফিতরা

সদকাতুল ফিতর যাকে আমরা সাধারণত রমযানের ফিতরা হিসেবে জানি তা দ্বিতীয় হিজরীর শা’বান মাসে ফরজ হয়েছে। আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মাধ্যমে সাদাকাতুল ফিতরকে ওয়াজিব করার মহান লক্ষ ও উদ্দেশ্য হল অভাবীদের অভাব দূর করা। অসহায় নিঃস্ব ব্যক্তিদের জরুরত পূরণ করা। বিশেষত রোজা রাখতে গিয়ে মানুষের ভুল-ত্রুটি মুক্ত করা। যেমন- হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব করেছেন রোজাদারকে বে-ফায়দা ও অশ্লীল কর্মকান্ড, অপবিত্রতা হতে পবিত্র করার জন্য এবং ফকির-মিসকিনদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের জন্য।’ (আবু দাউদ শরীফ)

সদকায়ে ফিতর কার ওপর ওয়াজিব: যে ব্যক্তির ওপর কুরবানি ওয়াজিব, অর্থাৎ সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা তার সমপরিমাণ টাকা থাকে, তাহলে তার ওপর ঈদুল ফিতরের দিন সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। চাই তা ব্যবসার সম্পদ হোক বা না হোক, বছর অতিবাহিত হোক বা না হোক, পুরুষ হোক বা মহিলা হোক কোন পার্থক্য নেই। (হেদায়া, ১/১৯০)

ছেলে-মেয়েদের পক্ষ থেকে সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব: যে ব্যক্তির ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে। তার ওপর তার অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়েদের পক্ষ থেকেও সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। (হেদায়া, রহমানিয়া, ১/৯০)

মহিলাদের শুধু নিজের ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব: যেই মহিলার নিকট প্রয়োজনাতিরিক্ত সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা তার সমপরিমাণ টাকার সম্পদ থাকবে, তার ওপর শুধু নিজের সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। তার ওপর নিজ ছেলে-মেয়ে, মাতা-পিতা, ভাই-বোন এমনকি গরীব স্বামীর পক্ষ থেকে সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব নয়। (আহকামে রমযান, পৃ .১৭৫)

সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব কখন: সদকায়ে ফিতর ঈদুল ফিতরের দিন সূর্য উদয়ের সময় আদায় করা ওয়াজিব হয়, তবে এর পূর্বেও সদকায়ে ফিতর আদায় করা জায়েয আছে। সুতরাং যে ব্যক্তি উক্ত সময়ের পূর্বে ইন্তেকাল করবে বা ফকির হয়ে যাবে, তার ওপর সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব নয়।

নবজাতক সন্তানের সদকায়ে ফিতর: যদি সুবহে সাদিকের পূর্বে বা সুবহে সাদিকের সময় নবজাতক সন্তান জন্ম গ্রহণ করে, তাহলে সম্পদশালী পিতা তার নবজাতক সন্তানের পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা তার ওপর ওয়াজিব। আর যদি সুবহে সাদিকের পর জন্ম গ্রহণ করে, তাহলে তার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয়। (হিন্দিয়া)

নতুন মুসলমানের ফিতরা: যদি কোন কাফির বা ফকির ঈদুল ফিতরের দিন সূর্য উদয়ের পূর্বে বা সূর্য উদয়ের সময় মুসলমান বা সম্পদশালী হয়ে যায়, তাহলে তার ওপর সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। আর যদি সূর্য উদিত হওয়ার পর মুসলমান হয় বা কেউ সম্পদশালী হয়, তাহলে তার ওপর সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব নয়। (হিন্দিয়া রশিদিয়া, ১/১৯২)

দেরীতে ফিতরা আদায় করা মাকরূহ: যদি ঈদুল ফিতরের দিন ঈদের নামাজের পূর্বে সদকায়ে ফিতর করতে হবে। কিন্তু ঈদের নামাজের পূর্বে সদকায়ে ফিতর আদায় না করে পরে আদায় করা সুন্নত পরিপন্থী ও মাকরূহ হবে। তা সত্ত্বেও দেরীতে আদায় করলেও আদায় হয়ে যাবে। (দুররে মুখতার, ২/৩৬৭)

বিবাহিত মেয়ের সদকায়ে ফিতর কার ওপর ওয়াজিব: যদি বিবাহিতা মেয়ে পিতার বাড়িতে অবস্থান করে থাকে, তখন দেখার বিষয় হচ্ছে সে সম্পদশালী কিনা? যদি সে সম্পদশালী হয়, তাহলে সে প্রাপ্ত বয়স্কা হোক বা না হোক, তার সম্পদ থেকে নিজ ‘সদকায়ে ফিতর’ আদায় করা ওয়াজিব। কিন্তু মেয়ে যদি প্রাপ্ত বয়স্কা বটে, কিন্তু সম্পদশালী নয়, তাহলে তার সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব নয়। আর যদি মেয়ে অপ্রাপ্ত বয়স্ক হয় এবং স্বামীর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া না হয় অথবা সম্পদশালীও না হয়, তাহলে পিতার ওপর তার ‘সদকায়ে ফিতর’ আদায় করা ওয়াজিব। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া)

রোযা না রাখলেও সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব: যদি সম্পদশালী ব্যক্তি কোনো কারণবশত রমযানের রোজা রাখতে না পারে, এরপরেও তার সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। নচেৎ, সে গুনাহগার হবে। (ফতওয়ায়ে শামী, ১/১৬৩)

সদকায়ে ফিতরা’র পরিমাণ: সদকায়ে ফিতর হচ্ছে খেজুর, যব, গম, আটা বা এগুলোর নগদ মূল্য টাকা পয়সা দ্বারা ‘সদকায়ে ফিতর’ আদায় করা যাবে। (হিন্দিয়া, ১/১৯৩)

মাসআলা: যদি সদকায়ে ফিতর গম বা আটা দ্বারা আদায় করতে চায়, তাহলে এক ছা’ অর্থাৎ আনুমানিক সাড়ে তিন সের ভালো মানের খেজুর বা তার মূল্য আদায় করতে হবে। (রশিদিয়া, ১/১৯১)

মাসআলা: যদি সদকায়ে ফিতর গম বা আটা দ্বারা আদায় করতে চায়, তাহলে পৌনে দুই সের (তথা ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম) ভালো মানের গম বা আটা সদকা করতে হবে। আর যদি মূল্য আদায় করতে চায়, তাহলে উক্ত গম বা আটা পরিমাণ মূল্য সদকা করে দিবে। (দুররে মুখতার, ১/৩৪৬)

সদকায়ে ফিতর কাকে দেবে: যে সমস্ত লোকদেরকে যাকাত দেওয়া যায়, তাদেরকে সদকায়ে ফিতরও দেওয়া যায়। আর যে সমস্ত লোকদেরকে জাকাত দেওয়া জায়েয নেই, তাদেরকে সদকায়ে ফিতর দেওয়াও জায়েয নেই। (ফতওয়ায়ে শামী, ২/৩৪৪)

সদকায়ে ফিতরের টাকা দিয়ে মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ: সদকায়ে ফিতরের টাকা দিয়ে মসজিদ, মাদরাসা, রাস্তা, হাসপাতাল নির্মাণসহ জনকল্যাণমূলক কাজ করা জায়েয হবে না; বরং উক্ত টাকা গরিব-মিসকিন তথা যাকাতের উপযোগীদেরকে বণ্টন করে দিতে হবে।

মাদরাসার গরিব ছাত্রদেরকে ফিতরা দেওয়া উত্তম: মাদরাসার গরিব ছাত্রদেরকে সদকায়ে ফিতর দেওয়া অধিক উত্তম। কেননা এতে সদকায়ে ফিতর আদায়ের সাথে সাথে সদকায়ে জারিয়ার সওয়াবও অর্জন হয়।

একজনকে একাধিক সদকায়ে ফিতর দেওয়া: একটি সদকায়ে ফিতর একজন ফকির মিসকিন বা একাধিক ফকির মিসকিনকেও প্রদান করা জায়েয। এমনিভাবে একজনকে একাধিক সদকায়ে ফিতর দেওয়াও জায়েয ও বৈধ হবে। (ফতওয়ায়ে শামী, ২/৩৬৪)

ঋণের পরিবর্তে ফিতরার টাকা কর্তন করা: কোনো ধনী ব্যক্তি কোনো অসহায় ব্যক্তির নিকট ঋণ পাওনা থাকে, এমতাবস্থায় যদি ধনী ব্যক্তি ঋণের পরিবর্তে গরীব থেকে সদকায়ে ফিতরের টাকা কর্তন করে, তাহলে তার সদকায়ে ফিতর আদায় হবে না।

কারাবদ্ধ ব্যক্তিকে ফিতরা দেওয়া: যদি কোনো কারাবদ্ধ গরীব এবং জাকাতের উপযোগী হয়, তাহলে তাকে বা তার পরিবারকে যাকাত ও সদকায়ে ফিতরের টাকা দিতে পারবে।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আমল করার তওফীক দান করুন। আমিন।

লেখক: খতীব, বায়তুল করীম জামে মসজিদ, হালিশহর, চট্টগ্রাম

[1] আত-তাবরীযী, মিশকাতুল মাসাবীহ, খ. ১, পৃ. ৬২০, হাদীস: ১৯৮৯

[2] ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, খ. ১, পৃ. ৫৪২, হাদীস: ১৬৯৮

[3] ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, খ. ১, পৃ. ৫৫৭, হাদীস: ১৭৫৩

[4] আবু দাউদ, আস-সুনান, খ. ২, পৃ. ৩০৬, হাদীস: ২৩৫৮

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ