কয়দিন পরে নুসরাত রাফি ইস্যুটাও কি মুছে যাবে!
নারীঅধিকার নিয়ে সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনা, বক্তৃতা চলছেই। কিন্তু তারপরও কি তারা তাদের সম্মান পাচ্ছে? বরং বেড়ে চলছে ধর্ষণের সংখ্যা। মুহূর্তেই একটি মেয়ের সুন্দর জীবনটা হচ্ছে ধ্বংস। একজন ধর্ষকের অনৈতিক কাজের জন্য একজন মেয়ের জীবনে নেমে আসে অপরিসীম দুর্যোগ। অনেকেই আত্মহত্যার শরণাপন্ন হয়, কেউ আবার ধর্ষকের হাতেই খুন হন। ধর্ষিতা ও তার পরিবারে নেমে আসে অভিশাপের কালো হাত। ওই দিকে ধর্ষণকারী যেন এক মহান কাজ শেষ করে হেঁটে বেড়ান সমাজের নাকের ডগা দিয়ে। বিচার চাইতে গেলে ধর্ষককে কিছু না বলে উল্টা মেয়ের ঘাড়েই দোষ চাপানো হয় এ সমাজে। অভিযোগ, মেয়ে পর্দা করে না, মেয়ের চলা ভালো না, মেয়ে উগ্র স্বভাবের, মেয়ে যার তার সঙ্গে কথা বলে ইত্যাদি আরো কত কথা। যা শুনে একজন মানবিক সভ্য মানুষ কিছুতেই নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারবে না। অথচ আমরা দিব্যি আছি! কিছুদিন এটা নিয়ে আলোচনা চলে। তারপর একটা সময় সবকিছুই আগের মতো। থানাতেও আস্তে আস্তে সেই ফাইলটা নিচে পড়ে ধুলো জমে যায়। ব্যাস, সব শেষ, বেকসুর খালাস। বিচার আর হয় না। এভাবেই ধর্ষণ দেশের মাটিতে শেকড় গেড়ে বসে। ধর্ষক পেয়ে যায় পশ্রয়। দেশ হয়ে যায় ধর্ষণের অভয়ারণ্য। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? আর কত মেয়েরা এভাবে নিজকে বলি দেবে? আর কতকাল এসব নরপশু ধর্ষণ করার পরও সমাজে বুক ফুলিয়ে হেঁটে বেড়াবে? কোনো উত্তর আছে আপনার কাছে? জানি থাকবে না। উত্তর দিতে পারলে তো তনু হত্যার পরেও দিতে পারতেন। এখনও তো সেই ধর্ষণের বিচারও হয়নি। চলে যাচ্ছে তো সব কিছু আগের মতো। শুধু এ সকল নারীরাই সমাজের সবস্থানেই লাঞ্ছনা আর অপমানের শিকার হয়। এজন্য আমি পোশাকের কোনো দোষ দিবোনা। পোশাকের দোষ দিলে সাম্প্রতিক ঘটনাটির কি ব্যাখ্যা দিবেন? যে মেয়ে মাদরাসায় পড়াশোনা করে, পর্দা করে চলে তার কি দোষ? আমরা তো আবার দোষ খুঁজে বের করে ফেলি, এখন হয়তো বলতে পারেন মেয়েটাতো প্রেম করে। তার মানে তাকে ধর্ষণ করা যাবে! এইতো? যদি তা না হয় তাহলে কেন এমন হলো রাফির সাথে? প্রেম তো ভেতরে ভেতরে আপনিও করেন। আবার অন্যজনকে খারাপ বলতেও আপনার মুখে আটকায় না। আসলে আমাদের সমাজটাই এমন। বিকৃত এবং নোংরা মনের মানুষে ভর্তি এ সমাজ। যেখানে অন্যায়কে ন্যায় আর ন্যায়কে অন্যায় বানানো হয়।
প্রেম মানে শরীর দেওয়া নেওয়া নয়। কিন্তু ওই ধর্ষক শিক্ষকটাও মনে করেছেন প্রেম মানে শরীর দেওয়া দেওয়া। তাই সে তার মেয়ের সমতুল্য ছাত্রীকে এমন প্রস্তাব দেয়। কারণ প্রেম মানেতো একজন ধর্ষক বুঝবে না। ধর্ষক চিনে শরীর। তাই সেও রাফির শরীরটা চেয়েছে। কতটা জঘন্য মানুষ হলে এমনটা করা যায় সেটা আমার মস্তিষ্কে আসছে না। কিন্তু আফসোস, আমাদের সমাজে এমন মস্তিষ্কের অনেক লোক আছে। যারা আমার আপনার সাথেই বসবাস কিংবা চলাফেরা করে। সুযোগের অপেক্ষায় হয়তো আছে। কাল সুযোগ পেলে আপনার বোন, মেয়ে কিংবা স্ত্রীর গায়েও হাত দিতে চাইবে। আর বিচার চাইতে গেলেতো ক্ষমতা আছেই। আম্মুর কাছে একটা প্রবাদ শুনতাম, জোর যার, মুল্লক তার। ঠিক সেভাবেই ধর্ষকরা সব করেও পার পেয়ে যায়।
আপনি যদি ধর্ষকদের সামনে বোরকা পরেও যান তারা ধর্ষণ করবেই। তাই বলে এই নয় যে আমি বোরকা খুলে রাস্তায় হাঁটতে বলছি। যার যার রুচি অনুযায়ী সে পোশাক পরবে, এখানে আমার আপনার হস্তেক্ষেপ করার কনো অধিকার নেই। এজন্য প্রয়েজন সঠিক মানসিকতা এবং পারিবারিক শিক্ষা। আপনি ঠিক থাকলে সব ঠিক। আপনার দৃষ্টিভঙ্গি পরির্বতন করতে হবে। আপনার মন চাইলে আপনিও রাস্তায় কাপড় ছাড়া হাটুন, আর দেখুন মেয়েরা আপনার কাছে আসে কিনা! আপনি কেন কুকুরের মতো তাদের পেছনে পড়ে থাকেন। কিছুদিন আগে প্রতিবাদের সুরে জামায় লেখা ছিলো, ‘গা ঘেষে দাঁড়াবেন না।’ প্রতিবাদটা যতাযত হলেও প্রতিকার পাওয়াটা অনেকটা আকাশ কুসুমের মতো। কথায় আছে, চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনি।
কিন্তু এ সমস্যার সমাধান হওয়া জরুরি। যতদিন আমাদের মাঝে বিচারহীনতা থাকবে ততদিন এ সমস্যা সমাধান হবে না। দূর করতে হবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। আসামীদের শাস্তি দিতে হবে ভয়নক এবং দৃষ্টান্তমূলক। যাতে আর কোনো পশু এধরনের কাজ করতে না পারে। যদি কোনো পশু এমন চিন্তাও করে, তাহলে শাস্তির কথা তার মনে পড়বে। কিন্তু এদেশেতো শাস্তি নেই, তাই ধর্ষকদের শাস্তির ভয়ও নেই। কখনও সত্যি মনে হয় এদেশে নারীরা নিরাপদ নয়। কিন্তু এটা বর্তমান সরকারের কাছে লজ্জার। যে দেশে নারী প্রধানমন্ত্রী থাকে সে দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা হওয়া আসলেই বেদনাময়।
মেয়েটির একটি ভিডিও দেখলাম, যেখানে পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে গেলে পুলিশ তার ভিডিও করে। সেই সাথে পুলিশ বলে কিচ্ছু হয়নি, কিচ্ছু হয়নি। আসলেই! কিচ্ছু হয়নি। পুলিশ সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষার কারিগর। অন্যায়ের বিরোদ্ধে রুখে দাড়ানোর শক্তি পুলিশ, সাধারণ মানুষের বন্ধু পুলিশ এসবই জানতাম পুলিশকে। কিন্তু এখন তার বিপরীত মনে হচ্ছে এ বাহীনির কাজ। যা সত্যি কষ্টদায়ক। রাফি বলেছিলো, তার সাথে যারা অন্যায় করেছে তাদের কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি দিবে। কিন্তু তার আগেই মৃত্যুর কাছে সে হেরে গেলো। অবশ্য মৃত্যুর সাথেও সে লড়াই করেছে বেশ। আশি ভাগ পুড়ে যাওয়া মানুষ আর কীভাবে বাঁচে! আর সেতো আত্বহত্যা করেনি। তাকেতো হত্যা করা হয়েছে। যাতে সে মামলাটা তুলে নেয়। কিন্তু সে মৃত্যুকেও ভয় করেনি। জয় করেছে নিজেকে। আজ সে ওপারে থাকলেও বিজয়ীর আসনে সে বসে আছে। আজ রাফি একজন না থাকলেও হাজার রাফি তার হয়ে প্রতিবাদ করছে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। রাফি মারা গিয়েও দেখিয়ে গেছে কিভাবে প্রতিবাদ করতে হয়। আামাদের সমাজে যেন এ প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে। প্রতিটি নারী যেন যার যার অবস্থান থেকে প্রতিবাদী হয়ে উঠে। আর কাপুরুষরা ছাড়া সুপুরুষরাও এসব নারীদের পাশে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। শুধু একটায় ভয়, বিচার হবে তো! নাকি অন্যদের মতো তাকেও কয়দিন পরে ভুলে যাবো!
আজহার মাহমুদ
সালাম হাইটস (৪র্থ তলা), খুলশি, চট্টগ্রাম-৪২০২