ইসলামের সাথে যুদ্ধবাজ শামীমা বেগমদের সম্পর্ক
ড. এম আবদুচ্ছালাম আজাদী
২০১৫ সালে ফেব্রুয়ারিতে হঠাৎ করে জানতে পারি শামীমা বেগম (১৫) মিস আবাসী (১৫) এবং খাদিজা সুলতানা (১৬) নামে লন্ডনের বেথনাল গ্রিন একাডেমির ৩ ছাত্রী সিরিয়ার আইএসের সাথে একসারিতে যুদ্ধ করার জন্য লন্ডন ছেড়েছে। তারা তুরস্কের ভেতর দিয়ে রাক্কার পথ ধরে সিরিয়ায় যেয়ে যুদ্ধে শরিক হয়।
এরপরেই মুসলিম কমিউনিটিতে শুরু হয় মারাত্মক তোলপাড়। আইএসের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করাকে এই ৩ মেয়ে ফরয মনে করেছিলো, এবং তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করা পুরুষের মতই নারীদের ও বের হওয়া ফরয মনে করত।
আমি লন্ডনে বহুদিন থেকে। একটা ইসলামিক স্কুলে দীর্ঘদিন ধরে পড়িয়েছি। মানুষ মনে করে মাদরাসায় পড়লে দীন সম্পর্কে বোঝার কারণে সবাই জিহাদিস্ট হয়, এবং এসব সন্ত্রাসী কাজে অংশ গ্রহণ করে। কিন্তু আমি লন্ডনে প্রায় ৪টা মাদরাসার সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলাম। এদের কোন ছাত্রই আইএসের সাথে যোগ দিতে, আমার জানা মতে, সিরিয়ায় যায়নি।
লন্ডনে মাদানী গার্লস ও লতিফিয়া গার্লস মাদরাসার কেউ এ সন্ত্রাসে যোগ দেয়নি। অথচ অংশ গ্রহণ করেছে বেথনাল গ্রিন একাডেমি নামে একটা নাম করা সেক্যুলার ও সরকারি স্কুলের ছাত্রীরা।
ব্রিটিশ মিডিয়া প্রথমে হতচকিত হয়ে যায়। এসব মেয়েদের ঘর থেকে পালিয়ে সুদূর সিরিয়ায় যাওয়ার কারণ বোঝার চেষ্টা করে। তার সাথে আমরাও এই ব্যাপার গুলো তলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। আমার কছে মনে হয়েছে, দীন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকাই ছিলো তাদের সন্ত্রাসী হওয়ার বড় কারণ।
আমার হাতে পড়াশোনা করা কিছু ছেলে একবার অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে আমার কাছে আসে। আরববসন্তে ইসলামপন্থিদের ইতিবাচক অবস্থান দেখা দেয়। মিসরে ইখওয়ান ও সালাফিদের সরকার বিরোধী হওয়া, তিউনিসিয়ার নাহদারও তেমন ভূমিকা রাখা, মরক্কোর ইখওয়ানেদের উত্থান- এসবই তখন ইসলামিস্টদের মনে ধারণা তৈরি করে যে মুসলিমদেশগুলোতে জেঁকে থাকা জালিম সরকার উৎখাতে অংশ গ্রহণ করা ইসলামি জিহাদের অংশ।
সিরিয়ার ব্যাপারটা হয়ে যায় ভিন্ন। এখানে সিভিল ওয়ার শুরু হয়ে যায়। এখন ব্রিটেনের মুসলিমরা সিরিয়ায় গিয়ে অংশ গ্রহণ করতে পারবে কিনা এ প্রশ্ন তারা আমার কাছে করে। আমি সরাসরি এর জবাবে ‘না’ বলি এবং কয়েকটি বিষয় তাদের সামনে তুলে ধরি:
- ইসলামি জিহাদে সশস্ত্র যুদ্ধ কখনো কোন বেসরকারি সংস্থা আহ্বান জানালে অংশ গ্রহণ করা যায় না। কোন মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান ডাক দিলেই তবে অংশ গ্রহণ করা যায়। তবে প্রধান শর্ত হতে হবে মুসলিম ভার্সেস অমুসলিমদের যুদ্ধ এবং তা হতে হবে যে সরকার ডাক দিয়েছে তারই দেশের মুসলিম। অন্য দেশের মুসলিমদের ওপর ওই সরকারের ডাকে যাওয়া ফরয নয়। তবে সকল মুসলিম দেশের সরকার প্রধানরা একযোগে জিহাদের ডাক দিলে সেসব দেশের মুসলিমরা অংশ করলে করতে পারে। তাও যুদ্ধে যাওয়ার বাছাই কার্যক্রম হতে হবে সরকারি সংস্থার মাধ্যমে। আরো মনে রাখতে হবে, সকলের ওপরই ওই অবস্থায়ও যুদ্ধ করা ফরয নয়। কাজেই যারা ব্রিটেনে বসবাস করছো এবং এখানের জাতীয়তা নিয়ে কিংবা জন্মসূত্রে এ দেশেরই নাগরিক হয়ে আছো, তারা ঐখানে যেতে পারবে না।
- আরববসন্ত নামে যে গণজাগরণ আরববিশ্বে আমরা দেখেছি তা ছিলো সিভিল ওয়ার বা মুসলমানের সাথে মুসলমানের যুদ্ধ। সেই অর্থে সিরিয়ার যুদ্ধ আসলেই কনফিউজিং এবং এর ব্যাপ্তি ও সীমা খুব ই মারাত্মক। এ নিয়েই আমি সিরিয়ায় কানা দাজ্জালের আবির্ভাব শিরোনামে একটা আর্টিকেল ও লিখি। এখানে আসাদকে উৎখাত করতে তখনকার সউদি ও মিসরীয় কিছু ওলামায়ে কেরাম জিহাদের ডাক দিলেও অনেক আলিম এটাকে মুসলিমদের ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধ মনে করেন। আমিও আমার ছাত্রদের এইটাই বোঝাই। তাছাড়া আমি তাদের এটাও বোঝাই যে, এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহের কোন দিক-নির্দেশনা নেই এবং ইউকে মুসলিম কমিউনিটি এর জন্য যুদ্ধ করার কথা বলেন না। কাজেই তাদের যাওয়া বৈধ হবে না।
যে দেশের নাগরিক হিসেবে থাকা হবে, ওই দেশের সাধারণ আইন মেনে চলা নাগরিকদের জন্য বাধ্যতামূলক। কেবল ওই আইনের ক্ষেত্রে শারীয়া অপশন নেওয়া যাবে, যা মানতে গেলে মারাত্মক কুফরি হবে। ব্রিটেনের আইন ও আমাদের বাংলাদেশের আইন একই। এ আইনে একজন মুসলিম ইসলাম মেনে চলার গ্যারান্টি নিয়ে জীবন যাপন করতে পারে। কাজেই এ দেশের কোন আইন ভাঙা কোন নাগরিকের উচিৎ হবে না। সরকার যেহেতু তার নাগরিকদের সিরিয়ায়
সে সময় মিডিয়ার কল্যাণে যৌন জিহাদ নামে একটা কথা শুনতাম। অর্থাৎ কিছু কিছু মেয়েরা জিহাদ করা যোদ্ধাদের স্ত্রী হয়ে তাদের যৌনজীবনের সাথী হতে সিরিয়াতে যায়। এসব শুনে বিশ্বাস হতো না। কিন্তু বেথনাল গ্রিনের শামীমার কথায় ও তার দেওয়া তথ্যে সেই কথাই প্রমাণিত হচ্ছে। যোদ্ধাদের যৌনতা সাপ্লাই দেওয়ার জন্য মেয়েরা জিহাদে যাবে, এটা ইসলামি ইতিহাসে ঘটেনি কখনও।
- যুদ্ধ করতে যেতে দিচ্ছে না, সেহেতু এখানে আইন ভাঙা যাবে না।
আমার এ ব্যাখ্যায় তারা বেশ খুশি হয় এবং তাদের উগ্রপন্থি বন্ধুদের বোঝানোর মত দলীল হাতে পায়।
এরপরে এ মেয়েগুলো ঘর থেকে বাবা-মাকে না জানিয়ে পালিয়ে তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় যুদ্ধ করতে যাওয়ার পর আমার কাছে এদের ব্যাপারে প্রশ্ন আসে। আমি এর জবাব নেতিবাচকই দেই। আমার কাছে তখন দুইটা মারাত্মক বিষয় সামনে আসে:
- এসব মেয়েদের ইসলামি জ্ঞানে হয় জিরো, নতুবা খুবই কম। তারা এখনো এসএসসিও পাশ করেনি, এ ধরসের টিনএইজের কোন মেয়ে একা একা ঘর হতে দূরে কোথাও মাহরাম ছাড়া বের হতে পারে না। মা-বাবা, ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজন কেউ জানবে না, অথচ এ বয়সের একটা মেয়ে জিহাদের জন্য বের হবে এটা ইসলামের মৌলিক আইন বিরোধী।
- ইসলামি যুদ্ধে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিলো রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতির সাথে শর্তযুক্ত এবং যুদ্ধের ময়দানে তাদের ক্ষেত্র ছিলো একেবারেই সীমিত। যেমন- সেনাবাহিনীর পানি সরবরাহ, চিকিৎসাসেবা, খাদ্য সরবরাহ ইত্যাদি। হাতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করা মহিলাদের নাম ইতিহাস হাতড়ে মাত্র কয়েকজনের মেলে, তাও তারা ছিলেন মাহরামের সাথে।
এরই আলোকে বলা যায় যেসব মেয়েরা পালিয়ে গেছে তাদের সাথে ইসলামি শরীয়ার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। এর বিভ্রান্ত। সে সময় মিডিয়ার কল্যাণে যৌন জিহাদ নামে একটা কথা শুনতাম। অর্থাৎ কিছু কিছু মেয়েরা জিহাদ করা যোদ্ধাদের স্ত্রী হয়ে তাদের যৌনজীবনের সাথী হতে সিরিয়াতে যায়। এসব শুনে বিশ্বাস হতো না। কিন্তু বেথনাল গ্রিনের শামীমার কথায় ও তার দেওয়া তথ্যে সেই কথাই প্রমাণিত হচ্ছে। যোদ্ধাদের যৌনতা সাপ্লাই দেওয়ার জন্য মেয়েরা জিহাদে যাবে, এটা ইসলামি ইতিহাসে ঘটেনি কখনও।
এ মেয়ে টাইমস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছে, সে সিরিয়ায় গিয়ে দু’সপ্তাহ আইএস সেনাদের সাথে থাকে। পরে হল্যান্ডের এক নওমুসলিম জিহাদিস্টের সাথে তার বিয়ে হয়। প্রথম দুইটা সন্তান মারা যায়। এখন সে সন্তানসম্ভবা। চাচ্ছে তার সন্তানকে জিহাদের চেয়ে প্রাধান্য দিতে। ফিরে আসতে চায় স্বভূমি ব্রিটেনে। সে নাকি বলেছে, আইএসের সাথে যুদ্ধ করতে যাওয়ায় সে এখনো অনুশোচনা করে না। এমনকি রাস্তার ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া মুসলিমদের কাটা মাথা দেখেও তার খারাপ লাগেনি। তবে সে মনে করে, খিলাফত কায়েমের চিন্তা শেষ। এখন সর্বত্রই করাপশান এবং অপরাধ প্রবণতা। কাজেই সিরিয়াতে সে আর থাকতে চায় না।
তার এ সরল স্বীকারোক্তি আমার ধারণা ও অবস্থানকে পাকাপোক্ত করেছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, এরা আসলে দাবার ঘুটি। এদেরকে ব্যবহার করেছে সংঘবদ্ধ কোন আন্তর্জাতিক গ্রুপ। যারা এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি মারতে চেয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে মুসলিমদের ব্যাপারে ব্রিটেনে নেতিবাচক ধারণা।
লেখক: লন্ডনপ্রবাসী, ইসলামিক স্কলার ও শিক্ষাবিদ