তালিবুল ইলম ভাইদের জেনে রাখা ভালো
মাহফুয আহমদ
এক
প্রাচীনকালে সংকলিত যেসব হাদীসগ্রন্থের শুরুতে ¯^qs সংকলক অত্যন্ত তথ্যবহুল, উপকারী ও জরুরি ‘মুকাদ্দামা’ বা ভূমিকা যুক্ত করে দিয়েছেন সেরকম কয়েকটি গ্রন্থ হলো:
-মুসনদে দারিমী: এটাকে সুনানে দারিমী নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। এই কিতাবের মুকাদ্দামায় ইমাম দারিমী (রহ.) বেশকিছু জরুরি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। যেমন- সীরাতে নববী, মু’জিযাত, ইত্তিবায়ে সুন্নাহ, ইলম, আদাবে ইলম ও ফতোয়া ইত্যাদি অতীব প্রয়োজনীয়; যা মুহাদ্দিস ও ফকীহ উভয়ের জন্যই উপকারী।
-সহীহ মুসলিম: ইমাম মুসলিম (রহ.) তাঁর হাদীস সংকলনের শুরুতে খুবই তাৎপর্যবহ একটি ভূমিকা সংযোজন করেছেন। রেওয়ায়াতুল হাদীস, রিজালুল হাদীস, জারহ ও তা’দীল ইত্যাদি কতগুলো অতীব প্রয়োজনীয় বিষয়ের ব্যাপারে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। শুধু মুকাদ্দামার জন্য বিভিন্ন ভাষায় স্বতন্ত্র ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচিত ও প্রকাশিত হয়েছে।
– সুনানে ইবনে মাজাহ: ইমাম ইবনে মাজাহ (রহ.) তাঁর কিতাবের শুরুতে চমৎকার একটি মুকাদ্দামা পেশ করেছেন। এই মুকাদ্দামায় তা’যীমে হাদীস, নাহী আনিল বিদআত, ফাযায়েলে সাহাবা ও ফযলুল ইলম ইত্যাদি কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সন্নিবেশিত হয়েছে।
– জামিউল উসূল ফী আহাদীসির রাসূল: ইবনুল আসীর (রহ.) সংকলিত এ বিশাল হাদীসগ্রন্থের মুকাদ্দামাটিও খুব জরুরি ও উপকারী। উলূমুল হাদীসবিষয়ক চমৎকার কতগুলো দিক এ মুকাদ্দামায় আলোচিত হয়েছে।
-সহীহ ইবনে হিব্বান: ইবনে হিব্বান (রহ.) কর্তৃক প্রণীত এই গ্রন্থের মুকাদ্দামাও তালিবুল ইলম ভাইদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
দুই
হাদীসগ্রন্থ সংকলনে ইমাম বুখারী ও ইমাম নাসায়ী (রহ.) উভয়ের মাঝে কিছুক্ষেত্রে সাদৃশ্য ও সামঞ্জস্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন- একই হাদীস একাধিকবার উল্লেখ করা, ‘রিওয়ায়াহবিল মা’না’ জায়েয বলা, তাহওয়ীলে ইসনদের সময় ‘হা’ চিহ্ন কম ব্যবহার করা, তারজামাতুল আবওয়াবের মধ্যে ফিকহ তথা মাসায়েলের ক্ষেত্রে মন্তব্য বা সমাধানের প্রতি ইঙ্গিত করা এবং কারো (হাদীস) বর্ণনা গ্রহণের শর্তাবলিতে অত্যধিক কঠোরতা অবলম্বন করা ইত্যাদি।
তিন
প্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্থ মুওয়াত্তা মালিকের ওপর ইমাম ইবনে আবদুল বার (রহ.) রচিত বিখ্যাত দুটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ রয়েছে। আত তামহীদ এবং আল ইসতিযকার। গবেষকগণ একই লেখক কর্তৃক সংকলিত এদুটি ব্যাখ্যাগ্রন্থের মধ্যকার পার্থক্য নিরূপণ করতে চেষ্টা করেছেন এবং অনেক দিক নিয়ে কথা বলেছেন। এখানে একটি প্রসঙ্গ তুলে ধরা যাক:
-আত তামহীদ হাদীসের রঙে রঙিন। অর্থাৎ ইবনে আবদুল বার এখানে আসানীদের শাওয়াহিদ, মুতাবিয়াত ও তুরুক; মুরসাল ও মুসনদ ইত্যাদি খুব বিশদভাবে উল্লেখ করেছেন।
– আল ইসতিযকার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফিকহের রঙে রঙিন। এজন্য ইবনে আবদুল বার এখানে ফুকাহায়ে কেরামের অভিমত ও মতভেদগুলো নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। বিশেষত ইমাম মালিক (রহ.)-এর মতামতগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ পেশ করেছেন। ফলত এই গ্রন্থে তুরুক ও শাওয়াহিদ ততটুকু বিশদভাবে উদ্ধৃত হয়নি।
চার
অবস্থা কোন পর্যায় গিয়ে পৌঁছছে দেখুন! মিসরের প্রশাসনিক আদালতে একজন আইনজীবী এই দাবী জানিয়ে আপিল করেছেন যে, সেদেশের শায়খুল আযহারের ওপর আদেশ জারি করা হোক তিনি যেন সহীহ আল-বুখারী সংশোধন তথা কাটছাঁট করে সংস্কার সাধন করেন! তাঁদের দৃষ্টিতে সহীহ আল-বুখারী নাকি কুরআন বিরোধী! সহীহ আল-বুখারী নাকি সমাজে বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধির কারণ! সহীহ আল-বুখারী নাকি ততটুকু বিশুদ্ধ ও বিশ্বস্ত কোনো হাদীসগ্রন্থ নয়!
অবশ্য এই দাবী গ্রহণ করত কার্যকর করা হয়নি! সুপ্রিম কোর্টে এ নিয়ে এখনও আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে!
বিশ্বের সচেতন আলেম ও গবেষকগণ এমন আপিলের ঘোর বিরোধিতা করছেন এবং সহীহ আল-বুখারীর বিশুদ্ধতা ও প্রামাণিকতা নিয়ে বুদ্ধিভিত্তিক তথ্যনির্ভর আলোচনা করে চলছেন।
বস্তুত ষড়যন্ত্রকারীরা যখন কুরআন নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে মুসলমানদের মনে সংশয় ঢুকাতে চেয়ে সফল হয়নি, তখন তারা হাদীস নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করতে চেষ্টা শুরু করে। তাদের পরিকল্পনা, মুসলমান যদি হাদীস নিয়ে সংশয়ে পড়ে যায় এবং হাদীসের প্রামাণিকতা তাদের নিকট সন্দেহজনক সাব্যস্ত হয়ে যায় তবেই তারা কুরআন থেকেও ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং এভাবে ইসলামবিলুপ্তির পথে অগ্রসর হতে থাকবে!!! কত ষড়যন্ত্র! কত প্ল্যান-পরিকল্পনা!!
‘তারা ভীষণ চক্রান্ত করে, আর আমিও কৌশল করি। অতএব, কাফেরদেরকে অবকাশ দিন, তাদেরকে অবকাশ দিন, কিছু দিনের জন্যে।’ (সূরা আত-তারিক: ১৫-১৭)
‘তারা মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর আলো নিভিয়ে দিতে চায়। আল্লাহ তাঁর আলোকে পূর্ণরূপে বিকশিত করবেন যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।’ (সূরা আস-সাফ: ৮)
পাঁচ
আল্লামা জুরজানী (রহ.) বলেন, একবার আমি ইমাম আবুল হাসান আদ দারাকুতনী (রহ.)র নিকট অনুরোধ করলাম, আপনি যুয়াফাউল মুহাদ্দিসীন বা হাদীস বর্ণনায় দুর্বলদেরবিষয়ে একটি গ্রন্থ সংকলন করুন! প্রত্যুত্তরে তিনি আমাকে বললেন, তোমার নিকট কি ইবনে আদী (রহ.)-এর কিতাবটি নেই? ইতিবাচক উত্তর দিলে তিনি বলেন, ওটাই যথেষ্ট। বাড়ানোর সুযোগকিংবা দরকার নেই। (তারিখু জুরজান, পৃ. ২৬৭)
ছয়
ইমাম নাওয়াওয়ী (রহ.) উলূমুল হাদীস বিষয়ে প্রথমত হাফিয ইবনুস সালাহ (রহ.) কর্তৃক রচিত এবং বিদ্বান মহলে সমাদৃত আল-মুকাদ্দামা (যা মুকাদ্দামায়ে ইবনুস সালাহ নামে সমধিক প্রসিদ্ধ) এর সংক্ষেপণ করে ইরশাদু তুল্লাবিল হাকায়িক ইলা মা’রিফাতি সুনানি খায়রিল খালায়িক (সা.) নামক গ্রন্থটি সংকলন করেন। অতঃপর এই সংক্ষেপিতগ্রন্থের আরও সংক্ষেপণ করে আত-তাকরীব ওয়াত তায়সীর লিমা’রিফাতি সুনানিল বাশীরিন নাযীর নামক জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থটি সংকলন করেন।
সাত
আল্লামা জালালুদ্দীন আস-সুয়ুতী (রহ.) বলেন, সাহাবীদের মধ্য থেকে যখন শুধু আবদুল্লাহ নাম ব্যবহার করা হয় তখন উদ্দেশ্য হয়ে থাকেন:
-(আবদুল্লাহ) ইবনে আব্বাস, মক্কাবাসী রাওয়ীদের নিকট।
-(আবদুল্লাহ) ইবনে উমার, মদিনাবাসী রাওয়ীদের নিকট।
-(আবদুল্লাহ) ইবনে মাসউদ, কুফাবাসী রাওয়ীদের নিকট।
-(আবদুল্লাহ) ইবনে আমর, মিসরবাসী রাওয়ীদের নিকট। (আত-তাদরীব লিস-সুয়ুতী)
আট
আল্লাহ তায়ালা ইমাম মুহী উদ্দীন নাওয়াওয়ীর ওপর বিশেষ রহমত নাযিল করুন। আপনাদের জানা থাকার কথা যে, ইমাম নাওয়াওয়ী (রহ.)-এর জন্ম ৬৩১ হিজরী / ১২৩৩ ঈসায়ীতে এবং মৃত্যু ৬৭৬ হিজরী / ১২৭৭ ঈসায়ীতে। অর্থাৎ মাত্র ৪৫ বছরের জীবন ছিল তাঁর। সেই জীবনে তিনি উম্মাহর জন্য এক বিশাল সমৃদ্ধ গ্রন্থালয় তৈরি করে গেছেন। তাঁর লেখা কিতাবগুলোরমাকবুলিয়াতের একটি পরিচয় হলো এই যে, যুগে যুগে তাঁর সবগুলো বই পঠিত, প্রকাশিত, প্রচারিত, সমাদৃত ও আলোচিত হয়ে আসছে। অসংখ্য বনী আদম তাঁর কিতাব পড়ে হেদায়তের পথ চলতে শিখছে।
এই যে, ছোট্ট আরবাঈন বা চল্লিশ হাদিস বিষয়ক বইটির কথাই বলি। দেখুন! শুধু আরবি ভাষায়ই এই ছোট্ট বইটিকে কেন্দ্র করে কতগুলো গ্রন্থ রচিত ও সংকলিত হয়েছে। তাছাড়া অনারব কতভাষায় এই বইয়ের অনুবাদ ও ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচিত হয়েছে- সেগুলোর হিসাব কে রাখবে?!
নয়
ইমাম বায়হাকী (রহ.) সীরাত বিষয়ক তাঁর সুবিশাল গ্রন্থ দালায়িলুন নুবুওয়াহ এবং অন্যান্য গ্রন্থে যখন এভাবে লিখেন যে আহমদ বলেন তখন নিজের প্রতিই ইঙ্গিত করেন। অর্থাৎ এটি তাঁর ব্যক্তিগত মত ও অভিমত। কেননা তাঁর পুরো নাম হচ্ছে আবু বকর আহমদ ইবনুল হোসাইন আল বায়হাকী (জন্ম: ৩৮৪ হি. = মৃত্যু: ৪৫৮ হি.)। আর তিনি যখন প্রসিদ্ধ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) এর কোনো কথা উদ্ধৃত করেন তখন এভাবে স্পষ্টাক্ষরে লিখে দেন যে ‘আহমদ ইবনে হাম্বল বলেন।’ সুতরাং ইমাম বায়হাকী (রহ.)-এর কিতাবাদি পড়ার সময় এবিষয়টিরপ্রতি খেয়াল রাখা চাই।
দশ
আল-হামদুলিল্লাহ! মুসলিমরা তো বটেই, অমুসলিম শিক্ষানুরাগী লোকজনের মাঝেও আরবী ভাষার প্রতি আকর্ষণ দিনদিন বেড়েই চলছে। পশ্চিমা দুনিয়ায় আরবীভাষার চর্চা ও চর্চাক্ষেত্র ক্রমশবৃদ্ধি পাচ্ছে। অবশ্য অমুসলিম আগ্রহীদের ক্ষেত্রে আরবদেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যের চিন্তাটা মুখ্য। তাদের সকলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আবার এক নয়। সদিচ্ছা বশত জ্ঞান অর্জনের নিয়তেও কেউ কেউআরবীভাষা শিখছে।
আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এখানকার মুসলিম সমাজের নতুন প্রজন্মও আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরবি শিখতে আগ্রহী ও মনোযোগী। এটা মূলত আশাজাগানিয়া। বিপত্তিও বাঁধে কিছু কিছু জায়গায়। যেমন এখানকার (ইংল্যান্ডের) কোনো কোনো মাদরাসায় আরবি পড়ানো হয় বা আরবী কিতাবাদির দরস দেওয়া হয় উর্দুতে। একারণে অনেক ছাত্র আবার ওইসব মাদরাসায় যেতে চায়না। আমি মনে করি, এদেশে আরবী ভাষা শিখানোর জন্য সরাসরি ইংলিশ-আরবি মেথড ফলো করা দরকার।
আল-হামদুলিল্লাহ! সীমিত পরিসরে হলেও আমি আরবী শিক্ষাদানের এই পদ্ধতি অনুসরণ করে ভালো সাড়া ও রেজাল্ট পাচ্ছি। আরবি-ইংলিশ ডিকশনারি অনেক থাকলেও আমার কাছে আপাতত The Hans WehrB ভালো মনে হচ্ছে। শিক্ষার্থীদেরকেও এটি সংগ্রহ করতে উপদেশ দিয়ে থাকি। উল্লেখ্য যে, ধীরেধীরে ইংলিশ ভাষায়ও গ্রামাটিক (নাহু-সারফ) আরবীর ওপর প্রচুর গ্রন্থ রচিত, সংকলিতএবং অন্যান্য ভাষা থেকে অনূদিত হয়ে আসছে।
আশা রাখি এবং দোয়া করি, এখানেও আরও বেশি বেশি ট্র্যাডিশনাল উলামা ও রিজাল তৈরি হউক এবং দীন প্রচার ও সংরক্ষণের কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হোক।
এগারো
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) তাঁর আল-মুসনদ সংকলনের সময় (ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম প্রমুখের মতো) সবগুলো হাদিস সহীহ হওয়ার শর্তারোপ করেননি। বরং তাঁর নীতি বা শর্ত ছিল, প্রসিদ্ধ হাদীসগুলো একত্রিত করে দেওয়া। বস্তুত আল-মুসনদ সংকলনের দ্বারা তাঁর উদ্দেশ্য হলো, বিভিন্ন অঞ্চলের হাদীসশাস্ত্রের ইমামগণের নিকট সমাদৃত, গ্রহণযোগ্য ও দলিলপ্রদানযোগ্য হাদীসগুলো সন্নিবেশিত করে দেওয়া। এটাই ছিল তাঁর শর্ত। এই শর্তটির কথা উল্লেখ করেছেন তাঁর ছেলে আবদুল্লাহ, এরপর আবু মুসা আল-মাদিনী (মৃ. ৫৮১ হি., আলী ইবনুল মাদিনী নন), ইবনুল জাওযী প্রমুখ হাদীস বিশেষজ্ঞ আলেম।
বিশেষজ্ঞ আলেমগণ বলেন যে, ইমাম আহমদ (রহ.) কখনও কখনও তাঁর আল-মুসনদ এ যয়িফ ও মুনকার হাদীস উল্লেখ করে দেন। আবার কখনও তিনি এমন হাদীসও উল্লেখ করে দিয়েছেন; যার মতন সঠিক হলেও সনদে কোনো ওয়াযযা (হাদীস বানোয়াটকারী) রয়েছেন। তবে তিনি এমন কোনো হাদীস উল্লেখ করেন না; যার মতন মওযু’।
জানা থাকা দরকার যে, আল্লামা ইবনুল জাওযী (রহ.) মওযু’ হাদীস বিষয়ক তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ আল-মাওযুআতে এমন কিছু হাদীসও অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন; যেগুলো ইমাম আহমদ (রহ.) তাঁর আল-মুসনদে বর্ণনা করেছেন। ইবনুল জাওযী এরকম কিছু হাদীস উল্লেখ করে সেগুলো মওযু’ বলে মন্তব্য করেছেন। ইমাম আহমদ ও তাঁর মুসনদ এর পক্ষে ও সমর্থনে ইবনুল জাওযীর খণ্ডন করেছেন হাফিয ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.)। আসকালানী এ সম্বন্ধে আল-কাওলুল মুসাদ্দাদ ফিয যাব্বি আনিল মুসনদ লিল ইমাম আহমদ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন।
বারো
প্রথম যুগে রচিত ও সংকলিত গ্রন্থসমূহ; যেমন- ইবনে জুরাইজ, যুহরী প্রমুখ ইমামের গ্রন্থাদির মধ্য থেকে কিছু তো সংরক্ষিত থাকেনি, বরং কালপরিক্রমায় বিলীন হয়ে গেছে। আর কিছু গ্রন্থঅদ্যাবধি সংরক্ষিত থাকলেও সেগুলো অন্যান্য গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ ইবনে জুরাইজের কিছু কিছু গ্রন্থ মুসান্নাফে আবদুর রাযযাকে শামিল হয়ে গেছে, যেমন শামিল হয়েছে মা’মার ইবনে রাশিদ আল আযদী (রহ.)-এর আল জামি। অবশ্য সেইসব গ্রন্থের কিছু পৃথকভাবেও প্রকাশিত হয়েছে। মোটকথা সবমিলিয়ে ওইসব গ্রন্থে বিবৃত বর্ণনাগুলো কোনো না কোনোভাবে আমাদের পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে, আল-হামদুলিল্লাহ!
তেরো
আল্লামা মুনযিরী (রহ.) (মৃ. ৬৫৬ হি.) এর আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব জগদ্বিখ্যাত একটি হাদিস সংকলন। পুণ্যকাজে উৎসাহ প্রদান এবং মন্দকাজ থেকে ভীতি প্রদর্শনবিষয়ক হাদীসগুলোই এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এই মূল্যবান গ্রন্থের একটি চমৎকার, বরং একক ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছেন আবু মুহাম্মদ হাসান ইবনে আলী ইবনে সুলায়মান আল-বদর আল-ফাইয়ূমী আলকাহিরী (রহ.) (জন্ম: ৮০৪ হি. = মৃত্যু: ৮৮৭ হি.)। ব্যাখ্যাগ্রন্থটির নাম হলো, ফাতহুল কারীবিল মুজীব আলাত তারগীব ওয়াত তারহীব। বহুদিন পর্যন্ত এটি লন্ডনের একটি লাইব্রেরিতে পাণ্ডুলিপি অবস্থায় পড়ে রয়েছিল। আল-হামদুলিল্লাহ এখন উন্নত কাগজে অমূল্য এই ব্যাখ্যাগ্রন্থটি ১৫ খণ্ডে ছেপে এসেছে এবং শিক্ষানুরাগীদের জন্য সংগ্রহ করা সহজ হয়ে গেছে। বস্তুত আল্লামা ফাইয়ূমী প্রণীত এইগ্রন্থটি হচ্ছে আত তারগীব ওয়াত তারহীব এর বিশদ একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ। এতে আল্লামা ফাইয়ূমী হাদীস থেকে উৎসারিত ও উদঘাটিত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলো সবিশেষ উল্লেখ করেছেন, দুর্বোধ্যশব্দগুলোর অর্থ ও ব্যাখ্যা পেশ করেছেন, একাধিক হাদীসের মধ্যকার অনুমিত বাহ্যবিরোধের সমাধান বের করেছেন এবং হাদীসের রাওয়ীগণ নিয়েও পর্যালোচনা করেছেন। তাছাড়া এই ব্যাখ্যাগ্রন্থে হাদীসের আলোকে ফিকহ ও আহকাম বিষয়ক অনেক জরুরি ও উপকারী তথ্যও এসে গেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, ব্যাখ্যাতা বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য প্রাচীন গ্রন্থ এবং দুর্লভ পাণ্ডুলিপি থেকেও অনেক তথ্যউদ্ধৃত করেছেন। এককথায় গ্রন্থটি হাদীসের তালিবুল ইলম এবং আহলে ইলমের জন্য ফলপ্রসূ সাব্যস্ত হয়েছে।
চৌদ্দ
কুরআনের নুকতাবিহীন তাফসীরগ্রন্থ!
নতুনত্বের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক একটা টান ও আকর্ষণ থাকেই। সেজন্য মানুষ চায় নতুন কিছু করতে, নতুন কিছু শিখতে, নতুন কিছু দেখতে, নতুন কিছু দেখাতে এবং নতুন কিছুর অভিজ্ঞতা অর্জন করতে!
অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতো মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের তাফসীর সংকলনেও কেউ কেউ নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। সেসবের একটি হলো নুকতাবিহীন অক্ষর বিশিষ্ট আরবী শব্দ দ্বারা তাফসীর রচনা করা। সাধারণত এজাতীয় কর্ম কৃত্রিমতা ও লৌকিকতাপূর্ণ হয়ে থাকে এবং সাবলীলতা ও প্রাঞ্জলতামুক্ত হয়। তেমনি যারা কুরআনের তাফসীর করতে গিয়ে এমন অভিনব উপায়ের আশ্রয় নিয়েছেন তারাও এর ব্যতিক্রম নয়।
হিন্দুস্তানী আলেম শায়খ ফয়জুল্লাহ ফয়জী (১০০৪ হি.) سواطع الإلهام لحَلِّ كلام الله الملك العلاَّم নামে নুকতাবিহীন অক্ষরে কুরআনের তাফসীর লিখেছেন। তেমনি দামেস্কের আলেম ও মুফতী শায়খ মাহমুদ ইবনে হামযা আল-হামযাওয়ী (১৩০৫ হি.) در الأسرار في تفسير القرآن بالحروف المهملة নামে নুকতাবিহীন অক্ষর দ্বারা সাজিয়ে কুরআনের তাফসীর সংকলন করেছেন। এটি দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম তাফসীরগ্রন্থটির তুলনায় দ্বিতীয়টি একটু বিশদ ও বিস্তারিত। তবে এরকম গ্রন্থে স্বভাবত জানার মতো নতুন কিছু পাওয়া না গেলেও লেখকের ভাষাজ্ঞান ও সাহিত্য পাণ্ডিত্যের জানান অবশ্যই দেয়। তবু কিছু কাজ যে ব্যতিক্রম নয় তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
পনেরো
ইবনুল মুবাররাদ লিখেন, বলা হয় যে, ইবনে তাইমিয়া (রহ.) এর শাগরেদদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফিকহবিদ হলেন ইবনু মুফলিহ, সবচেয়ে বড় হাদীসবিদ হলেন ইবনু আবদিল হাদী আরতাঁদের মধ্যে উসূলুদ্দীন সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞানী, হাদীস ও ফিকহের মাঝে সমন্বয়কারী এবং সবচেয়ে দুনিয়াবিমুখ হলেন ইবনুল কাইয়িম (রহ.)। (আল-জাওহারুল মুনাযযাদ, পৃ. ১১৪)
ষোলো
আল্লামা যাহিদ কাউসারী (রহ.) বলেন, হাদীসের তালিব যদি মুওয়াত্তা মালিকের রাওয়ীদের মাধ্যমে রিজালুল হাদীস বিষয়ে পড়াশোনার সূচনা করেন তবে ধীরে ধীরে তিনি যুগপৎহাদীস ও ফিকহ উভয় শাস্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ও পরিচিতি গড়ে তুলতে পারবেন। (মুকাদ্দামাতুল কাউসারী, পৃ. ৩৫৯)
মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ সা’দ বলেন, যে তালিবুল ইলম রিজালুল হাদীস সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে চান তিনি যেন মুয়াত্তা মালিক বেশি বেশি অধ্যয়ন করেন। কেননা এই কিতাবের হাদীসগুলোর সনদ তুলনামূলক ছোট ও সংক্ষিপ্ত, রাওয়ীগণ প্রসিদ্ধ ও বিশ্বস্ত। বস্তুত প্রচুর সহীহ হাদীসেরবর্ণনা তাঁদের সনদেই বিবৃত হয়েছে। সেজন্য এই বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জনে প্রথমে মুয়াত্তা দিয়ে শুরু করা উত্তম। (শারহুল মুকিযা, পৃ. ৫৮২)
সতেরো
মুসতালাহুল হাদীস বিষয়ে আল্লামা ইবনুস সালাহ প্রণীত গ্রন্থটি জগদ্বিখ্যাত এবং সংশ্লিষ্ট শাস্ত্রের অন্যতম উপকারী গ্রন্থ। তবে মজার ব্যাপার হলো, বিদ্বান মহলে বইটি একাধিক নামেই সমধিকপরিচিত। যেমন-
– মা’রিফাতু আনওয়ায়িল হাদীস
– উলূমুল হাদীস
– মুকাদ্দামাহ ইবনুস সালাহ
এগুলোর মধ্যে আবার তৃতীয় তারপর দ্বিতীয় নাম বেশি ব্যবহৃত। আর যে নামটি ইবনুস সালাহ বইয়ের জন্য রেখেছিলেন সেটা হচ্ছে…