তাবলীগ জামায়ায়াতে সঙ্কট: নেপথ্য কথা
দেশের শীর্ষ আলেমদের অনুরোধ ও পরামর্শমূলক বার্তা উপেক্ষা করেই চলছে একতরফা প্রচারণা। কাকরাইলে জনৈক মুরব্বী শূরা ও গুরুত্বপূর্ণ সাথীদের মজলিসে ঘোষণা দিয়েছেন, বিতর্কিত সাআদ সাহেবই বর্তমানে তাবলীগের বিশ্ব আমির। তাকে মানাই এখন ওয়াজিব। একথাই সংকটের মূল বিষয়। এক বিবৃতিতে তাবলীগ সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক মাওলানা আবদুল হামিদ এসব কথা বলেন। বিবৃতিতে দেশের ৪০ জন আলেমের বক্তব্য জানার পরও এধরনের ঘোষণা দেয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলা হয়, সকল যুগের সকল দ্বীনী কাজের মধ্যে কিছু না কিছু সাময়িক বিপর্যয় লক্ষ করা গেছে। কিন্তু দাওয়াত ও তাবলীগের বর্তমানের সংকট কঠিন অবস্থায় উপনীত। শেষ হযরতজী হযরত মাওলানা এনামুল হাসান সাহেব (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর প্রায় ১৮ বছর তাবলীগের মেহনত মোটামুটি সুষ্ঠুভাবে চলছিল। যদিও এ সময়ে তাবলীগের একক কোন আমির ছিল না। কিন্তু হযরত মাওলানা জোবায়েরুল হাসান সাহেব (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর কিছু অতি উৎসাহী ব্যক্তি নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করে মাওলানা সাআদ সাহেবকে আমির ঘোষণা করে। মাওলানা সাআদ সাহেবও এই বিষয়ে সমর্থন করেন। মূলত তা থেকে তাবলীগের সংকট মারাত্মক পর্যায় চলে যায়। ভারতের নিজামুদ্দীন মার্কাজের হাঙ্গামা হয়, পুলিশ পাহারা দিতে হয়। মাওলানা আহমদ লাট, মাওলানা ইবরাহীম দেওলা, মাওলানা ইয়াকুব এবং মাওলানা সাআদ সাহেবের ওস্তাদগণসহ শীর্ষ মুরব্বীরা সাআদ সাহেবকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে নিজামুদ্দীন মারকায ছেড়ে চলে যান। পৃথিবীর সকল তাবলীগের সাথীদের মাওলানা ইব্রাহীম দেওলা সাহেব ও মাওলানা ইয়াকুব সাহেব খোলা চিঠি লিখেন। যাতে নিজামুদ্দীন-এর সমস্যা এবং সমাধানের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। বাংলাদেশের ওলামাগণ নিজামুদ্দীন-এর শীর্ষ মুরব্বীদের চিঠি পেয়ে ফিকিরমন্দ হন। দরদমাখা অন্তর নিয়ে কাকরাইল মসজিদে ছুটে যান। কাকরাইল কে চিঠি লিখেন। মাওলানা সাআদকে বার্তা পৌঁছে দিতে বলেন যাতে উনি তাবলীগের শীর্ষ মুরব্বীদের পথে চলেন এবং তাবলীগের মেহনতকে সেই পথে চালান। কিন্তু সালাফি ও মওদুদি মতবাদে প্রভাবিত মাওলানা সাআদ সাহেবের অনমনীয়তার কারণে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসার মাওলানা সাআদ সাহেবের ভ্রান্ত মতবাদ ও কুরআন হাদীসের অপব্যাখ্যার ব্যাপারে কলম ধরেন। ওনার ব্যাপারে কঠিন অভিমত পেশ করেন। এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে দারুল উলুমকে সত্যায়ন করে চিঠি আসতে থাকে। বাংলাদেশের ওলামাদের থেকেও চিঠি যায়। আল্লামা আহমদ শফী সাহেব (দা. বা.) ব্যক্তিগতভাবে কাকরাইলের শূরাকে চিঠি লিখেন। ৪০/৪৫ জন শীর্ষ আলেমও তার নেতৃত্বে পত্র লেখেন। কাকরাইলের শূরার পক্ষ থেকে মাওলানা সাআদ সাহেবকে চিঠি লেখা হয়। যাতে উনি বাংলাদেশে আসার আগে দেওবন্দ ও নিজামুদ্দীনের শীর্ষ মুরব্বীদের সাথে সমঝোতা করে ফেলেন। আসলে মাওলানা সাআদ সাহেব-এর সাথে নিজামুদ্দীন মারকাযের শীর্ষ মুরব্বীগণের দারুল উলুম দেওবন্দ এবং বাংলাদেশের ওলামায়ে কেরামের কোন ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব নেই। কেউ তাঁকে নিজামুদ্দীনের মার্কাজ থেকে সরানোর দাবিও করছেন না। অন্য কাউকে আমির বানানোর চেষ্টাও করা হচ্ছে না। তাঁকে বলা হচ্ছে, তিনি যাতে নিজামুদ্দীন-এর শীর্ষ মুরব্বী (যাদের মধ্যে তার শ্রদ্ধেয় ওস্তাদগণও আছেন)দেরকে সাথে নিয়ে চলেন। পাশাপাশি দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসার সাথে সম্পর্ক রেখে আকাবিরদের পথে নিজেকে পরিচালিত করেন। এই ব্যাপারে ওনার অনুসারীগণ ওনাকে বুঝানোর দরকার। কিন্তু কাকরাইলের নাসিম সাহেব এবং ওয়াসিফ সাহেব সংশোধনের কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। বরং জনাব নাসিম সাহেব গত ০৩ জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে মাগরিবের পর কাকরাইল মসজিদে ভরা মজলিসে এই এলান করেন, মাওলানা সাআদ সাহেব এখন বিশ্ব আমির। ওনাকে মেনে চলা ওয়াজিব। এই ঘোষণা তাবলীগের সংকটকে কঠিন অবস্থার দিকে ঠেলে দেয়। যেখানে আরব, আফ্রিকা, পাকিস্তান ও ভারতের নিজামুদ্দীন মার্কাজের শীর্ষ মুরব্বীগণ ওনাকে আমির স্বীকৃতি দিচ্ছেন না, কারণ আমিরের ব্যাপারে কোন পরামর্শ করা হয়নি। কাকরাইলের শূরার সমন্বিত কোন সিদ্ধান্তও এ ব্যাপারে হয়নি। সেখানে এমন কঠিন পরিস্থিতিতে এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে এ ধরনের এলান সংকটকে আরো ঘনীভূত করবে।
দুয়েকজন ব্যক্তির হঠকারিতা ও ভ্রান্ত মতাদর্শের ফলে বিশ্ব তাবলীগ এখন হুমকির মুখে। দিল্লির সাআদ সাহেবের বাড়াবাড়ি ও ভুল মতবাদ বিশ্বব্যাপী তাবলীগকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সাআদ সাহেবকে বিশ্বের সকল দায়িত্বশীলরা সংশোধন ও নীতির ওপর ফিরে আসার আল্টিমেটাম দিলেও তিনি কারো কথাই মানছেন না। তিনি দারুল উলুম দেওবন্দসহ ভারত, পাকিস্তান, আরব, আফ্রিকা ও বাংলাদেশের সকল আলেমের সম্মিলিত প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইতোমধ্যে দেওবন্দ থেকে তার ভ্রান্ত মতাদর্শ ও ভুল কর্মপদ্ধতির ওপর বিশদ আলোচনাসহ ফতোয়া দেয়া হয়েছে। দেওবন্দের মুহতামিম আল্লামা আবুল কাসেম নোমানী, মাওলানা আরশাদ মাদানী, মাওলানা সাঈদ আহমদ পালনপুরী প্রমুখ আলেমদের প্রতি সাআদ সাহেবের অবজ্ঞা বিশ্ব মুসলিমের মনে চরম আঘাত হেনেছে। গত হজে বিশ্ব তাবলীগের মুরুব্বিরা সাআদ সাহেবের হঠকারিতার জন্যই তাকে সাথে রাখেননি। বাংলাদেশের সকল আলেম আল্লামা আহমদ শফী (দা. বা.)-এর নেতৃত্বে সাআদ সাহেবকে সংশোধনের পূর্ণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।
তাবলিগের চলমান সংকট এক মিনিটেই নিরসন সম্ভব
মাওলানা সাদ কান্ধলভি। তাবলিগ জামায়ায়াতের প্রধান মারকাজ দিল্লির নিজামুদ্দিনের জিম্মাদার তিনি। তাঁকে নিয়ে সৃষ্ট চলমান দ্বন্দ্ব-সংকট মাত্র এক মিনিটের বক্তব্যেই নিরসন করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন দেওবন্দের সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা আরশাদ মাদানি।
সমপ্রতি তিনি ইউরোপ সফরকালে লন্ডনস্থ তাবলিগ জামায়ায়াতের মারকাজে বক্তব্য প্রদানকালে এ কথা বলেন। তার এ বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ভাইরাল হয়ে যায়। মাওলানা আরশাদ মাদানির এ ভিডিওটি তাবলিগের চলমান সংকট নিরসনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন তাবলিগের আলেম-ওলামা ও সাথীগণ।
গত কয়েক বছর ধরে মাওলানা সাদ কান্ধলভির কিছু আপত্তিকর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী চরম উত্তেজনা ও অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত তাবলিগের বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু ২০১৮ সালে বাংলাদেশে আসা সত্ত্বেও তিনি বিশ্ব ইজতেমায় অংশ গ্রহণ করতে পারেননি।
মাওলানা আরশাদ মাদানি তার বক্তব্যে জানান, ‘দীর্ঘ দিন ধরে তাবলিগের অনেক আলেম মাওলানা সাদের আপত্তিকর বক্তব্যগুলো দেওবন্দের আলেমদেরকে শুনিয়ে এ ব্যাপারে ফতোয়া চেয়ে আসছিলেন। কিন্তু বিশেষ বিবেচনায় দীর্ঘ দিন ধরে দেওবন্দ থেকে কোনো ফতোয়া দেয়া হয়নি।
মাওলানা সাদের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে যখন তাবলিগের আলেম-ওলামা ও সাথীদের মধ্যে মতবিরোধ ছড়িয়ে পড়ে তখন দেওবন্দ থেকে মাওলানা সাদের ব্যাপারে ফতোয়া প্রদান করা হয়।
দেওবন্দের ফতোয়া প্রদানের পর মাওলানা সাদের কাছ থেকে একটি রুজুনামা দেওবন্দে আসে। দেওবন্দ কর্তৃপক্ষ সে রুজুনামার ওপর এ কথা লিখে দেয় যে, ‘ভবিষ্যতে আপনি এ ধরনের (আপত্তিকর) বক্তব্য থেকে বিরত থাকবেন এবং এ বয়ান দ্বিতীয়বার আর পেশ করবেন না’-এ মর্মে দেওবন্দ আপনার রুজুনামা গ্রহণ করেছে।
মাওলানা সাদের রুজুনামা ও দেওবন্দের শর্তসাপেক্ষে গ্রহণ করা রুজুনামার প্রতি উত্তর একজন বাহকের মাধ্যমে দিল্লির নিজামুদ্দিন পাঠানো হয়।
ঠিক সেদিনই একটি সংবাদ আসে যে, মাওলানা সাদ সাহেব ওই দিন ফজরের পর বয়ানের তার দেয়া আগের বয়ানের সমর্থনে বয়ান পেশ করেন।
এ সংবাদ শোনার পর দেওবন্দের মুহতামিম রুজুনামার উত্তর নিয়ে পাঠানো ব্যক্তিকে ফোন করে জানতে পারেন তিনি এখনো নিজামুদ্দিন পৌঁছাননি। তখন তাকে সেখান থেকেই দেওবন্দে ফিরে আসতে বলেন।
মাওলানা সাদ এবং দেওবন্দসহ বিশ্ব আলেম-ওলামাদের মাঝে দীর্ঘ দিন ধরে এ সংকট চলে আসছে। যা বর্তমানে কঠিন পরিস্থিতিতে গিয়ে পৌঁছেছে।
আর এ বিতর্কের কারণে দিল্লির নিজামুদ্দিনের সব পুরনো ও বয়স্ক আলেমগণ নিজামুদ্দিনের মারকাজ ছেড়ে চলে গেছেন। যাদেরকে মাওলানা সাদ সাহেব উস্তাদ হিসেবে স্বীকার করেন; অথচ তাদেরকে ফিরিয়ে আনতেও কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি।
মাওলানা আরশাদ মাদানি তাবলিগের লন্ডন মারকাজে ঘোষণা দেন, ‘দেখুন! আমি মনে করি, মাওলানা সাদ কান্ধলভি যদি মনে করেন যে এ আগুন নেভানো দরকার তাহলে তিনি এক মিনিটেই তা নেভাতে সক্ষম। তার জন্য দুই মিনিট লাগবে না। অথচ তিনি এ কথা বলে বেড়ান যে, আমাকে আমির না মানলে জাহান্নামে যাবে।’
আর বিশ্বব্যাপী সব আলেম-ওলামা ও তাবলিগের বিশ্ব মুরব্বিরা বলে আসছেন যে, তাবলিগ জামায়ায়াতকে শুরাভিত্তিকভাবে পরিচালনা করুন। যেহেতু তিনি তাবলিগের শুরা সদস্যদের একজন; তাই তিনি যদি বলেন, আসুন! শুরাভিত্তিক কাজ করি, তাহলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
তিন কারণে তাবলিগ জামায়ায়াতের সংকট
১. ঐতিহ্যের ‘শুরা’
ভেঙে একনায়কতন্ত্র
দাওয়াত ও তাবলিগের সংকট যেসব কারণে প্রকট আকার ধারণ করে, তার অন্যতম হলো, মাওলানা সাদ সাহেব সেখানে ঐতিহ্যবাহী শুরা ভেঙে আমিরতন্ত্র কায়েম করেন। এ বিষয়ে তাঁর একটি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি তোমাদের আমির। যে আমাকে আমির মানবে না সে জাহান্নামে যাবে।’
তাঁর এ বক্তব্য রয়েছে ইউটিউবে: www.youtube.com/watch?v=x19atoW-v24|
আসলে এ বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি তাবলিগের মধ্যে পরিবারতন্ত্র ও আমিরতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছেন। যদিও এ ঘটনার সূত্রপাত আরো বহু আগে। ১৯৬৫ সালে মাওলানা এনামুল হাসানকে আমির নির্বাচনের পর কিছু মেওয়াতি (ভারতে অবস্থিত তাবলিগের কেন্দ্রস্থল) ওই সময় বিরোধিতা করেন। তাঁরা মাওলানা সাদের বাবা মাওলানা হারুনকে আমির বানানোর দাবি জানান। মেওয়াতিরা বেশির ভাগই অশিক্ষিত ও সহজ-সরল। তাঁরা দাবি করেন যে তাবলিগের এ কাজ যেহেতু মাওলানা ইলিয়াস শুরু করেছেন, সুতরাং যোগ্য হোক অযোগ্য হোক, আমাদের এই বংশ থেকেই হতে হবে। পরে অবশ্য মাওলানা হারুন (রহ.) এনামুল হাসান (রহ.)-কে আমির হিসেবে মেনে নেন। কিন্তু ১৯৯৫ সালে এনামুল হাসান (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর ফিতনা অঙ্কুরিত হয় এবং মাওলানা জোবায়ের হাসান (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তা প্রকাশ্যরূপ লাভ করে। ফিতনার আশঙ্কা মাথায় রেখেই মূলত এনামুল হাসান (রহ.) যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও নিজের একমাত্র ছেলে মাওলানা জোবায়েরুল হাসান (রহ.)-কে তাঁর পরবর্তী আমির নির্বাচন না করে সারা বিশ্বের এই কাজ সামলানোর জন্য তিন দেশের যোগ্যদের সমন্বয়ে ১০ জনের ‘শুরা’ (পরামর্শ বোর্ড) বানিয়ে যান। ওই ১০ জন সর্বপ্রথম যে পরামর্শসভায় বসেন, সেখানে এটাই সিদ্ধান্ত হয়, একক কোনো আমির নয়, তিনজনের ফয়সালায় নিজামুদ্দিন পরিচালিত হবে। আর নিজামুদ্দিনে বায়াত বন্ধ থাকবে। তিনজন হলেন: ১. মাওলানা ইজহারুল হাসান, ২. মাওলানা জোবায়েরুল হাসান ও ৩. মাওলানা সাদ। এভাবেই প্রায় ১৯ বছর হজরতজি (রহ.)-এর বানানো শুরা বিশ্ব তাবলিগের কাজ পরিচালনা করতে থাকে। অন্যদিকে হজরতজির বানানো শুরা কর্তৃক মনোনীত শুরা সদস্যরা নিজামুদ্দিনের পরিচালনাকার্য শুরু করার পর ১৯৯৬ সালে মাওলানা ইজহারুল হাসান (রহ.) ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালের পর ওই শূন্যপদ পূরণের জন্য বারবার চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু মাওলানা সাদ তা বাস্তবায়ন করতে দেননি। ২০১৪ সালে মাওলানা জোবায়েরুল হাসান ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালের পর কোনো পরামর্শের ব্যবস্থা না করে মাওলানা সাদ একক আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন। মেওয়াত থেকে তাঁর অনুসারীদের নিজামুদ্দিন মারকাজে জড়ো করে রাখেন। তাঁর একক কর্তৃত্বে কাজ করার জন্য নিজামুদ্দিনের মুরব্বিদের ওপর বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। এর ফলে ২০১৫ সালের আগস্টে দোয়ার পর মোসাফাহা করাকে কেন্দ্র করে নিজামুদ্দিন মারকাজে প্রথম হাঙ্গামা হয়। অতঃপর ২৩ আগস্ট নিজামুদ্দিন বস্তির তাবলিগের জিম্মাদার সঙ্গীদের সঙ্গে মাশওয়ারার কক্ষে মাওলানা সাদের বাগিবতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে ওই মজলিসে মাওলানা সাদ নিজেকে আমির দাবি করেন। এতে পুরো বিশ্বের শান্তিপ্রিয় তাবলিগের সাথিরা অশান্ত হয়ে ওঠেন। এরপর কয়েকবার নিজামুদ্দিন মারকাযে মারধরের ঘটনা ঘটে। এমনকি একপর্যায়ে নিজামুদ্দিন মারকাজে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়, সারা বিশ্বের হেদায়েতের মারকাযে পুলিশ অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করে এর আশু সমাধানকল্পে নিজামুদ্দিন মারকাজ, দারুল উলুম দেওবন্দ ও বিশ্বের অন্য মুরব্বিরা উদ্যোগী হন। অতঃপর ২০১৫ সালের নভেম্বরে রায়বেন্ড ইজতেমায় একত্রিত হয়ে নিজামুদ্দিনের মুরব্বিরা মারকাজের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন এবং হজরতজি ইনামুল হাসান (রহ.) কর্তৃক গঠিত শুরাকে পূর্ণাঙ্গ করার প্রস্তাব দেন। দীর্ঘ পর্যালোচনার পর বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে শুরা পূর্ণাঙ্গ করার ফয়সালা হয়। অবশেষে ১৩ জনের শুরা গঠন করা হয়। কিন্তু মাওলানা সাদ শুরা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ভারত ফিরে যান। যারা মাওলানা সাদকে আমির মানবেন না, তিনি তাদের বলপ্রয়োগ করে নিজামুদ্দিন মারকাজ ত্যাগ করতে বাধ্য করেন। নিজামুদ্দিন মারকাযের যারা মূল দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা প্রায় সবাই মারকাজ ছেড়ে চলে যান, যার মধ্যে মাওলানা সাদের শিক্ষকরাও রয়েছেন। একে একে সবাই দিল্লি মারকাজ ত্যাগ করার পর ঐহিত্যবাহী ‘শুরা’ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়। এর জের ধরে বিশ্বব্যাপী তাবলিগ জামায়ায়াত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
গ্রন্থনা: মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ
২. সাদ কান্ধলভির বিতর্কিত বক্তব্য
বর্তমানে দাওয়াত ও তাবলিগে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তার অন্যতম কারণ হলো সাদ কান্ধলভি কুরআন-হাদিসবিরোধী মনগড়া বহু কথা প্রচার করেছেন। তাঁর সেসব বক্তব্য থেকে এখানে কয়েকটি কথা তুলে ধরা হলো—মসজিদের বাইরে হেদায়েত নেই: সাদ কান্ধলভি বলেন, ‘মসজিদে ঈমানের আসর কায়েম করা ফরজ। মসজিদের বাইরে অন্য কোথাও হেদায়েত পাওয়া যাবে না।’ (সূত্র: দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া: ১৫)
মুসা (আ.)-এর ওপর অপবাদ: সাদ সাহেব বলেন, ‘মুসা আলাইহিস সালাম নিজের জাতির মধ্যে দাওয়াতের কাজ ছেড়ে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কথা বলার উদ্দেশ্যে নির্জনবাসে চলে গিয়েছিলেন। যার ফলে পাঁচ লাখ ৮৮ হাজার বনি ইসরাইল গোমরাহ হয়ে যায় (মুরতাদ হয়ে যায়)।’ (সূত্র: দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া: ১৮)
তাবলিগের ৬ b¤^iB প্রকৃত ইসলাম: সাদ সাহেব বলেন, ‘যে ব্যক্তি এই ৬ নম্বরকে পূর্ণ দীন মনে করে না, সে হলো ওই ব্যবসায়ীর মতো, যে নিজেই নিজের দধিকে টক বলে বেড়ায়। এমন ব্যবসায়ী কখনো সফল হতে পারে না।’ (সূত্র: দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া: ১৭)
হেদায়েত আল্লাহর হাতে নেই: সাদ সাহেব মনে করেন, ‘হেদায়েত যদি আল্লাহর হাতেই থেকে থাকে, তাহলে তিনি কেন নবীদের প্রেরণ করেছেন!’ তাঁর এই বক্তব্য কুরআনের সুরা কাসাসের ৫৬ নম্বর আয়াতসহ বহু আয়াতবিরোধী।
ক্যামেরা মোবাইল পকেটে থাকলে নামায হবে না: তিনি বলেন, ‘আমার মতে ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল পকেটে রেখে নামায পড়লে নামায হবে না। ক্যামেরাযুক্ত মোবাইল থেকে দেখে দেখে কুরআন শোনা ও পড়া হারাম। এতে কুরআনের অবমাননা হয়। এর কারণে কোনো সওয়াব হবে না। যেসব আলেম তা বৈধ হওয়ার ফতোয়া দেন, তাঁরা উলামায়ে সু।’ (সূত্র: দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া: ১৬)
না বুঝে কুরআন পড়লে লাভ নেই: তিনি বলেন, কুরআন বুঝে পড়া প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ওয়াজিব। না বুঝে কুরআন পড়ার কারণে কোনো লাভ হবে না। এমন লোকের ওয়াজিব তরকের গুনাহ হবে।’ (সূত্র: দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া: ১৭)
তাঁর এই বক্তব্য মওদুদির বক্তব্যের প্রতিধ্বনি।
কুরআন পড়িয়ে অর্থ নেওয়া হারাম: তিনি বলেন, ‘বিনিময় নিয়ে কুরআনে কারিম পড়া নোংরা নারীর বিনিময়ের মতো। নোংরা নারী তার আগে জান্নাতে যাবে।’ (সূত্র: দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া: ১৬)
নিজামুদ্দিন থেকে বিচ্ছিন্ন হলে ধর্মত্যাগের গুনাহ হবে: তিনি বলেন, ‘সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) ঈমান আনয়নের পর মদিনা থেকে ফিরে নিজের এলাকায় যাওয়াকে ইরতিদাদ তথা ধর্মত্যাগ মনে করতেন। কাজেই নিজামুদ্দিন মারকাজ (তাবলিগের মূল কেন্দ্র) থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াকে সাধারণ বিষয় মনে করো না।’ (সূত্র: অব্যাহত বিভ্রান্তিকর বয়ান, পৃ. ২৫)
আসহাবে কাহফের সঙ্গী কুকুর ছিল না: তিনি বলেন, ‘আসহাবে কাহফের সঙ্গী জন্তুটি কুকুর ছিল না; বাঘ ছিল।’ (সূত্র: অব্যাহত বিভ্রান্তিকর বয়ান, পৃ. ৪৯)
তাঁর এ বক্তব্য পবিত্র কুরআনের সুরা কাহফের ১৮ b¤^i আয়াতবিরোধী।
নিজামুদ্দিন পৃথিবীর অন্যতম পবিত্র স্থান: তিনি বলেন, ‘এই স্থানটির (নিজামুদ্দিন) সম্মান করো। সমগ্র পৃথিবীর অবস্থা হলো এমন যে মক্কা-মদিনার পরে যদি এমন কোনো সম্মানিত জায়গা থাকে, যে জায়গাকে আদর্শ মনে করতে হয়, যে জায়গার অনুসরণ করতে হয়, যে জায়গাকে মহান মনে করতে হয়, তাহলে সেটি হলো এই নিজামুদ্দিন বাংলাওয়ালি মসজিদ।’
তাবলিগের মাশওয়ারা নামাযের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ: তিনি বলেন, ‘মুমিন যেভাবে গুরুত্বের সঙ্গে নামায আদায় করে, গুরুত্বের সঙ্গে মাশওয়ারায় (পরামর্শ) উপস্থিত থাকা এর চেয়েও অধিক জরুরি।’ (সূত্র: অব্যাহত বিভ্রান্তিকর বয়ান, পৃ. ৯)
তাবলিগের বাইরের কিতাব পড়া যাবে না: তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজের (তাবলিগ) সঙ্গে লেগে থাকতে হবে এবং মাওলানা ইলিয়াছ ও মাওলানা ইউসুফ সাহেবের কিতাব পড়বে, অন্য কোনো কিতাব পড়বে না।’
আল্লাহর যিকির করে কিছুই অর্জন হয় না: তিনি বলেন, ‘সকাল সকাল কুরআন শরিফ তিলাওয়াত করা এবং নফল নামায পড়ার একটা অর্থ বুঝে আসে। কিন্তু আল্লাহ আল্লাহ জিকির করে কী অর্জন হয়? কিছুই হয় না।’
বি. দ্র.: এসব বিষয়ে দলিল ও প্রমাণসহ বিস্তারিত জানতে পড়ুন লেখকের তাবলিগ সিরিজের বইগুলো।
বিশেষত পড়ুন লেখকের অনূদিত গ্রন্থ মাওলানা সাদ সাহেবের সঙ্গে আলেমদের দ্বিমত কেন গ্রন্থটি। মাকতাবাতুল আযহার, ঢাকা, এপ্রিল ২০১৮ বইটি প্রকাশ করেছে।
গ্রন্থনা: আবদুল্লাহ আল ফারুক
৩. তাবলিগের কাঠামো পরিবর্তন
তাবলিগ জামায়াতের সংকট ঘনীভূত হওয়ার আরো একটি কারণ হলো, সাদ সাহেব শত বছরের ঐতিহ্যবাহী তাবলিগের মূল কাঠামোতে মনগড়া ও অনর্থক পরিবর্তন এনেছেন। প্রথমেই তিনি নিজেকে সমগ্র উম্মতের ‘আমির’ বলে দাবি করেন। অথচ কোনো পরামর্শসভায় তাঁকে আমির বানানো হয়নি। বিশেষ বাহিনীর মাধ্যমে তিনি নিজামুদ্দিন দখল করেন। তাঁর ওস্তাদসহ সব আলেমকে সেখান থেকে বের করে দেন, বের করতে গিয়ে আলেমদের শরীর থেকে রক্ত ঝরাতেও কসুর করেননি। (সূত্র: দাওয়াত ও তাবলিগ, ড. মুহাম্মদ আবদুল হাননান, বিশ্বসাহিত্য ভবন, নভেম্বর ২০১৮ ভূমিকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ১৩)
তাবলিগ জামায়ায়াতের স্বপ্নদ্রষ্ট্র মাওলানা ইলিয়াস (রহ.), মাওলানা ইউসুফ (রহ.) এবং মাওলানা এনামুল হাসান (রহ.)-এর পদ্ধতির বাইরে তিনি নানা রকম তত্ত্ব ও বয়ান উপস্থিত করেন। পরামর্শের উদ্দেশ্য, তালিমের উদ্দেশ্য, ছয় সিফত ইত্যাদিতে তিনি এত কালের বর্ণনা বাদ দিয়ে নিজের থেকে নতুন নতুন জিনিস হাজির করেন। ১৯২০ সাল থেকে চলে আসা তাবলিগের ছয় মূলনীতির ব্যাখ্যা ছিল এক ধরনের। (দেখুন: ড. মুহাম্মদ আবদুল হাননানের কলাম, তাবলিগ জামায়ায়াতের ছয় মূলনীতি, দৈনিক কালের কণ্ঠ: ১৩-০১-২০১৭)
কিন্তু সাদ এসে এই মূলনীতি বদলে দেন। (দেখুন: ছয় নম্বর ও তাবলিগের বয়ান, মাওলানা লুত্ফর রহমান সংকলিত, মাকতাবাতুল মিসবাহ, ঢাকা, ২০১৬)
এত দিন তাবলিগ জামায়ায়াতের যে পরামর্শসভার পদ্ধতি ছিল, যা একেবারে চূড়া থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ছিল, তা-ও তিনি বাদ দিয়ে দেন।
ধীরে ধীরে সাদ সাহেব তাবলিগ জামায়ায়াতে ব্যাপক বিকৃতি ঘটাতে থাকেন। যেমন- দৈনন্দিনের মেহনতের মধ্যে দাওয়াত, তালিম ও ইসতিকবাল (পরবর্তী সময় নাম রাখা হয় ‘মসজিদ আবাদির মেহনত’) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে উমুমি গাশতের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে; অথচ এই উমুমি গাশতই ছিল তাবলিগের মেরুদণ্ড। এর ফলে এই মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। সমাজের বিশেষ লোকদের মধ্যে মেহনত করাকে ‘তবাকাতি মেহনত’ নাম দিয়ে এই মেহনতের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। ফলে উম্মতের বিশেষ শ্রেণি এই মেহনত থেকে মাহরুম হয়ে যায়। মাসতুরাতের তালিমের মধ্যে পাঁচটি বিষয় যুক্ত করা হয়। বিদেশি দেশগুলোতে চার মাসের পরিবর্তে পাঁচ মাসের তারতিব বানিয়ে দেওয়া হয়।
১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে মাওলানা ইজহারুল হাসান সাহেবের ইন্তিকালের পর সাদ সাহেব নিজামুদ্দিনের কোষাগারও হাতের মুঠোয় নিয়ে নেন। আয়-ব্যয়ের নিয়মমাফিক কোনো হিসাব-নিকাশ এখন আর তৈরি হয় না। এমনকি মজলিসে আমেলার সামনেও কোনো বিবরণী উপস্থাপন করা হয় না।
আরেকটি নতুন কাজ হলো, ফাজায়েলের কিতাবগুলোর তালিম বাদ দিয়ে মুনতাখাব হাদিসকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। অথচ কোনো সুরাই কখনো এ কিতাবকে জামায়ায়াতের সিদ্ধান্তকৃত নিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেনি। উপরন্তু এ কিতাবকে মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ (রহ.)-এর ‘চয়ন-নির্বাচন’ বলা হচ্ছে। বাস্তবতা হলো, এ বইয়ের হস্তলিপি বা পাণ্ডুলিপি আজ পর্যন্ত কেউ দেখেনি। কারো সঙ্গে এ নিয়ে তিনি আলাপ-আলোচনাও করেননি!
এত কিছু করেই তিনি থেমে যাননি। তিনি বদলে দেন নামাজের কাঠামোও! নিজামুদ্দিন মসজিদের এই জায়নামাজে তাঁর পরদাদা, দাদা ও পিতা; এমনকি নানাদের মতো ব্যক্তিদের যে পদ্ধতিতে নামায নিজে পড়েছেন, অন্যদের পড়িয়েছেন, এখানে-সেখানে বড় দাগে পরিবর্তন করেন এভাবে যে কাওমা (রুকু থেকে উঠে দাঁড়ানো অবস্থায়) ও জলসায় (দুই সিজদার মাঝখানে বসা অবস্থায়) সেই এমন সব দোয়া পাঠ করা শুরু করে দেন, যা হানাফি মাজহাব অনুসারে ফরজ নামাজে নয়; শুধু নফল নামাজে পড়া যাবে। এমন পরিবর্তনে গোটা জামায়ায়াত বিস্মিত হয়; কিন্তু কেউ ‘উফ’ বলার সাহস পায়নি। একজন এ ব্যাপারে কারণ জানতে চাইলে তিনি জবাব দেন, ‘আমি মুহাম্মাদি। আমি সুন্নাহ অনুসরণ করি।’ এভাবেই তিনি তাবলিগ ও নামাজের কাঠামো বদলে দেন।
(সূত্র: চৌধুরী আমানত উল্লাহ, সদস্য, মজলিশে আমেলা, মাদরাসায়ে কাশেফুল উলুম, বাংলাওয়ালি মসজিদ, নয়াদিল্লি; অনুবাদ: আবদুল্লাহ আল ফারুক, মাকতাবাতুল আসআদ, ঢাকা, ৫ আগস্ট ২০১৭)