আপনার জীবনে সময়ের মূল্য
মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ
আনমনে-অবহেলায় আমাদের সময় বয়ে যায়, আমরা সময়ের মূল্য দিই না, সময়ের মূল্য বুঝি না। কিন্তু ইসলামের সব কর্মপদ্ধতিতে সময়ের মূল্য অপরিসীম। মহান আল্লাহ বলেন, ‘সময়ের (মহাকাল) শপথ! মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত।’ (সুরা আসর : ১) নামায, রোযা, হজ, যাকাত—সব ইবাদতের সঙ্গে সময়ের নিবিড় যোগসূত্র বিদ্যমান। নামায সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই সুনির্দিষ্ট সময়ে নামায আদায় করা মুমিনের জন্য ফরজ করা হয়েছে।’ (সুরা নিসা : ১০৩) নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিয়তসহ পানাহার, কামাচার ও পাপাচারমুক্ত সংযম সাধনা এবং পবিত্র হজে নির্দিষ্ট স্থান ও সময়ে নির্ধারিত ইবাদত মুসলিম মননে নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতা শিক্ষা দেয়। মহান আল্লাহ এ জন্যই বলে দিয়েছেন, ‘আল্লাহ মানুষকে তাদের কৃতকর্মের জন্য শাস্তি দিলে পৃথিবীর কোনো জীবজন্তুকেই রেহাই দিতেন না; কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত তাদের অবকাশ দিয়ে থাকেন। তারপর তাদের সময় পূর্ণ হলে তারা জানতে পারবে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি সম্যক দ্রষ্টা।’ (সুরা ফাতির : ৪৫) অপকর্ম-অবহেলায় আমরা আমাদের জীবন-যৌবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করি, ইবাদতে ব্যয় করি না। অথচ সুস্থতা আল্লাহর নিয়ামত। এমনও দেখা যায়, যে দেশে বড় হওয়া, বেড়ে ওঠা, বাঁচার জন্য সে দেশে চিকিৎসা নেই, আর্থিক সামর্থ্য হারিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সাহায্য চাইতে হয়! আমরা আল্লাহর কাছে ধন-দৌলত, বাড়ি-গাড়ি চাই; কিন্তু এর চেয়ে বড় নিয়ামত ‘সুস্থতা’। তাঁর কাছে বেশি বেশি চাওয়া উচিত অসুস্থ, অক্ষম-অসহায় ও পরমুখাপেক্ষী না হয়ে আমাদের যেন হতাশ হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনতে না হয়। প্রিয় নবী (সা.) স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, ‘মানুষ দুটি নিয়ামতের ব্যাপারে বড়ই উদাসীন, তা হলো সুস্থতা ও অবসর।’ (সহীহ আল-বুখারী) তাই সময়ের মূল্য উপলব্ধি করা খুবই জরুরি। মানুষের সুকোমল মনোবৃত্তির অংশ তার সময়জ্ঞান। পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী, যাকে আবার আদর্শ প্রাণী হতে হয়। গরু ‘গরু’ হয়ে জন্মায় এবং গরুই থাকে। কিন্তু অন্য সব প্রাণীর মতোই মানুষ জন্মায়। পরে আবার তাকে ধর্ম, নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধের জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির যোগ্যতা অর্জনের মধ্য দিয়ে ‘মানুষ’ হতে হয়। প্রকৃত মানুষ হতে হলে ওই মানুষকে অবশ্যই সময়নিষ্ঠ, কর্তব্যপরায়ণ হতে হয়। দৈহিক জৈবিক তাড়না, বৈশিষ্ট্য ও স্বাভাবিকতায় মানুষ ও ইতর প্রাণীর মধ্যে প্রভেদ হলো: ইতর প্রাণীর যোগ্যতা প্রকৃতিগত; অন্যদিকে মানুষ তার যোগ্যতার মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়। কাজেই সময়ের মূল্য অনুধাবন ছাড়া মানবজনম বৃথা আর পাপ ও পতন হলো তার একমাত্র পরিণতি।
জীবন চলার বাঁকে বাঁকে সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ মানুষ ব্যাধি ও জরাগ্রস্ত হয়ে মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কাজেই সবাইকে সময় সচেতন হতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘তিনি দুর্বল অবস্থায় তোমাদের সৃষ্টি করেন; তারপর দুর্বলতার পর শক্তি দেন, আবার শক্তির পর দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য।’ (সুরা রুম : ৫৪) অন্য আয়াতে এসেছে : ‘তিনি তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, পরে শুক্রবিন্দু থেকে, তারপর জমাট রক্ত থেকে, তারপর তোমাদের শিশুরূপে বের করেন, তারপর হও যৌবনপ্রাপ্ত, তারপর উপনীত হও বার্ধক্যে। তোমাদের কারো বা আগেই মৃত্যু হয়ে যায়।’ (সুরা মুমিন : ৬৭, ৬৮) সুতরাং সময়ের সদ্ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।
জ্ঞানীদের কাছে দুনিয়ার মূল্য খুব সামান্য। যেমন- ‘আমি না লইলাম আল্লাজির নাম। না কইরলাম তার কাম/বৃথা কাজে হাছন রাজা দিন খুয়াইলাম।’ অথবা ‘ভালা কইরা ঘর বানাইয়া কয় দিন থাকমু আর/আয়না দিয়া চাইয়া দেখি পাকনা চুল আমার/এ ভাবিয়া হাছন রাজা ঘর-দুয়ার না বান্ধে/কোথায় নিয়া রাখব আল্লায় তাই ভাবিয়া কান্দে।’ (দেওয়ান হাছন রাজা) আসলে এগুলো নিছক কথার কথা নয়; বরং আমাদের লোক-ভাবনাগুলোও সমৃদ্ধ হয়েছে ইসলামের অমীয় বাণী দ্বারা। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘এমনভাবে দুনিয়ায় বসবাস করো, যেন তুমি একজন মুসাফির অথবা স্রেফ পথ অতিক্রমকারী।’ (সহীহ আল-বুখারী) হাদিসের পূর্ণ পাঠে জানা যায়, অসুস্থতার আগে সুস্থতা, মৃত্যুর আগে জীবন মূল্যবান এবং যখন সকাল হয় তখন সন্ধ্যা পর্যন্ত অথবা যখন সন্ধ্যা হয় তখন সকাল পর্যন্তেরও কোনো ভরসা নেই। হাদিসের শিক্ষা হলো, ‘নিজের হিসাব নিজে করা, হিসাব দেওয়ার আগে, আমলগুলোর পরিমাপ করা ওই দিনের আগে, যেদিন তা পরিমাপ করা হবে এবং মরার আগেই মরে যাওয়া।’ শুধু তা-ই নয়, অন্য এক হাদিস থেকে জানা যায়, ‘যৌবনকাল কিভাবে অতিবাহিত করা হয়েছে’, তার হিসাব পরকালে দিতে হবে।
আত্মপ্রত্যয় ও সময়জ্ঞান, জীবনসংগ্রাম-সাধনা সব কিছু পরস্পর সম্পৃক্ত। দেহ-আত্মায় সমন্বিত মানুষের নাম ‘আহসানি তাকবীম—অর্থাৎ ‘অসাধারণ অবয়ব ও বৈশিষ্ট্যের অপূর্ব সৃষ্টি।’ (ভাবসূত্র : সুরা তিন) তাই আত্মোপলব্ধির চেতনা উজ্জীবিত মনন খুঁজে ফেরে আপন সত্তায় —Know thyself, live and let others live, love and be loved… এমন অনুভূতি এবং তা-ই হলো মনুষ্যত্বের সাধনা।
‘আল্লাহ প্রেমে’ নিমগ্ন থাকাই মুমিনের বড় কর্তব্য। সময়জ্ঞান ও কর্তব্য চেতনার কারণেই মানুষের ভাগ্য স্থির হয়ে যায় এবং স্বয়ং মহাপ্রভু তখন বান্দার অভিপ্রায়কেই যথার্থতা দান করেন। আল্লামা ইকবালের ভাষায় : ‘খুদি কো কর বুলন্দ ইতনা/কি হর তাকদির ছে পহলে/খোদা বান্দেছে খোদ পুছে/বাতা তেরি রেজা কিয়া হ্যায়।’ অর্থাৎ ‘তোমার ব্যক্তিত্বকে এমন উন্নত করো যে তোমার ভাগ্য লেখার আগে স্বয়ং আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, বলো বান্দা হে, তোমার ভাগ্যে কী লিখব?’
সময় হলো এক অবাক বিস্ময় ও প্রতারণার খেলা! আমাদের প্রতিদিনের যাপিত জীবন খাতার ৮৬ হাজার ৪০০ সেকেন্ডের অব্যবহূত একটি সেকেন্ডও আমরা কি জমা রাখতে পারি? না, বরং তা তো হারিয়ে যায় মহাকালের অতলান্ত গভীরে। মহান আল্লাহ যে বলে দিয়েছেন, ‘কুল্লু নাফসিন জায়িকাতুল মাউত—অর্থাৎ প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ ভোগ করতে হবে। (আলে ইমরান : ১৮৫) তবুও মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও আশা ফুরায় না।
‘দ্য প্রিন্স’ গ্রন্থে এ জন্যই ম্যাকিয়াভেলি বলেন, Man do sooner forget the death of his father… (মানুষ দ্রুতই পিতৃবিয়োগ ব্যথা ভুলে যায়; কিন্তু কখনোই পৈতৃক সম্পত্তির মায়া ভোলে না)।
দুনিয়া খুবই ক্ষণস্থায়ী। হাদিসে আছে, ‘তিন কাজে বিলম্ব করতে নেই। যথা- ক) যখন নামাজের সময় হয়, খ) যখন জানাজার জন্য লাশ উপস্থিত করা হয়, গ) যখন পাত্রীর উপযুক্ত পাত্র পাওয়া যায়। অন্য বর্ণনায় আছে, গুনাহ হলে তাওবা করা এবং ঋণ থাকলে পরিশোধ করা।
প্রকৃতপক্ষে মানুষের জীবনে ওই কাজ আর কখনোই করা হয় না, যা সুযোগ ও অবসরের জন্য রেখে দেওয়া হয়। একটা কাজ শেষ না হতেই চলে আসে আরো হাজারো কাজ, অনেক অসুবিধা ও অজুহাত। বুদ্ধিমানরা প্রতিটি কাজ নগদে নগদ সেরেই ফেলেন না, বরং একটি কাজের ফাঁকে আরেকটি কাজ জোর করে হলেও ঢুকিয়ে দেন। দেখা যায়, দুটি কাজই তার হয়ে যায়। কিন্তু আফসোস আমার মতো অলসদের জন্য: ‘চৈত্র মাসে চাষ দিয়া না বোনে বৈশাখে/কবে সেই হৈমন্তিক ধান্য পেয়ে থাকে?/সময় ছাড়িয়া দিয়া করে পণ্ডশ্রম,/ফল চাহ্তেসেও অতি নির্বোধ, অধম।/খেয়া-তরী চলে গেলে বসে এসে তীরে;/কিসে পার হবে, তরী না আসিলে ফিরে?’ (রজনীকান্ত সেন)
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর