শরীরচর্চা মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়ায়
শরীরচর্চা আমাদের শরীরের সুস্থতার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত শরীরচর্চা করলে শরীর ভালো থাকে সেটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু যখন শুনি শরীরচর্চা করলে মস্তিষ্ক ভালো থাকে তখন একটু দ্বিধা জাগে, তাই না? করব শরীরচর্চা, শরীর ভালো থাকবে কিন্তু মস্তিষ্কও সুফল পাবে? কীভাবে সম্ভব?
শরীরচর্চার সুফল নিয়ে নানারকম গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন শরীরচর্চা শরীরের পাশাপাশি আমাদের মস্তিষ্ককেও ভালো থাকতে সহায়তা করে নানাভাবে। শুধু যে ভালো রাখে তাই না, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনেও শরীরচর্চার অবদান রয়েছে। শরীরচর্চার এই সুফলগুলো নিয়েই আজকের এই লেখা। চল দেখে আসি শরীরচর্চা কীভাবে আমাদের মস্তিষ্ককে ভালো রাখে।
১। স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি:
হিপোক্যাম্পাস হচ্ছে মস্তিষ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মানুষসহ সকল স্তন্যপায়ী প্রাণীতে মস্তিষ্কের উভয় পাশে একটি করে মোট দুটি হিপোক্যাম্পাস থাকে। মস্তিষ্কের এই অংশটি সেসকল ব্যায়ামে সাড়া দেয় যেগুলোতে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। এটি দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতি ধরে রাখতে সহায়তা করে।
বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন মানুষের উপর পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, যে সকল ব্যায়াম হৃদপিন্ডের সাথে সম্পর্কিত, সে সকল ব্যায়াম হিপোক্যাম্পাসকে উত্তেজিত। ও স্ফীত করে তোলে। নিয়মিত ব্যায়ামের ফলে হিপোক্যাম্পাসের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং এর ফলে স্মরণশক্তিও বৃদ্ধি পায়।
আচ্ছা, তোমরা কয়জন বই হাতে নিয়ে ঘরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে পড়াশুনা করেছ? খুব কম মানুষই পাওয়া যাবে যারা বই হাতে হাঁটতে হাঁটতে পড়েছে। কেন জিজ্ঞাসা করলাম তা বলার আগে একটা তথ্য দিই।
ব্যায়াম যে শুধু ধীরে ধীরে স্মরণশক্তি বৃদ্ধির জন্য কাজ করে তাই না, স্মরণশক্তির উপর ব্যায়ামের তাৎক্ষণিক প্রভাবও আছে। একদল জার্মান গবেষক গবেষণা করে দেখেছেন যে, বিদেশী ভাষা শিখার সময় সাইক্লিং করলে বা হাঁটলে ওই ভাষার শব্দ মনে থাকার প্রবণতা অনেক বেশি। তাই হাঁটতে হাঁটতে পড়াশুনা করার আইডিয়াটা মোটেও খারাপ না।
২। মনোযোগ বৃদ্ধি:
স্মরণশক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি শরীরচর্চা আমাদের মনোযোগ বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে। নেদারল্যান্ডের স্কুলের শিক্ষার্থীদের উপর এ নিয়ে গবেষণা করা হয়। সেই গবেষণায় দেখা যায় যে, এরোবিক বা কার্ডিও এক্সারসাইজ অর্থাৎ যে ব্যায়ামগুলো আমাদের হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়তা করে সেগুলো মনোযোগ বৃদ্ধিতেও দারুণ সহায়ক।
নেদারল্যান্ডের স্কুলের বাচ্চাদের ওপর করা এ গবেষণায় তাদের পড়ালেখার মাঝে ২০ মিনিটের জন্য ব্যায়াম করতে দেয়া হয়। এ থেকে দেখা যায় তাদের মনোযোগ ধরে রাখার প্রবণতা এবং ক্ষমতা দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে।
৩। মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি:
নিয়মিত শরীরচর্চা আমাদের শরীরের পাশাপাশি মস্তিষ্ককেও আরো ক্রিয়াশীল করে তোলে। যুক্তরাষ্ট্রের একদল গবেষক একদল শিক্ষার্থীর উপর গবেষণা চালিয়ে এই তথ্য বের করেন। শিক্ষার্থীদেরকে পুরো এক বছর ধরে প্রতিদিন ক্লাসের পরে খেলাধুলা করতে উৎসাহ দেয়া হয়।
এক বছর পর দেখা যায় তাদের শারীরিক ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের মধ্যে বাধা এড়িয়ে চলা, একসাথে একাধিক কাজ করার ক্ষমতা, কোন কিছু মনে রাখার ক্ষমতা ইত্যাদি বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রায় একই রকমের পরীক্ষা করা হয় জার্মান কিছু শিক্ষার্থীর উপর। দেখা যায় যে প্রতিদিন ১০ মিনিট করে খেলাধুলার ফলে তাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা, কোন কিছু মনে রাখার ক্ষমতা ইত্যাদি বৃদ্ধি পেয়েছে।
৪। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি:
শরীরচর্চা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোন চাপের মধ্যে যদি একটু ব্যায়াম করা যায় তবে তা ওই চাপ থেকে একটু স্বস্তি দেয়। ব্যায়াম আমাদের মস্তিষ্কের এন্ড্রোফিন নামক হরমোন ক্ষরণ করে যা এই স্বস্তি আনতে সহায়ক। এছাড়াও ব্যায়ামের মাধ্যমে আমাদের পেশিগুলো একটু শিথিল হয়, ফলে চাপ চাপ ভাবটা আর থাকে না।
চাপ থেকে মুক্তির পাশাপাশি ব্যায়াম আমাদের বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি দেয়। ব্যায়ামের মাধ্যমে নিঃসৃত এন্ড্রোফিন হরমোন মস্তিষ্কে ক্রিয়া করে আমাদের উদ্দীপ্ত করে এবং ভালো থাকার অনুভূতি তৈরি করে। এছাড়াও ব্যায়াম করার সময় আমাদের ব্যায়াম করার দিকেই মনোযোগ দিতে হয় কিছুটা সময় হলেও। ফলে এইটুকু সময়ে আমাদের মনে যে নেগেটিভ চিন্তাগুলো আসতো তা আর আসে না। এর ফলে বিষণ্ণতাও আস্তে আস্তে কেটে যায়।
৫। সৃজনশীলতা বৃদ্ধি:
ব্যায়ামের মাধ্যমে সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়। গবেষক Lorenza Colzato-এর মতে —প্রতিদিন ব্যায়াম করা সৃজনশীলতা বৃদ্ধির একটি সহজ ও সঠিক উপায়।’ তিনি তাঁর যে গবেষণা থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন সেই গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছিল কিছু ক্রীড়াবিদ ও কিছু সাধারণ মানুষের ওপর। তিনি এলোমেলোভাবে ৪৮ জন ক্রীড়াবিদ বাছাই করেন যারা সপ্তাহে অন্তত চারবার ব্যায়াম করে।
একইভাবে তিনি ৪৮ জন সাধারন মানুষ বাছাই করেন যারা নিয়মিত ব্যায়াম করেন না। তাদেরকে বলা হয় লেখা ব্যতীত কলমের আর কী কী ব্যবহার হতে পারে তা লিখতে। আরেকটি পরীক্ষা হিসেবে তাদেরকে তিনটি শব্দ দিয়ে বলা হয় তিনটি শব্দের সাথেই যুক্ত করা যায় এমন একটি শব্দ বের করতে।
পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় যে, যেসকল মানুষ সপ্তাহে অন্তত চারদিন ব্যায়াম করেছে অর্থাৎ ক্রীড়াবিদরা সাধারণ মানুষের তুলনায় ভালো করেছে। এ থেকেই বুঝা যায় যে, ব্যায়াম সৃজনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
৬। মস্তিষ্কের বিশ্রাম:
ব্যায়াম মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হ্যাঁ, সত্যিই তাই। ব্যায়াম মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেয় একটু চালাকি করে। ব্যায়াম করার ফলে শরীরের পেশীগুলো শিথিল হয়ে পড়ে যার ফলে শরীর বিশ্রাম চায়। আর সেই বিশ্রাম হল ঘুম।
প্রতিদিন পরিমিত মাত্রায় ব্যায়াম ঘুমের ওষুধের মত কাজ করে, এমনকি ইনসোমনিয়া রোগীর ক্ষেত্রেও। প্রতিদিন ঘুমের ৫-৬ ঘণ্টা আগে ব্যায়াম করলে তা শরীরকে উদ্দীপ্ত করে শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে। পরে যখন আবার শরীর পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে তখন শরীর সংকেত পাঠায় যে তার বিশ্রাম প্রয়োজন।
এভাবে ব্যায়াম মানুষকে ঘুমাতে সাহায্য করে। আর ঘুম মানেই মস্তিষ্কের বিশ্রাম। এভাবেই ব্যায়াম চুপিচুপি আমাদের মস্তিষ্ককে বিশ্রামের সুযোগ করে দেয়। ফলে মস্তিষ্ক ভালো ও কর্মক্ষম থাকে।
শারীরিক সুবিধার পাশাপাশি ব্যায়াম আমাদের মানসিকভাবেও শান্তি প্রদান করে। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কীভাবে ব্যায়াম ব্যবহার করে মানসিকভাবে দুর্বল মানুষের চিকিৎসা করা যায় তার উপায় বের করতে।
আর সাধারণভাবে ব্যায়াম আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও মস্তিষ্কের ওপর কেমন প্রভাব ফেলে তা তো দেখলামই উপরে। তাহলে এখন থেকে পড়ালেখার পাশাপাশি একটু একটু করে শরীরচর্চা শুরু করে দাও, নাকি? তাহলে শারীরিক আর মানসিক, দুই দিক দিয়েই সুস্থ থাকতে পারবে।