বৃহস্পতিবার-২২শে জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি-২২শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বাংলার আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা: সতর্ক হওয়া সময়ের দাবি

বাংলার আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা: সতর্ক হওয়া সময়ের দাবি

বাংলার আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা: সতর্ক হওয়া সময়ের দাবি

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী

 

মুসলিম জাতির জীবন কোনো দিনই কুসুমাস্তৃর্ণ ছিল না। সেই শুরু থেকে খোদাদ্রোহী শক্তি ইসলামের আলোকে ফু দিয়ে নিভিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। পারেনি, তবে চেষ্টাও বাদ দেয়নি। নিকট অতীতে ফ্রান্স ও ব্রিটেন সাম্রাজ্যবাদ বিস্তার করেছে। মুসলিম বিশ্বকে আদর্শিকভাবে তছনছ করে দিয়েছে। যে ফিতনা থেকে মুসলমানরা এখনো বের হতে পারেনি। সোভিয়েত বিপ্লবের সময় মূলত মুসলমানদের বিরুদ্ধেই পরিকল্পিত ধ্বংসলীলা চালানো হয়। ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবে কমিউনিস্টরা ৮০ লক্ষ মুসলমানকে হত্যা করেছে। ধ্বংস করেছে অসংখ্য মসজিদ মাদরাসা ও খানাকা। হাদীস ও ফিকহর লালনক্ষেত্র মুসলিম মধ্য এশিয়া নির্মম পরিণতির শিকার হয়। বোখারা, সমরকন্দ ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হয়। চীনা বিপ্লবের সময় প্রায় ৫ কোটি মুসলমানকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। তুরস্কে ১৯১৪ থেকে ২০০১ পর্যন্ত চালানো হয় সেক্যুলারিজমের স্টিমরোলার। ৬ শতাধিক বছরের তুর্কি খেলাফত ধ্বংস করে নবজাগরণের নামে চালানো হয় ইসলাম ও মুসলমান নির্মূলের নজিরবিহীন বুলডোজার। দুনিয়ার সকল প্রান্তের মুসলমানরা এসব নির্মমতা ও পাশবিক ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে শংকিত। দূর অতীতে যেমন তারা নারকীয় অত্যাচার দেখেছে মুসলিম স্পেনে। ৮ শতাধিক বছরের শাসন উন্নয়ন ও অবদান সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িকতার ছোবল থেকে তারা নিরাপদ হতে পারেনি। ইউরোপ ছেড়ে ফিরে আসতে হয়েছে আরব আফ্রিকান ভূখন্ড। প্রাণ দিতে হয়েছে লাখো মুসলমানকে। মসজিদে বন্দী করে আগুনে পোড়ানো হয়েছে। প্রতারণা করে মুক্তির নামে ফুটো জাহাজে চড়িয়ে ভূমধ্যসাগরে ডুবিয়ে মারা হয়েছে হাজার হাজার মুসলিম নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও যুবককে। স্পেনের শেষ শাসক বু আবদেল (মূল আরবী আবু আবদুল্লাহ) যখন চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে মরক্কো ফিরে আসেন, তখন তার বৃদ্ধা মা মন্তব্য করেছিলেন, ৮০০ বছর আগে তোমার পূর্বসূরিরা (সেনাপতি তারেক ইবনে যিয়াদ, মুসা ইবনে নুসায়ের, আবদুর রহমান আদ দাখিল, ইউসুফ ইবনে তাশফিন প্রমুখ) বুকের রক্ত দিয়ে যে মহাদেশটি পদানত করেছিলেন তোমরা রক্ত দিতে ভুলে গিয়েছিলে বলেই নারীদের মতো চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে আফ্রিকায় ফিরে এসেছো। এ কান্নার চেয়ে খুনে রাঙ্গা শহীদ পুত্রকে দেখা আমার জন্য অধিক কাম্য ছিল।

ইতিহাসে মুসলিম নিধনের যত চিত্র আছে তা ফিরে দেখার মতো সহন ক্ষমতা আর মুসলিম জাতির নেই। দৃষ্টান্তস্বরূপ সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা নির্যাতন বিশ্ববাসী চোখের সামনে রয়েছে। যারা আল্লাহকে ভয় পায় না, তারা কী পরিমাণ হিংস্র ও পাশবিক হতে পারে তা কল্পনাও করা যায় না। সোভিয়েত অঞ্চলের মুসলিম দেশগুলোতে যখন সমাজতান্ত্রিক বিধি-বিধান চালু হলো (আল্লাহ না করুন, এ নাস্তিক্যবাদী আদর্শ বাংলাদেশেও তার স্বরূপে কোনোদিন আত্মপ্রকাশের সুযোগ না পায়। যদিও কৌশলে আমাদের সংবিধানেও অন্য অর্থে এবং বিনাপ্রয়োজনে সমাজতন্ত্র ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা ছিল শোষণহীন সমাজ, সমাজতন্ত্র নয়।) তখন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে মুসলমানদের বলা হলো, আল্লাহকে অস্বীকার করতে হবে। নাস্তিক হতে হবে। কেননা, কার্ল মার্কসের মতে ‘এথেইজম ইজ আনসেপারেবল পার্ট অব মার্কসিজম’ মানে নাস্তিকতা মার্কসবাদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সুতরাং সোভিয়েত মুসলমানদের নাস্তিক হতে হবে। শরীয়ত ত্যাগ করে দেশীয় বিধান পালন করতে হবে। জাতীয় ঐক্যের জন্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যোগ দিতে হবে। নিয়মিত মদ পান, শুয়রের মাংস ভক্ষণ, নারী পুরুষ অবাধ যৌনাচার ইত্যাদিতে শরীক হতে হবে। ধর্ম-কর্ম করলে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় মৃত্যুদণ্ড। নামায, রোযা, হজ, যাকাত, টুপি-দাড়ি, বোরকা হিজাব, কুরআন-হাদীস সবই নিষিদ্ধ ও বেআইনি। আরবি ও ইসলামবোধক শব্দের ব্যবহার এবং নাম রাখা দণ্ডনীয় অপরাধ। সমাজতন্ত্রের এই ঝড় মোকাবেলার শক্তি ও প্রস্তুতি মুসলমানদের ছিল না। যদিও তাদের সংখ্যা কম ছিল না, মসজিদ মাদরাসা কম ছিল না, ওলামা-মাশায়েখ কম ছিল না, দীনি প্রোগ্রাম কম ছিল না, খানাকা-দরবার কম ছিল না, ঈমান-আমলের কাজও বন্ধ ছিল না। তথাপি ঐক্য ও দীনের পরিপূর্ণ বুঝ না থাকায়, সংগঠন ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব না থাকায়, জিহাদ ও কুরবানীর মনোভাব না থাকায় এই গজব তাদের ওপর এসে যায়। দীর্ঘ ৭০ বছর ভোগান্তির পর তারা একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ পায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গে, সমাজতন্ত্রের পতন হয়, আর মুসলিম দেশগুলি একরকম রাহুমুক্ত হয়। পরিপূর্ণ ইসলামি জ্ঞান চর্চা, ঈমান-আমলের আদর্শ মেহনত, ঐক্যবদ্ধ দীনি সংগ্রাম পরিচালনা ও সামগ্রিক ইসলামি বিপ্লব সংঘটন সম্ভব হলে এদেশগুলি তাদের সোনালী দিন ও হারানো গৌরব ফিরে পাবে।

সমাজতন্ত্রের পতনের কিছুদিন আগে বাংলাদেশের একটি ওলামা-মাশায়েখদল সোভিয়েত সফরে গিয়েছিলেন। আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে তারা যখন অবস্থান করছিলেন, তখন তারা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন সমাজতন্ত্রের দিন শেষ। ভেতরে ভেতরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘুণে খেয়ে ফেলেছে। খতীব উবায়দুল হক (রহ.) ও শায়েখ ইসহাক ওবায়দী (দা. বা.) এ সফরে ছিলেন। তাদের কাছে বহু কথা আমরা তখন শুনেছি। সোভিয়েত রাশিয়ায় প্রথম তাবলীগি জামাত ঢাকার কাকরাইল থেকে যায়। এদের পাঠিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বলেছিলেন, প্রত্যেকে একটি কুরআন শরীফ সাথে নিয়ে যান। আগ্রহী মুসলমানদের দিয়ে আসবেন। সেখানে কুরআন পাওয়া যায় না, তাবলীগি জামাতের পক্ষে কুরআন পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। কাকরাইলের মুরব্বী মাওলানা হরমুজুল্লাহ রহ. খাস দোয়া করে জামাতটি প্রেরণ করেন। শায়েখ ওবায়দী তার ভ্রমণকাহিনীতে লিখেন, ‘৭০ বছরের দমন-পীড়নের পরেও সোভিয়েত নাগরিকরা তাদের ঈমান, ইসলাম, দীন-ধর্ম ধরে রেখেছিল। তিনি সরকারী গাইড তরুনীকে ফাঁকি দিয়ে একটি স্কুলে ছোট্ট শিশুদের সাথে আলাদাভাবে দেখা করেন। রুশ ভাষা জানা না থাকায় তিনি হালকা ইংলিশে তাদের সাথে মতবিনিময় করেন। একসময় ছাত্রদের আগ্রহে তিনি তার ভিজিটিং কার্ড শিশুদের দিতে থাকেন। হঠাৎ একটি শিশু অন্য একটি শিশুকে দেখিয়ে বলে উঠে, কাপির, কাপির, কাপির। (অর্থাৎ এই ছাত্রটি নাস্তিক কমিউনিষ্ট, আপনার মতো বুযুর্গের কার্ড পাওয়ার যোগ্য সে নয়। তাছাড়া আপনি যে নিয়ম ভঙ্গ করে গাইড কাম গোয়েন্দা তরুণীকে ফাঁকি দিয়ে আমাদের সাথে কথা বলছেন এ কার্ডের মাধ্যমে বিষয়টি এই ছাত্রের পরিবারের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের কানে যাওয়া সম্ভব।) শায়েখ ওবায়দী বলেন, শিশুদের মধ্যে দীনি চেতনাবোধ দেখে আমরা সেদিন বুঝেছিলাম, অত্যাচার করে ঈমান মিটিয়ে দেওয়া যায় না। আমার এক রুশ বন্ধু একবার আমাকে বলেছিলেন, বিপ্লবের পর আমাদের গ্রামে আমার বাপ-দাদাদের একজন মুরব্বী বুড়ি কুরআন ও দীনি শিক্ষা দিতেন। কম্যুনিষ্টদের ভয়ে গ্রামের ধানক্ষেতের পাশে ঝোঁপের আড়ালে মাটির নিচে গর্ত করে গোপন মক্তব তৈরি করা হয়েছিল। বুড়ি সেখানেই গ্রামের সব শিশুকে ঈমান ও ইসলামের সামান্য আলো দান করতেন।

একই চিত্র আমরা দেখি সেক্যুলার বিপ্লবের পর তুরস্কে। সেক্যুলারিজম অর্থ ও নট রিলেটেড উইথ এনি স্পিরিচুয়াল এন্ড রিলিজিয়াস ম্যাটার’। ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার সাথে যে আদর্শের কোনো সম্পর্কই নেই। এক কথায় ধর্মহীনতা। (আল্লাহ না করুন, কোনোদিন সেক্যুলারিজম তার স্বরূপে আমাদের বাংলাদেশে তার কার্যক্রম না চালাক। যদিও বিনাপ্রয়োজনে অন্য অর্থে এটিও আমাদের সংবিধানে ঢুকে গেছে। অবশ্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এই সেক্যুলারিজমের অর্থ নিয়েছেন দেশের সকল ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।) সেক্যুলারিজম তুরস্কে কী পরিমাণ রক্ত ঝরিয়েছে, কত লক্ষ দীনদার মানুষকে হত্যা করেছে, কত সংখ্যক আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও দীনদার জনগণকে শহীদ করেছে এর কোনো সঠিক সংখ্যা কোনোদিনই জানা যাবে না। মাদরাসা, মসজিদ, মক্তব, খানাকা বন্ধ। আযান, নামায, কুরআন, আরবী ভাষা, ইসলামী পরিভাষা, হিজাব-নিকাব-বোরকা নিষিদ্ধ। এ অবস্থাও কম বেশি ৭০ বছর চলেছে।

তুরস্কেও অবস্থা পর্যালোচনা করলে বোঝা যাবে সেক্যুলারিজম কত বিভীষিকাময় একটি ফিতনা। তার উদ্দেশ্য মানুষকে ধর্মহীন করে দেওয়া। যদিও মুখে বলা হয় ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করা। একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় হিসাবে ধর্মকে থাকতে দেওয়া। কিন্তু এটা তাদের মূল কথা নয়। নতুবা তুরস্কে এমন হৃদয়বিদারক ইতিহাস রচিত হত না। তুরস্কে প্রায় ৭০০ বছর দীনি ভাবধারা তৈরির পর ৭০ বছরে এ ভাবধরাকে আকাশ থেকে পাতালে নামিয়ে আনা ছিল সেক্যুলারদের কাজ। মক্কা-মদীনার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা, আরবীতে আযান নিষিদ্ধ করা, ইসলামীর প্রতিটি চিহ্ন একে একে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া, শরীয়তী শাসনব্যবস্থা থেকে দূরে সরে গিয়ে ইউরোপের অন্ধ অনুসরণ, নগ্নতা, বেহায়াপনা ও নাস্তিকতার ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের টেক্কা দেওয়া এসব কিসের ধর্মনিরেপেক্ষতা। এগুলোর নাম শুধুই হওয়া উচিত ধর্মহীনতা। তুরস্কে এই অন্ধকার যুগ পাড়ি দিতে যে কষ্ট ও ত্যাগ সেদেশের তাওহীদি জনতাকে করতে হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ দুনিয়ার দেশে দেশে আলেম ও দীনদার মানুষদের জানা একান্ত কর্তব্য। সমাজতন্ত্র ও সেক্যুলারিজম, নাস্তিকতা ও ধর্মহীনতা, ইসলাম ও মুসলমানদের সাথে কী আচরণ করতে পারে তা যদি মুসলিম জাতি ভালো করে না জানে তা হলে এ দুটি ধ্বংসাত্মক আদর্শের সাথে কী আচরণ করতে পারে তারা আপোস করতেও পারে। যা হবে নিঃসন্দেহে ইসলাম ও মুসলমানদের ধ্বংসের কারণ। (আল্লাহ বাংলাদেশকে এ দুুটি ক্ষতিকর আদর্শের প্রকৃত চেহারা ও চরিত্র থেকে বিশেষ অনুগ্রহে রক্ষা কারুন। আমাদের সংবিধানে যে অর্থে এ দুটিকে শামিল করা হয়েছে যেন কোনো কেউ ভুল করেও এর চেয়ে বেশি না বোঝেন এবং মুসলমানদের ক্ষতির কাণ না হন।)

তুরস্কের অন্ধকার দিনে দুঃখভারাক্রান্ত মুসলমানদের মনে আশাবাদ জাগ্রত রাখার মহান কাজটি যেসব হাতেগোনা আলেম ও বুযুর্গ ব্যক্তিরা করেছেন তাদের মধ্যে শায়খ বদিউজ্জামান সাঈদ নূরসী অন্যতম। তিনি তার বিশেষ আধ্যাত্মিক যোগ্যতা ও খোদাপ্রদত্ত তাওফীকের দ্বারা তুরস্কের উদীয়মান প্রজন্মকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেন। তার জীবনে সামরিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন হওয়া, ফাসির আদেশ হওয়া, নির্যাতিত হওয়া, শহর থেকে শহরে ছুটে বেড়ানো এবং মার্শাল কোর্টের বিচারকের সামনে ইসলামের কঠিন সত্য কথা অনন্য সাহসিকতার সঙ্গে উচ্চারণ আধুনিক ইসলামী জাগরণের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। তার লুমআত ও লিসালাতুন নূর সিরিজ নাস্তিক মুরতাদ পরিবেষ্টিত মুসলিম সমাজের জন্য আসমানী আলোর মতো। তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তুরস্কের অন্ধকার দিনে আমি একসময় কিতাবাদি মুতালাআ করছিলাম। একদিন একটি বই খোলামাত্রই যে পৃষ্ঠাটি আমার সামনে এল তাতে দেখতে পেলাম ইমামে রাব্বানী মুজাদ্দিদে আলফে সানী আহমদ সরহিন্দী (রহ.)-এর নাম। এরপর থেকে আমি তার রুহানী ও বাস্তব ক্ষেত্রে সংস্কারমূলক আন্দোলনের ফয়েজ অনুভব করতে থাকি। চরম অসুস্থ অবস্থায় তিনি আত্মগোপনে এক দূরবর্তী শহরের হোটেলে রাত্রি যাপন করছিলেন। সেখানে শত শত ইসলামপ্রিয় যুবক তার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য পাগলপারা হয়ে ভীড় জমিয়েছিল। সে রাতেই তার ইন্তেকাল হয। তুর্কি সরকার গোয়েন্দাদের মাধ্যমে এ খবর পেয়ে তার লাশ তুলে নিয়ে যায় এবং ভক্ত জনতা যেন তার জানাযায় শরীক হতে না পারে কিংবা পরেও তার কবরে এসে পরিবর্তনের চেতনা শাণিত করতে পা পারে সেজন্য গভীর রাতে সেক্যুলার আর্মিরা কোনো এক অজ্ঞাত পাহাড়ি উপত্যকায় গোপনে তার দাফন সেরে ফেলে। শায়খ বদিউজ্জামান সাঈদ নূরসীর কবরের চিহ্নটুকুও মুঝে ফেলা সম্ভব হয়েছে তবে তার ঈমানী চেতনা, আধ্যাত্মিক প্রেরণা, খোদাদত্ত সাহস ও শক্তিকে নির্মূল করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তুরস্কে সেই কালো দিনের অবসান এ ধরনের আল্লাহওয়ালা আদর্শিক লোকশিক্ষকদের মাধ্যমেই আল্লাহর রহমতে সম্পন্ন হয়েছে। এখানে যে মনীষীর নাম উল্লেখ করতেই হয় তিনি হলেন শায়খ মাহমুদ এফেন্দী। শায়খুল ইসলাম আল্লামা তকী উসমানী ও আল্লামা সায়্যিদ সালমান হোসাইনী নদভী যাকে তুরস্কের কাসেম নানুতভী নাম দিয়েছেন। অশীতিপর এ বুযুর্গ বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও পরিবর্তনের নায়ক রজব তায়্যেব এরদোগানের শায়খ। তার কাছেই তিনি তাদের ভাষায় ইমাম হাতিব কোর্স করেন। শায়খ এফেন্দী নিজেই তার আত্মজীবনীতে বলেছেন, তুরস্কে সেক্যুলারিজম কায়েম হওয়ার পর লাখো আলেমকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। আমি তখন শিশু ও তরুণদের দীনি শিক্ষা দিতাম। কুফুরী মতবাদের বিরোধিতা করতাম। তবে গ্রামে ছদ্মবেশে ক্ষেতে কাজ করা কৃষক ও মজুরের বেশে। জমিনে কাজ করতাম পাশাপাশি তাদের কুরআন-সুন্নাহর তালিম দিতাম। আর্মির গাড়ি এলে আমরা অন্য কথাবার্তা বলতে শুরু করতাম অথবা মূর্খ চাষীদের মতো ভাণ ধরতাম। একবার আমার এক সহকর্মী যুবক আলেমকে আর্মিরা শহীদ করে দেয়। ভীষণ মন খারাপ হওয়ায় আমি অন্য শহরে চলে যাই। দীনের এত ক্ষতি তারা করেছিল যে আপনারা শুনে আশ্চার্যযান্বিত হবেন, আমি এক মসজিদে ১৮ বছর ছিলাম একদিনও কোনো নামাযী আসেনি যে জামাত পড়ব। শেষ দিকে কিছু কিছু লোক সাহস করে নামায পড়ত। সে এলাকায আমি ৪০ বছর কাটাই। আমাদের নীরব কান্না, দুয়া-মোনাজাত ও টুটা ফাটা মেহনতে আল্লাহর রহমত নাযিল হয়। লাখো আলেমের রক্ত ও কোটি মুসলমানের অশ্রু নতুন যুগের সূচনা করে।

গত ২২ বছরে তুরস্ক অনেক পাল্টে গেছে। আগে পাশ্চাত্যের আজ্ঞাবহ তুর্কি সেনাবাহিনী শুধু আরবীতে আযান চালুর অপরাধে(?) একজন রাষ্ট্রনায়ককে ফাঁসি দেয়। আরেকজনকেও দীনি ভাবধারা পোষণের অপরাধে সরিয়ে দেয়। এরপর নাজিমুদ্দীন আরবাকান রাজনৈতিক ময়দানে ইসলামের জন্য কৌশলে কিছু জায়গা খালি করেন। আরও বেশি কৌশল কাজে লাগিয়ে তরই হাতে গড়া রাজনৈতিক কর্মী ও শায়খ মাহমুদ এফেন্দীর আধ্যাত্মিক শিষ্য রজব তায়্যেব এরদোগান বহু দূর এগিয়ে যান। দুনিয়ার সব ইসলামবিদ্বেষী শক্তি ও মুসলিম নামধারী স্বার্থবাদী চক্র ঐক্যবদ্ধ হয়েও তার অগ্রযাত্রা এখনো পর্যন্ত রোধ করতে পারেনি। আল্লাহর রহমত ও সাহায্য তার সাথে আছে বলে মনে হয়। তাছাড়া তুর্কি জাতির অতীত ঈমানী ধারা শত বাধা উপেক্ষা করেও স্বাচ্ছন্দে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। আমরা জানি না আল্লাহর কী ফায়সালা। তবে একটি বিশ্বাস খুব দৃঢ়ভাবে আমরা সবাই পোষণ করি যে, ভয় বা উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। শেষ পর্যন্ত ঈমানদারদেরই বিজয় হবে। শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের এদেশে ইসলামের ওপর যত ধরনের বিপদ আসতে পারে, মুসলমানরা যত ধরনের দুঃখ-কষ্টের শিকার হতে পারে এসব থেকেই আমরা আল্লাহ তায়ালার কাছে পানাহ চাই। সব চিন্তা ও শ্রেণীর আলেম ওলামা পীর-মাশায়েখ, দীনদার বুদ্ধিজীবী, ইসলামপ্রিয় ছাত্র, যুবা, তরুণ ও সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ নাগরিকদের চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। দুয়া-মোনাজাত, আদর্শিক দৃঢ়তা ও সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সর্বোচ্চ মুজাহাদার কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহ তাওফীক দিন। তিনি বিশ্বের অন্যতম প্রধান মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি সহায় হোন।

সভাপতি: বাংলাদেশ ইন্টেলেকচুয়াল মুভমেন্ট (বিআইএম)

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ