জামেয়া ওয়েবসাইট

সোমবার-৯ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-১৪ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আরবি ভাষা চর্চার গুরুত্ব: উম্মতের পুনর্জাগরণে এর ভূমিকা

আরবি ভাষা চর্চার গুরুত্ব: উম্মতের পুনর্জাগরণে এর ভূমিকা

আরবি ভাষা চর্চার গুরুত্ব: উম্মতের পুনর্জাগরণে এর ভূমিকা

এস এম নাজিম-উর-রশীদ

‘তাঁর আরও এক নিদর্শন হচ্ছে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্যে নিদর্শনাবলি রয়েছে।’ [আর-রূম: ২২]

ভাষা একে অপরের সাথে চিন্তা-ভাবনা ও ধারনার যোগাযোগের মাধ্যম। এর মাধ্যমে চিন্তা-ভাবনা একজন থেকে অন্যজনে প্রবাহিত হয়, এক স্থান হতে অন্য স্থানে প্রবাহিত হয়। লিখিত হোক বা অলিখিত, এটাই মানুষের জন্য চিন্তা-চেতনা যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে প্রাচীনকাল হতে। ভাষা অবশ্যই আমাদের চিন্তা প্রক্রিয়ার অংশ নয় বরং এর ফলাফল। এ বিষয়টি RationalEmpiricalউভয় চিন্তার পদ্ধতি দ্বারাই প্রমাণ করা সম্ভব। এটা আমরা বুঝতে পারি যখন আমরা দেখি বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে একই চিন্তা-চেতনা একইভাবে বিরাজ করে কিন্তু তা প্রকাশ করার সময় বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশ করে। উদাহরনস্বরূপ একজন ইংরেজ, একজন চাইনিজ, একজন জার্মান কিংবা একজন বাঙালি ভিন্ন ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও কমিউনিজমকে তাদের আদর্শ হিসেবে নিতে পারে। ভিন্ন ভাষা তাদের আদর্শিক চিন্তার মধ্যে কোনো পার্থক্য ঘটায় না।

ভাষা অনেকটা মানুষের মতোই। এর উদ্ভব হয়, বিবর্তন হয়, উন্নতি হয়, দুর্বলতা দেখা দেয় এবং কখনো কখনো ভাষার মৃত্যু তথা বিলুপ্তিও দেখা দিতে পারে। ভাষার উৎপত্তি মূলত কথ্যরূপে শুরু হয়, পরবর্তীতে তা লিখিতরূপে আসে এবং কোনো প্রতিষ্ঠিত ভাষার পণ্ডিতগণ সাধারণত তখনই ভাষার নিয়ম-নীতি তথা ব্যকরণ রচনা করেন যখন তারা ভাষার বিকৃতির আশঙ্কা করেন।

আরবি ভাষা

অন্য সকল ভাষার মতোই আরবিও পৃথিবীর একটি প্রচলিত ভাষা। এটি একটি সেমিটিক ভাষা এবং পৃথিবীর বৃহত্তম সেমিটিক ভাষা। পৃথিবীর প্রায় ২৮০ মিলিয়ন মানুষের জন্য এটি তাদের প্রধান ভাষা। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার প্রায় ২২টি দেশের রাষ্ট্রভাষা এটি। ধারণা করা হয়ে থাকে যে প্রায় তিন হাজার বছর পূর্বে এ ভাষা অস্তিত্বে আসে যদিও এর লিখন প্রক্রিয়ার শুরু আরও অনেক পরে। কেউ কেউ এ ভাষার উৎপত্তি আরও আগে মনে করেন। কোনো কোনো আলেম এটাও মনে করেন যে, এ ভাষাটি আল্লাহর পক্ষ হতে আদম (আ.) নিয়ে এসেছিলেন, তবে এ মতটি বিতর্কিত।

ইসলামের সাথে আরবি ভাষার সম্পর্ক

‘যদি আমি একে অনারব ভাষার কুরআন করতাম, তবে অবশ্যই তারা বলত, এর আয়াতসমূহ পরিষ্কার ভাষায় বিবৃত হয়নি কেন? কি আশ্চর্য যে, কিতাব অনারব ভাষার আর রাসূল আরবিভাষী। বলুন, এটা বিশ্বাসীদের জন্য হেদায়েত ও রোগের প্রতিকার। যারা ঈমান আনয়ন করে না, তাদের কানে আছে ছিপি, আর কুরআন তাদের জন্যে অন্ধত্ব। তাদেরকে যেন দূরবর্তী স্থান থেকে আহ্বান করা হয়।’ [হা মীম আস-সাজদা: ৪৪]

আরবি ভাষার সাথে ইসলামের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ও অবিচ্ছিন্ন। পবিত্র কুরআন মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর নাযিল হয়েছে আরবি ভাষায়। এবং পুরো কুরআনই আরবি ভাষায় নাযিলকৃত। এটি সম্পূর্ণ আরবি এবং এতে কোনো বিদেশি শব্দ নেই। ইমাম শাফিয়ী (রহ.) তাঁর আর-রিসালা গ্রন্থে বলেন, ‘কুরআন এই দিক-নির্দেশনা দেয় যে আল্লাহর কিতাবের কোনো অংশই আরবি ভাষার বাইরে নয়…।’ আল্লাহর কিতাবের ১১টি আয়াত হতে এ নির্দেশনা পাওয়া যায় যে, কুরআন সম্পূর্ণ আরবি ভাষায় নাযিলকৃত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন, ‘বিশ্বস্ত রূহ একে নিয়ে অবতরণ করেছে। আপনার হৃদয়ে, যাতে আপনি ভীতি প্রদর্শনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হন। সুস্পষ্ট আরবি ভাষায়।’ [আশ-শুআরা: ১৯৩-১৯৫]

‘এমনিভাবে আমি এ কুরআনকে আরবি নির্দেশরূপে নাযিল করেছি।’ [আর-রা’দ: ৩৭]

‘এমনিভাবে আমি আপনার প্রতি আরবি ভাষায় কুরআন নাযিল করেছি।’ [আশ-শুরা: ৭]

‘আরবি ভাষায় এ কুরআন বক্রতামুক্ত, যাতে তারা সাবধান হয়ে চলে।’ [আয-যুমার: ২৮]

‘এবং এ কুরআন পরিষ্কার আরবি ভাষায়।’ [আন-নাহল: ১০৩]

ইসলামি আদর্শের সাথে আরবি ভাষার সম্পর্ক ও এর গুরুত্বকে তিনটি অংশে ভাগ করা যায়:

মৌলিক বিশ্বাস: এক্ষেত্রে ভাষা তেমন প্রাসঙ্গিক নয়। কোনো ব্যক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতিতে ঈমান এনে আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা, রাসূল, ওহী, বিচার দিবস ও কদরের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে মুসলিম হতে পারে। এক্ষেত্রে ভাষার জ্ঞান থাকা অনিবার্য নয়।

পালন: ইসলাম পালন করার জন্য কিছু পরিমান আরবি জানা অবশ্যই দরকার। উদাহরণস্বরূপ, নামায আদায় ইত্যাদি।

ইসলামি জ্ঞান ও আইনবিদ্যা: ইসলামি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখাকে প্রকৃতভাবে জানতে হলে ও ইসলামি শরীয়ার আইনসমূহ অধ্যয়ন করতে হলে আরবি ভাষার জ্ঞান অত্যাবশ্যকীয়। উদাহরণস্বরূপ, হকুম শরয়ী, উসুল আল-ফিকহ ইত্যাদি। সকল যুগেই মুসলিম পণ্ডিতগণ ইজতিহাদের জন্য আবশ্যক আরবিভাষা, এর নাহু-সরফের জ্ঞান, শব্দভাণ্ডার, ব্যাকরণ, অলংকারশাস্ত্র ইত্যাদি সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমাণে জ্ঞান রাখতেন।

শায়খ তকী (রহ.) বলেন, ‘ঈমান ও আহকাম বোঝার বিষয়টি ইসলামে দুটি ভিন্ন বিষয়। ইসলামে ঈমান প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিবৃত্তি বা আকলী দলীল দ্বারা। যাতে করে কোনো সন্দেহের অবকাশ না থাকে। কিন্তু আহকাম বোঝার বিষয়টি শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তির ওপর নির্ভর করে না, বরং আরবি ভাষা জানার ওপর, হুকুম বের করে আনার যোগ্যতা, দুর্বল হাদীস হতে সহীহ হাদীস পৃথক করার ওপরও নির্ভর করে।’

যেহেতু ইসলামি শরীয়া জীবনের সকল ক্ষেত্রে তথা ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হয় এবং যেহেতু কুরআন ও সুন্নাহ ইসলামি সভ্যতার ভিত্তি সেহেতু ইসলাম নিয়ে যেকোনো গভীর অধ্যয়নের সাথে আরবি ভাষার অধ্যয়ন থাকা অত্যন্ত আবশ্যক। এখানে আরবি ভাষা বলতে প্রাচীন(Classical) আরবি ভাষা ও তার কাঠামোকে বোঝানো হচ্ছে। কথ্য ও আঞ্চলিক ভাষার চর্চা এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক। এছাড়াও ইসলামি সভ্যতাকে শক্তিশালীভাবে টিকিয়ে রাখার জন্য আরবি ভাষাকে বিকৃতির হাত রক্ষা করাও আবশ্যক।

আমাদের সালাফ তথা পূর্ববর্তীগণ এ বিষয়গুলো খুব ভালোভাবেই বুঝতেন। বিশেষ করে খোলাফায়ে রাশিদীনের আমলেও এ বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে।

হযরত ওমর (রাযি.) হযরত আবু মুসা আশ’আরী (রাযি.)-কে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন ও আরবির জ্ঞান অর্জন কর এবং কুরআন আরবিতে অধ্যয়ন কর কারণ এটা আরবি।’

আরেকটি বর্ণনায় হযরত ওমর (রাযি.) বলেন, ‘আরবি শেখ কারণ এটি তোমাদের দীনের অংশ।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘কারো কুরআন পড়া উচিত নয় ভাষার জ্ঞান ছাড়া।’

হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাযি.) বলেছেন, ‘আরবি ভাষা শেখ ঠিক যেভাবে তোমরা কুরআন হিফজ করা শেখ।’

হযরত আলী (রাযি.) যখন কুফায় তার রাজধানী স্থানান্তরিত করেন তখন সেখানে তিনি নতুন একধরনের আরবির চর্চা দেখতে পান। এতে তিনি বেশ চিন্তিত হন এবং তিনি তৎকালীন আরবি পণ্ডিত আবুল আসওয়াদ আদ-দুয়ালীর সাথে বৈঠক করেন এবং তাঁকে আরবি ভাষার মৌলিক নীতিসমূহ বিশ্লেষণ করেন। ইবনে কসীর (রহ.) তাঁর আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আবুল আসওয়াদ হচ্ছে তিনি যাকে নাহুজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত করা হয়। এবং বলা হয়, যারা এ বিষয়ে কথা বলেছেন তাদের মধ্যে তিনি প্রথমদিককার একজন। তিনি তা আমীরুল মুমিনীন আলী ইবনে আবু তালিব (রাযি.) হতে গ্রহণ করেছেন।’

ইমাম শাফিয়ী (রহ.) আরবি ভাষার জ্ঞান থাকাকে ফরযে আইন মনে করতেন এবং তিনি তার আরব ছাত্রদের আরবি ভাষা ভালোভাবে রপ্ত করার তাগিদ দিতেন। তিনি তার ছাত্রদের বলতেন, ‘নিশ্চয়ই আমি জ্ঞান অন্বেষণকারীদের ব্যপারে এই ভয় পাই যে তারা আরবি ভাষার নাহু (ব্যাকরণ) সঠিকভাবে জানবে না এবং এভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সেই হাদীসের (বাস্তবতার) মধ্যে প্রবেশ করবে, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার ওপর মিথ্যারোপ করল, সে যেন (জাহান্নামের) আগুনের মধ্যে তার আসন খুজে নেয়’।’

ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.)ও ইমাম শাফিয়ী (রহ.)-এর মতো অনেকটা একই মত পোষণ করতেন। তার মতে যেহেতু একজন মুসলিমের জন্য কুরআন সুন্নাহ বোঝাটা আবশ্যক সেহেতু ‘অত্যবশ্যকীয় কিছু পালন করার জন্য যা প্রয়োজন তাও অত্যাবশ্যক’-এই নীতি অনুযায়ী আরবি ভাষা শেখাও আবশ্যক। তিনি আরও বলতেন, ‘আরবি ভাষা ইসলাম ও এর অনুসারীদের প্রতীক এবং যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি দ্বারা জাতিসমূহ নিজেদের পৃথক করে ভাষা তাদের মধ্যে অন্যতম।’

মু’জিযা

২৮টি হরফ। এ কটি হরফ ও এর দ্বারা গঠিত শব্দ দিয়েই পৃথিবীতে পবিত্র কুরআন নাযিল হয়। আমরা জানি, কুরআন একটি মু’জিযা যা মানবজাতির জন্য একটি চ্যালেঞ্জস্বরূপ এবং অন্যান্য নবী-রাসূলদের মু’জিযার সাথে কুরআনের পার্থক্য হচ্ছে, অন্যান্য নবী-রাসূলদের সময় শেষ হলে তাদের মু’জিযারও সমাপ্তি ঘটত, কিন্তু কুরআন একটি চলমান মু’জিযা যার সমাপ্তি হয়নি। যদিও কুরআনের মু’জিযা হওয়াটা আমাদের কাছে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে প্রমাণিত। কিন্তু এ বিষয়টি শুধু জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ, অভিজ্ঞতা দ্বারা নয়(But this is only through knowledge, not through experience)। একমাত্র আরবি ভাষা শেখা ছাড়া এ অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি অর্জন করা সম্ভব নয়।

ঐতিহাসিকভাবে এ ভাষার অবহেলা ও এর পরিনাম

মুসলিমদের পতনের পেছনে যেভাবে কাফেরদের চক্রান্ত ছিল, ঠিক একইভাবে মুসলিমদের মধ্যেও বেশ কিছু দুর্বলতা দেখা দিয়েছিল এবং এসব কারণসমূহের মধ্যে অন্যতম এক কারণ হলো আরবি ভাষার প্রতি অবহেলা। যদিও মুসলিমরা এ ভাষার গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল, কাফেররা ঠিকই এ ভাষার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল। এজন্যই তারা আরব-তুর্কিদের মধ্যে বিভেদ লাগানোসহ আরও অনেক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। শায়খ তকী (রহ.) তার বই ইসলামি রাষ্ট্র-এ বলেন,

‘এরপর ইসলামের শত্রুরা আরবি ভাষার ওপর আক্রমণ চালায়। কারণ এই ভাষাতেই ইসলাম এবং এর হুকুম আহকামকে প্রচার করা হয়। তাই তারা ইসলামের সাথে আরবি ভাষার সম্পর্ককে ছিন্ন করতে ব্যাপক তৎপরতা চালায়। কিন্তু প্রথম দিকে তারা সফলতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। কারণ প্রথম দিকে মুসলিমরা যে দেশই জয় করেছে সেখানেই তারা কুরআন-সুন্নাহ ও আরবি ভাষাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে এবং জনগণকে তারা এ তিনটি জিনিসই শিক্ষা দিয়েছে। বিজিত জনগোষ্ঠীর মানুষেরা ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং আরবি ভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলেছে। কিছু কিছু অনারব এ ব্যাপারে এতো পারদর্শিতা অর্জন করেছেন যে, তারা ইসলামের প্রখ্যাত মুজতাহিদও হয়েছেন। যেমনÑ ইমাম আবু হানিফা (রহ.)। কেউ কেউ বা হয়েছেন অত্যন্ত উচুঁমাপের কবি, যেমনÑ বাশার ইবনে বুরদ। আবার কেউ বা হয়েছে প্রখ্যাত লেখক, যেমনÑ ইবনুল মুকাফফা। এভাবেই মুসলিমরা (প্রথমদিকে) আরবি ভাষাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছিল। ইমাম শাফিয়ী (রহ.) কুরআনের কোনো ধরনের অনুবাদ বা অন্য কোনো ভাষায় সালাত আদায় করাকে অগ্রহণযোগ্য বলেছেন। আবার যারা কুরআন অনুবাদের অনুমতি দিয়েছেন যেমনÑ ইমাম আবু হানিফা (রহ.), তাঁরা অনুবাদকে কুরআন হিসেবে স্বীকৃতি দিতেও অস্বীকার করেছেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে আরবি ভাষা সবসময় মুসলিমদের মনোযোগ ও গুরুত্বের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। বস্তুত এ ভাষা হচ্ছে ইসলামের মৌলিক অংশ এবং ইজতিহাদের জন্য এক অপরিহার্য বিষয়। আরবি ভাষা ব্যতীত উৎস থেকে ইসলামকে বোঝা অসম্ভব এবং এ ভাষা ব্যতীত শরীয়া থেকে নির্ভুলভাবে হুকুম-আহকাম বের করাও সম্ভব নয়। কিন্তু হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ দিকে, আরবি ভাষার গুরুত্ব ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে। কারণ এ সময় এমন সব শাসকেরা ক্ষমতায় আসে যারা আরবি ভাষার প্রকৃত গুরুত্ব ও তাৎপর্য বুঝতে ব্যর্থ হয় এবং এ বিষয়টিকে তারা ক্রমাগত অবহেলা করতে থাকে। ফলশ্রুতিতে, রাষ্ট্রের নাগরিকদের আরবি ভাষার ওপর দখল কমে যায় এবং ইজতিহাদের প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে যায়। এখানে মনে রাখা দরকার যে, যেকোনো বিষয়ে শরীয়াহ্র হুকুম খুঁজে বের করতে হলে, যতগুলো উপাদান অপরিহার্য তার মধ্যে আরবি ভাষা একটি। বস্তুত ইতিহাসের এই পর্যায়ে, আরবি ভাষা ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে, রাষ্ট্রের শরীয়া সম্পর্কিত ধ্যানধারণাও অস্পষ্ট হয়ে যায় এবং সেইসাথে, অস্পষ্ট হয়ে যায় শরীয়া আইন-কানুন বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া। ইসলামি রাষ্ট্রকে দুর্বল ও রুগ্ণকরে ফেলতে এ বিষয়টি ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের পক্ষে নতুন নতুন সমস্যা সমূহকে বোঝা এবং সে সমস্যাগুলোর মুকাবিলা করা কঠিন হতে থাকে। একসময় রাষ্ট্র উদ্ভুত সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয় কিংবা সমাধানের লক্ষ্যে ভ্রান্ত পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। এভাবে, সময়ের সাথে সাথে রাষ্ট্রের সমস্যা ঘনীভূত হতে থাকে এবং ইসলামি রাষ্ট্র একসময় অন্তহীন সমস্যার সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকে।’

ইজতিহাদ

ইজতিহাদের জন্য শর্তাবলি রয়েছে যা উসূলের আলেমগণ ব্যখ্যা করে গিয়েছেন। এর জন্য দরকার বিস্তৃত জ্ঞান, কুরআন-সুন্নাহর সঠিক জ্ঞান ও যথেষ্ঠ পরিমাণ আরবি ভাষাতত্ত্বের জ্ঞান…।

আরবি ভাষার অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হচ্ছে ইল্লত আহরণ অর্থাৎ একজন মুজতাহিদ কোনো নস (نص) থেকে হুকুমের পেছনের ইল্লাহ বের করতে পারেন এবং অন্য পরিস্থিতিতে এর প্রয়োগ করতে পারেন। এছাড়াও আইনগত দিক থেকে, আরবি ভাষায় কোনো বাক্যে বিভিন্ন শব্দের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি বাক্যেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ইমাম হচ্ছে রাখাল (দায়িত্বশীল) এবং সেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ এখানে ‘সেই’ শব্দটি আরবি ব্যকরণের পরিপ্রেক্ষিতে সীমিতকরণ (اداة حصر)-এর হুকুম পায় এবং এটি একটি আলাদা সর্বনাম। এভাবেই তাঁর (সা.) বক্তব্য, ‘এবং সেই জিজ্ঞাসিত হবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে’ (রাষ্ট্রের) জন্য দায়িত্বশীলতাকে ইমামের জন্য সীমিত করে। সুতরাং রাষ্ট্রের মধ্যে মূলত খলীফা ছাড়া আর কেউই শাসন করবার কোনো ক্ষমতা রাখে না, হোক ব্যক্তি অথবা দল।

ইসলাম মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে সর্বশেষ জীবনব্যবস্থা। দুনিয়ার সমাপ্তি পর্যন্ত এ দ্বীন দিয়েই সমাজ পরিচালনা করতে হবে। আর এ কাজ করতে গিয়ে যুগে যুগে মুসলিম জাতিকে অসংখ্য নতুন সমস্যার সম্মুক্ষীন হতে হয়েছে এবং স্বাভাবিকভাবে ভবিষ্যতেও হতে হবে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য একমাত্র উপায় হচ্ছে ইজতিহাদ। ইজতিহাদ হচ্ছে সেই ইঞ্জিন যা ইসলামকে চালিত করে। এটি না থাকলে উম্মাহর মধ্যে জলাবদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি হবে এবং উম্মাহর সমৃদ্ধি থমকে যাবে। এবং ঐতিহাসিকভাবেও এ বিষয়টির সত্যতা আমরা দেখেছি। শায়খ তকী (রহ.) বলেন, ‘(মুসলিম উম্মাহর) এ অধঃপতনের পেছনে একমাত্র একটি কারণই ছিল, (মুসলিমদের) প্রচণ্ড দুর্বলতা যা তাদের ইসলামকে বোঝার জন্য চিন্তা করার যোগ্যতা ধ্বংস করে দিয়েছিল। এ দুর্বলতার পেছনের কারণ ছিল সম্পম শতাব্দী হিজরির প্রথম থেকে শুরু করে ইসলাম ও আরবি ভাষার বিচ্ছিন্নকরণ যখন আরবি ভাষা ও ইসলামের প্রসার অবহেলিত হয়েছে। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত আরবি ভাষাকে ইসলামের সাথে এর এক অবিচ্ছেদ্য মৌলিক অংশ হিসেবে মিশ্রিত না করা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ অধঃপতন মুসলিমদের আরো অবনতির দিকে নিয়ে যাবে। এটা এ কারণে যে, এই ভাষার ভাষাগত ক্ষমতা ইসলামের শক্তিকে এমনভাবে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে যে একে ছাড়া ইসলামকে বহন করা সম্ভব নয়, এবং যদি একে অবহেলা করা হয়, তবে শরীয়ার মধ্যে ইজতিহাদ করা আর সম্ভবপর হবে না। (আর) আরবি ভাষার জ্ঞান ইজতিহাদের জন্য একটি মৌলিক শর্ত। এছাড়াও ইজতিহাদ উম্মতের জন্য অপরিহার্য যেহেতু এর সদ্ব্যবহার ছাড়া উম্মাহর উন্নয়ন সম্ভব নয়।’

সুতরাং বোঝা যাচ্ছে উম্মাহর সমৃদ্ধির সাথে আরবি ভাষার সম্পর্ক কত গভীর।

উম্মাহর পুনর্জাগরণ

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ এ কিতাবের দ্বারা বিভিন্ন জাতিকে উচ্চকিত করেন আর অন্যান্যদের করে দেন নিচু।’ [মুসলিম]

পুনর্জাগরণ বস্তুগত বা বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের মধ্যে নিহিত নেই। বরং চিন্তাগত ও মতাদর্শিক উন্নয়নই পূনর্জাগরণের সঠিক ভিত্তি আর বস্তুগত উন্নয়ন হচ্ছে এর ফলাফল। আমরা যখন উম্মতের পুনর্জাগরনের কথা বলি তখন আমাদের মনে রাখতে হবে যে এ পুনর্জাগরণ ইসলামি আকীদা ও তা থেকে বের হয়ে আসা ব্যবস্থার সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ আমাদেরকে পৃথিবীতে এ আকীদা প্রতিষ্ঠা ও এর ব্যবস্থাকে বাস্তবায়ন করতে হবে। এবং এ ব্যবস্থাটি রয়েছে কুরআন ও সুন্নাহর মধ্যে আরবি ভাষায়। অতীতে আরবরা পৃথিবীর শ্রেষ্ট জাতিতে পরিনত হয়েছিল কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এ ভাষায় পবিত্র কুরআন নাযিল করেছিলেন। এবং এ ভাষাতেই তারা শরীয়া বুঝেছিলেন এবং তা বাস্তবায়ন করেছিলেন। এবং আরবি ভাষার কোনো কিছু সবচেয়ে ভালোভাবে আরবিতেই বোঝা যাবে। এক্ষেত্রে অনুবাদ গ্রহণযোগ্য নয় যেহেতু ভাষার অর্থ ও আকুতি অনেকটাই অনুবাদে হারিয়ে যায়। অন্য যেকোনো ভাষার সাহিত্য অধ্যয়নের ক্ষেত্রেও এটি সত্য। উদাহরণস্বরূপ আমরা শেক্সপিয়ারকে ইংরেজি, ইকবালকে উদু, নজরুলকে বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাতেই পূর্ণাঙ্গরূপে বুঝতে পারবো না। সুতরাং ইসলামি ব্যবস্থার খুটিনাটি বিশ্লেষন বুঝতে হলে আরবি ভাষার জ্ঞানও থাকতে হবে।

আমরা যারা হুকুম শরয়ী নিয়ে পড়াশুনা করেছি তারা জানি যে, ফরয-এ-কিফায়া ও আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বাধ্যতামূলক ফরয দায়িত্ব এবং ফরয হিসেবে ফরয-এ-আইন হতে কোনো অংশে এটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। শুধুমাত্র পার্থক্য হল, ফরয-এ-কিফায়াকে পালন করার জন্য আল্লাহ পুরো উম্মতকে একসাথে দায়িত্ব দিয়েছেন, উম্মতের প্রত্যেকটি সদস্যকে আলাদা আলাদা চিহ্নিত করে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। কিন্তু উম্মাহর মধ্যে যথেষ্ঠ পরিমান সদস্য যদি সন্তোষজনকভাবে এ দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে কাজটি সম্পন্ন করাটা পূরো উম্মতের জন্য ফরজে আইন হিসেবে ঝুলে থাকে। আমরা জানি ইজতিহাদ করাটা ফরযে কিফায়া এবং ইজতিহাদ করার জন্য আরবি ভাষা জানাটাও আবশ্যক। এবং উম্মতের মধ্যে প্রত্যেক যুগে অবশ্যই যথেষ্ঠ পরিমানে মুজতাহিদ থাকতে হবে। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীর দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে কি আমরা সে পরিমান মুজতাহিদ ও সেরকম ইজতিহাদ চর্চা দেখতে পাবো? এখন আমরা একটু চিন্তা করলেই উপলব্ধি করতে পারবো যে বর্তমানে আরবি ভাষার জ্ঞান অর্জন করা আমাদের জন্য কতটা জরুরি। এছাড়াও খিলাফত প্রতিষ্ঠার দায়ী হিসেবে উম্মতের কাছ থেকে আস্থা ও নেতৃত্ব অর্জন করার জন্য আরবি ভাষা জানাটা খুবই জরুরি।

উপসংহার

‘আল্লাহ তাঁর সেই বান্দার মুখ উজ্জ্বল করুন যে আমার কথা শুনেছে, সেগুলো মনে রেখেছে, বুঝেছে এবং অন্যের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। কারণ কেউ নিজে ফকীহ (জ্ঞানী) না হয়েও ফিকহ (জ্ঞান) বহনকারী হতে পারে। আবার কেউ তার নিজের চাইতে বড় ফকীহ (জ্ঞানী) এর নিকটও ফিকহ পৌঁছে দিতে পারে।’ [আবু দাউদ, তিরমিযী এবং আহমদ থেকে বর্ণিত]

আমরাই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব এবং আমাদেরকেই পৃথিবীকে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ দিয়ে শাসন করতে হবে। জনগণ আমাদের কাছেই আসবে ইসলাম শিখতে। আমরাই তারা যাদেরকে পৃথিবী বিভিন্ন প্রান্তে প্রেরণ করা হবে আমিল, ওয়ালী কিংবা মুজাহিদ হিসেবে। ঠিক সেভাবেই যেভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবীদের প্রেরণ করতেন। আমরা জানি, মু’আজ বিন জাবাল যখন ইয়েমেনে প্রেরিত হয়েছিলেন তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন যে তিনি আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নত ও তার ইজতিহাদের দ্বারা রায় দেবেন। সুতরাং আমরা যদি সেই আলী, মুআজ, আমর ইবনুল আস (রাযি.)-দের সত্যিকার উত্তরসূরী হয়ে থাকি এবং আমরা যদি কিছুদিনের মধ্যে তাদের মতো দায়িত্বপ্রাপ্ত হই তখন কিভাবে আমরা উত্তমরূপে খিলাফতের অফিসকে চালাবো যখন আমরা আরবি ভাষার জ্ঞান রাখি না।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ