জামেয়া ওয়েবসাইট

শুক্রবার-২৯শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাদাকাতুল ফিতর: একটি বিজ্ঞানসম্মত ইবাদত

সাদাকাতুল ফিতর: একটি বিজ্ঞানসম্মত ইবাদত

সাদাকাতুল ফিতর: একটি বিজ্ঞানসম্মত ইবাদত

আবিদুর রহমান তালুকদার

রামাদান মুমিন জীবনের একটি উৎসবমুখর মৌসুম। বিচিত্র ইবাদতের বর্ণাঢ্য মাস। সাধারণত দীর্ঘায়িত উৎসবের প্রস্তুতি হয় সময়সাপেক্ষ ও দীর্ঘতর। আমাদের সমাজে বিয়ে শাদির মতো ব্যয়বহুল আয়োজনের জন্য দীর্ঘ কয়েক বছরের প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়। বাস্তবতার এমন প্রয়োজনের নিরিখে রজব-শা’বান দু’মাস রামাদানের প্রস্তুতির মাস হিসেবে শরিয়ত কর্র্তৃক নির্ধারিত। রামাদানের প্রস্তুতির মর্মার্থের বিয়য়ে সাধারণ মানুষ বহুবিধ বিভ্রান্তির শিকার। রামাদানের প্রস্তুতি মানে কি? দীর্ঘ এক মাসের পানাহারের জন্য সুস্বাদু ও মুখরোচক খাবারের সংস্থান? ইফতারির নানা আইটেমের মজাদার সমাহার? সেহরির ভোজন-বিলাসে বাহারি আয়োজন? ঈদের নতুন জামা-কাপড়ের জন্য অর্থের যোগান? গৃহের পুরনো আসবাবপত্রের নবায়ন? গহনা-অলঙ্কারের পুরনো সেটের নব সজ্জায়ন? ইত্যাদি নাকি অন্য কিছু?

রজব-শা’বান দু’মাস

রামাদানের প্রস্তুতির মাস

মূলত রামাদানের প্রস্তুতির অর্থ হলো, দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার অতীব প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের সহজলভ্যকরণ। ইসলামের স্বর্ণযুগে সাধারণ মুসলমানগণ ছিলেন অনেকটা সচ্ছল। সমাজের কিছু মানুষ ছিল ধনাঢ্য আর কিছু হতদরিদ্র। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অভাব লাঘবের নিমিত্তে ধনীদের সম্পদে যাকাত-ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়। ইসলামের প্রথমিক যুগ থেকেই মুসলমানগণ রামাদানের পূর্বে যাকাত আদায়ে উৎসাহবোধ করতেন। যাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী রামাদান মাসে কঠোর পরিশ্রমের পরিবর্তে হালকা কাজকর্মে জীবিকা নির্বাহ করে সিয়াম পালনের সুযোগ লাভ করতে পারে। রোযা রেখে ভারি ও কঠোর পরিশ্রমে নিয়োজিত থাকা কষ্ঠসাধ্য। যার ফলে আমাদের সমাজে কঠোর পরিশ্রমে নিয়োজিত শ্রমিকেরা রোযা পালন করে না। এ শ্রেণির মানুষকে সিয়াম পালনে সহযোগিতা করা মুসলিম সমাজের সামষ্ঠিক দায়িত্ব। প্রয়োজনে কঠোর পরিশ্রম থেকে তাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে ‘রোযা পালনের নিমিত্তে ভাতা’ কর্মসূচির আওতায় আনা ইসলামি রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। সিয়াম সাধনার মাসে দিনের বেলায় ভারি কাজকর্ম বন্ধ রাখা অথবা রাতের বেলায় কষ্টসাধ্য কাজ করার ব্যবস্থা রাখা দরকার।

সিয়াম সাধনার একটি

অনিবার্য অনুষঙ্গ হলো ঈদ

শেষ রামাদানের সন্ধ্যাকালে পশ্চিামাকাশে শাওয়াল এর বাকাঁ চাঁদ দৃশ্যমান হলেই পরবর্তী দিন ঈদুল ফিতর অবধারিত। নতুন জামা-কাপড় থাকুক বা নাই থাকুক, শাওয়ালের প্রথম দিনে কোনো মুসলমানের জন্য রোযা রাখার অনুমতি নেই। ঠিকভাবে রোজা পালন না করে একজন সাধারণ মুসলমান আলীশান অট্টালিকায় জমকালো জামা-কাপড় পরিধান করে ঈদের যে পুলক অনুভব করে না, জীর্ণ কুটিরের শীর্ণ পোশাকে একজন মুত্তাকি মুমিনের ঈদ উৎসব হয় তার চেয়ে বেশি প্রাণবন্ত। সফলভাবে সিয়াম-কিয়াম পালনের অনাবিল আনন্দের কারণে ঈদুল ফিতরের সামগ্রিক আনন্দ-উৎসব তাকে হাতছানি দিয়ে ড়াকে। অবশ্য যে রোযা পালন করেনি, বাহারি ও জৌলুশপূর্ণ কাপড় কেনার ব্যর্থতার কারণে তার ঈদ উৎসব হয় অনেকটা বিবর্ণ ও পানসে। মুসলিম সমাজে এ প্রবচনটির কিংবদন্তি রয়েছে, ‘ওই ব্যক্তির জন্য ঈদ নয়, যে বাহারি ও দামি পেশাক পরিধান করেছে। যারা আল্লাহর ভয়ে রোযা পালন করেছে তাদের জন্যেই ঈদের প্রকৃত আনন্দ।’

সারকথা হলো, ইফতারি-সেহরির মজাদার পানাহার ও নতুন জামা-কাপড়ের সঙ্গে ঈদুল ফিতরের সম্পর্ক অতীব গৌণ। ঈমান ও ইহতিসাব সহকারে সিয়াম ও কিয়াম পালনই হলো মুখ্য। ঈদের নির্মল আনন্দ প্রকাশে ইসলাম কোনো ধরনের বাধা প্রদান করে না; বরং ক্ষেত্রবিশেষে উৎসাহ যোগায়। যার কারণে কৌলিণ্য পরিহারপূর্বক নতুন জামা-কাপড় পরিধান করে ঈদের সালাত আদায় করা একটি শাশ্বত সুন্নাহ।

সাদাকাতুল ফিতর: একটি বিজ্ঞানসম্মত ইবাদত

ঈদ উৎসবে দরিদ্র মুসলমানদের শরিক করবার নিমিত্তে সামর্থবানদের উপর ‘সাদাকাতুল ফিতর’ আদায় করা ওয়াজিব। যার প্রয়োগবিধি অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত ও বাস্তবানুগ। সাদাকাতুল ফিতর আদায়ে এমন একটি নিসাব নির্ধারণ করা হয়েছে, যা কিয়ামত অবধি সকল যুগ ও সময়ের সঙ্গে সঙ্গতিশীল। ইসলামের নবি তৎকালীন আরবে প্রচলিত মুদ্রার ভিত্তিতে তার মূল্যমান নির্ধারণ করেননি; বরং কয়েকটি খাদ্যপণ্য নির্দিষ্ট পরিমানে আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। আরবের সহজপ্রাচ্য ও সুস্বাদু খাদ্যপণ্য খেজুরকেই ঘোষণা করা হয়েছে প্রধান উপকরণ হিসেবে। কিসমিস, গম, যব ও আটাও সাদাকা হিসেবে আদায়যোগ্য। যা পৃথিবীর যে কোনো দেশে সহজলভ্য। মুদ্রার পরিবর্তে খাদ্যপণ্যের নির্ধারণে নবিজির বিজ্ঞানমনষ্কতার অকপট পরিচয় মেলে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় একটি দেশের মুদ্রা অন্য দেশে সাধারণভাবে প্রচলনের রেওয়াজ নেই। বর্তমান পৃথিবীর সর্বক্ষেত্রে প্রচলিত আন্তর্জাতিক মুদ্রাটির নাম হলো ডলার। এ ডলারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মুদ্রার মান নির্ণয় হয়। নির্ধারিত খাদ্য-পণ্য দ্বারা সাদাকাতুল ফিত্র আদায় ইসলামি শরি‘য়তের অর্ন্তজাতিকীকরণের পরিচয় বহন করে। অধুনিক সভ্যতার ডলার এ ধারণা পরিপুষ্ট করে। এ বিধান থেকে ইসলামের আন্তর্জাতিকীকরণের ধারণা পাওয়া যায়। স্বর্ণ-রূপা দ্বারা যাকাতের নিসাব নির্ধারণের ক্ষেত্রেও ইসলামের সার্বজনিনতার প্রমাণ বহন করে। কারণ এ দুটি খনিজদ্রব্য পৃথিবীর সর্বত্র ব্যবহারযোগ্য এবং তার মূল্যমান সর্বজনগ্রাহ্য। সাদাকাতুল ফিতরের নিসাবের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সর্বাধিক প্রণিধানযোগ্য তা হলো, এখানে নির্ধারিত পণ্যসমগ্র খাদ্যরুচি ও মূল্যমানের ক্ষেত্রে স্থান, কাল ও পাত্র বিশেষে পরিবর্তনশীল। যা আদায়কারী ও গ্রহীতা উভয়ের জন্য সুবিধাজনক। খেজুর ও কিসমিস ছিল আরবে নিত্য ও সর্বসাধারণ্যে ব্যবহার্য খাদ্যদ্রব্য। সহজলভ্য হিসেবে তার মূল্যমানও ছিল কম। দুষ্প্রাপ্য ও ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে আটা ও গম ছিল তৎকালীন আরবে অতি মূল্যবান খাদ্যদ্রব্য। পক্ষান্তরে আমাদের সমাজে আটা ও গম হলো অতি সাধারণ ও সহজলভ্য । তুলনামূলকভাবে খেজুর ও কিসমিস অতি মূল্যবান ও মানসম্পন্ন পণ্য। তৎকালীন আরবে রুটির ম্যূল্যমান ও দুষ্প্রাপ্যতার বিষয়ে বর্ণিত আছে, ‘দীর্ঘ দু’মাস পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ’র ঘর থেকে রুটি তৈরির ধোঁয়া ওঠতো না। তাদের একমাত্র আহার্যবস্তু ছিল দুটি কালো জিনিস। খেজুর ও পানি।’

সাদাকাতুর ফিতরের তিনটি নেসাব

সাদাকাতুর ফিত্রের আরেকটি বৈজ্ঞানিক ও সার্বজনীন দিক হলো, এখানে দাতার স্তরভেদে তিনটি পরিমান (নেসাব) নির্ধারণ করা হয়েছে:

ক. নিম্নমান সম্পন্ন: যব, গম ও আটা,

খ. মধ্যমানসম্পন্ন: খেজুর ও

গ. উচ্চমান সম্পন্ন: কিসমিস।

যে কোনো একটি পরিমানে সাদাকাতুল ফিতর আদায়ে একজন মুসলমান দায়মুক্ত হয়। ইসলাম সাদাকা আদায়ের ক্ষেত্রে সর্বদা দাতার চেয়েও গ্রহীতার লাভালাভকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। যেমন স্বর্ণ ও রূপার দুটি নিসাবের মধ্যে যদি কারো রূপার নিসাব পূর্ণ হয়, প্রাগ্রসর ফকিহদের মতে তার উপর যাকাত ফরয হয়। আবার স্বর্ণ ও রূপা উভয়ে মিলে রূপার নিসাব পূর্ণ হলেও যাকাত দিতে হয়। সাদাকাতুল ফিত্র আদায়ের ক্ষেত্রেও উচ্চবিত্তের মুসলমানের জন্য কিসমিসের নিসাবে এক সা’ হিসেবে আদায় করলে গ্রহীতার অধিকার বেশি সংরক্ষিত হয়। যার বর্তমান বাজার দর350x3kg261.50=1170Tk

মধ্যবিত্তের মুসলমানের জন্য খেজুরের অর্ধসা’ পরিমানে সাদাকাতুর ফিত্র আদায়ে দাতা গ্রহীতা উভয়ের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যার বর্তমার বাজারমূল্য (মধ্যমমানের খেজুর)100x1kg630.75g=165Tk। আর সাধারণ মুসলমানের জন্য আটা বা গমের মূল্যমানে সাদাকা আদায় করতে কেনো দোষ নেই। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ঘোষিত যার মূল্যমান ৬০/৬৫ টাকা। (সূত্র: মু’জামু লুগাতিল ফুকাহা)

আমাদের সমাজে বিভিন্ন মসজিদ ও প্রতিষ্ঠান থেকে সাদাকাতুল ফিত্রের যে মূল্যমান নির্ধারণ করা হয়, তাতে বারবার নিম্নবিত্তের নিসাবটিই আলোচনাই আসে। এতে দরিদ্র ও গ্রহীতার অধিকার কতটুকু সংরক্ষিত হয়, তা গভীরভাবে বিবেচনায় আনা দরকার। বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে ৬০/৬৫ টাকা দিয়ে ঈদ উৎসব পালন করা নিতান্তই হাস্যকর ও অসম্ভব। ইসলাম বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী জীবনবিধান হিসেবে সাদাকাতুল ফিতরের মূল্যমান নির্ধারণের ক্ষেত্রে ফকিহ, আলিম ও খতিবদের সুতীক্ষ্ণ বিবেচনা ও ধীমান সিদ্ধান্ত ইসলামের সার্বজনীন প্রয়োগবিধান আরো গতিশীল হতে পারে।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ