শুক্রবার-১৬ই জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি-১৬ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মৃত্যুঝুঁকিতে পাহাড়ের পাদদেশের বাসিন্দা

মৃত্যুঝুঁকিতে পাহাড়ের পাদদেশের বাসিন্দা

মৃত্যুঝুঁকিতে পাহাড়ের পাদদেশের বাসিন্দা
মাহমুদুল হক আনসারী

চট্টগ্রাম নগরজুড়ে পাহাড়ের পাদদেশ ছেয়ে আছে শত শত বসতঘর। পজলা প্রশাসনের তালিকায় পাহাড়ের পাদদেশে এখনও ৮০০ এর বেশি অবৈধ বসতির তালিকা আছে। কাঁচা ও আধা পাকা এসব বসতঘর সরানো যাচ্ছে না কিছুতেই।
এপ্রিলের প্রথম দিকে অবৈধ বসতঘর উচ্ছেদ করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এতে বর্ষা কিংবা টানা ভারি বৃষ্টিপাতে বাড়তে পারে মৃত্যুর শঙ্কা। দাবি উঠছে পাদদেশ থেকে সরিয়ে বাসিন্দাদের স্থায়ী পুর্নবাসনের। কিন্তু পুর্নবাসন এবং পাদদেশ থেকে সরানোর কোনো দাবি বাস্তব রূপ লাভ করতে দেখা যাচ্ছে না। বাসিন্দারা রয়েছেন চরম মৃত্যুঝুঁকিতে। সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্টিত হয়। বৈঠকে অবৈধ বসতি সরাতে বিভিন্ন সিন্ধান্ত গ্রহণ করা হয় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। আর দুই মাসের কম সময়ে শুরু হবে বর্ষা মৌসুম। ভারি বর্ষণের মৌসুম ঘনিয়ে আসতে থাকায় চট্টগ্রাম মহানগরী ও আশপাশের পাহাড়ের পাদদেশে ফের দেখা দিয়েছে মৃত্যুর পুরোনো শঙ্কা। পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরত আট শতাধিক পরিবারকে সরাতে দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা নেই বলা যায়।
প্রতিবছর এপ্রিলের শুরুতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা। এবারও সে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সভা হয়েছে। সভায় অবৈধ বসতি সরাতে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এতে সিদ্ধান্ত হবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে-এমন পাহাড় থেকে বসতিদের উচ্ছেদ করার। এ বিষয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াছ হোসেন জানান, পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ কার্যক্রম নিয়ে একটি সভা অনুষ্টিত হয়। সভায় অবৈধ বসতি সরাতে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, এবার জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আগেভাগে অবৈধ বসতি সরাতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি, এবার পাহাড় ধসে মৃত্যুর ঘটনা ঘটবে না। সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর আলোচিত তিন পাহাড়েই সবচেয়ে বেশি অবৈধ বসতি। এগুলো হচ্ছে বাটালি হিল, মতিঝর্ণা পাহাড় এবং ইস্পাহানি পাহাড়। এ তিনটি পাহাড়ের পাদদেশে শত শত পরিবার এখনও ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে। কবে তাদের নিরাপদ স্থানে সরানো হবে কেউ জানে না।
সপ্তাহখানেক আগে পরিচালিত উচ্ছেদ অভিযানে বাধা দিয়েছেন বাসিন্দারা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, তাদের সরানো না হলে এবারও প্রবল বর্ষণে প্রাণ হানি ঘটতে পারে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়,বাসিন্দারা অনেকটা নিরূপায় হয়ে বাস করছেন। বেশির ভাগ লোকজনই বলছেন ঝুপড়ি ঘর ছাড়লে পথে রাত কাটানো ছাড়া উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়ে পাহাড়ের নিচে বাস করছেন তারা। সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ বলছেন, ব্যবস্থাপনা কমিটি উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত বহুবার নিয়েছে। কিন্তু তা পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় বন্ধ করা যাচ্ছে না প্রাণহানি। বহুবার সিদ্ধান্ত হয়েছে পাহাড়ে বসবাসকারীদের গ্যাস, বিদুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। কিন্তু কার্যকর হয়নি। ফলে এবারের সিদ্ধান্তও কতটা কার্যকর হয় তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে জনমনে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১০ বছরে চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে অন্তত ২৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী লোকজনকে সরাতে প্রশাসন বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। একারণে বর্ষায় পাহাড় ধসে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। ২০০৭ সালের ১১ই জুন চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে ১২৭ জনের মৃত্যুর ঘটনার পর তৎকলীন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে একটি কমিটি ২৮টি কারণ নির্ধারণ করে। সুপারিশ প্রণয়ন করে ৩৬টি। ওই কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কিংবা সুপারিশের বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করা ২০০৭ সালের ঘটনার পর আরও কয়েকটি বড় ধরনের পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ২০১১ সালের ১ জুলাই নগরীর খুলশি টাইগারপাস এলাকায় পাহাড়ের একাংশ ধসে দু’পরিবারের আটজন নিহত হন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণভাবে লোকজন বসবাস করা পাহাড় গুলোর তদারকি চলে ঢিমেতালে। পাহাড় গুলো দেখভাল করার দায়িত্ব নিয়েও আছে নানা জটিলতা। এসব পাহাড়ের মালিক ভূমিমন্ত্রণালয়। আবার পাহাড়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্ব পরিবেশ মন্ত্রনালয়ের। আর এসব এলাকায় ঘরবাড়ি ও বস্তি নির্মাণের ব্যাপারে আপত্তি ও অনাপত্তি বিষয়টি তদারক করে গণপূর্ত মন্ত্রনালয়। ওই তিনটি সংস্থার যৌথ কোনো তদারকি নেই পাহাড় গুলোয়। এজন্য পাহাড় গুলো দখল করে বস্তি ও ঝুপড়ি তৈরি করে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। স্বল্প ভাড়ার এসব ঝুপড়িতে বাস করছেন গরিব অসহায় লোকজন।
ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়: ২০০৭ সালে পাহাড় ধসে বিপুল প্রাণহানির পর পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে তিনটি পাহাড়কে চিহ্নিত করেছিল। এগুলো হচ্ছে বাটালি হিল, মতিঝর্ণা পাহাড় এবং ইস্পাহানি পাহাড়। এসব পাহাড়ের বাইরে আরও ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় আছে। এগুলোর মধ্যে আছে সিআরবি পাহাড়, ক্যানটনমেন্ট সংলগ্ন বরিশাল কলোনি পাহাড়, সেকান্দর পাহাড়, সিলিমপুরের পাহাড়, আকবরশাহ সংলগ্ন পাহাড়, বায়েজিদের মোজাফফর নগর পাহাড়, ফিরোজশাহ এলাকার শিপিং কর্পোরেশনের পাহাড় এবং আরেফিন নগর পাহাড়, একে খান এন্ড কোম্পানির পাহাড়, ইস্পাহানি কর্তৃপক্ষের নাসিরাবাদ প্রোপার্টিজ পাহাড় এবং ইস্পাহানি পাহাড়ের পাশে হারুন খানের মালিকানাধীন পাহাড়ের পশ্চিম অংশ, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের উত্তর পাশের মীর মোহম্মদ হাসনের মালিকানাধীন পাহাড়, লালখান বাজার চানমারী রোড সংলগ্ন মুছা বিন আজহার, জামেয়াতুল উলুম ইসলামিয়া মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের পাহাড়,চট্টেশ্বরী রোডে অবস্থিত জেমস ফিনলের (বর্তমান জেএফ বাংলাদেশ লি.) মালিকানাধীন পাহাড়, ব্লসোম গার্ডেনের পাহাড়, রেলওয়ে এমপ্লয়িজ গার্লস স্কুল সংলগ্ন পাহাড়, আকবরশাহ আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়, ফয়’স লেক আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়, জালালাবাদ হাউসিং সোসাইটি সংলগ্ন পাহাড়, গরিবুল্লাহ শাহ মাজারের পাশে বায়তুল আমান হাউজিং সংলগ্ন পাহাড়, নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা সংলগ্ন পাহাড়,ডিসি হিলের চেরাগি পাহাড়ের দিকে ফুলের দোকানের অংশ ও পরিবেশ অধিদপ্তর সংলগ্ন সিটি কর্পোরেশনের পাহাড়। এসব পাহাড়ের রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সমন্বয় করে করতে হবে। দেখা যাচ্ছে সরকারি এসব দফতরগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা। সচেতন জনগণ বর্ষার পূর্বে পাহাড়ের পরিবেশ রক্ষা ও পাদদেশে বসবাসকারী জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দাবি করছি।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ