পবিত্র মি’রাজের শিক্ষা ও তাৎপর্য
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন
মি’রাজের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে সিঁড়ি, আরোহণ ও ঊর্ধ্ব গমন। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে জেরুজালেমের বায়তুল মাকদিসে উপনীত হওয়া এবং সেখান থেকে সপ্তাকাশ ভ্রমণ করে আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্যে উপস্থিত হওয়ার ঘটনাকে ইসলামি পরিভাষায় মি’রাজ বলে। ৬২০ খ্রিস্টাব্দের রজব মাসের ২৬ তারিখ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সশরীরে আল্লাহ তায়ালার দিদার লাভ করেন। মহানবী (সা.)-এর একান্ন বছর ৯ মাস বয়সে মি’রাজের ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়। ইসলামের ইতিহাসে মি’রাজ একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। মুমিনদের জন্য রয়েছে এতে অনেক শিক্ষণীয় বিষয়। মি’রাজের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে তাঁর আসমান-জমিনের বাদশাহি প্রত্যক্ষ করান। আল্লাহ তায়ালা তাঁর সাথে সরাসরি কথা বলেন এবং পাঁচ ওয়াক্ত সালাত উপহার দেন। মি’রাজ দৈহিকভাবে এবং জাগ্রত অবস্থায় সম্পন্ন হয়। ওলামায়ে কেরামের পরিভাষায় মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে মসজিলে আকসা পর্যন্ত পরিভ্রমণকে ‘ইসরা’ এবং সেখান থেকে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত পরিভ্রমণকে মি’রাজ বলে। আবার অনেক সময় পুরো পরিভ্রমণকে মি’রাজ নামে অভিহিত করা হয়। আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মি’রাজের ঘটনা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ব্যক্তিত্বের সঠিক ও নির্ভেজাল পরিচিতি। নির্ভুল নির্দেশনা। ইমামত ও নেতৃত্বের বর্ণনা এবং উম্মাহর (যাদের মাঝে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন) আসল মাকাম ও প্রকৃত অবস্থানগত মর্যাদা নির্ধারণ করে এবং পয়গাম ও দাওয়াতের কর্মকাণ্ডের পর্দা উন্মোচন করে, যা এ উম্মতকে এ বিশাল বিস্তৃত পৃথিবীতে ও বিশ্বসমাজে আনজাম দিতে হবে।’
স্বল্পসংখ্যক বিভ্রান্ত দার্শনিক ও নাস্তিক ছাড়া পৃথিবীর সব মুসলমান মি’রাজ-এর অলৌকিক ঘটনা বিশ্বাস করে। কারণ পবিত্র কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদীসে এর বর্ণনা বিদ্যমান। সূরা বনী ইসরাঈলে উল্লিখিত হয়েছে,
سُبْحٰنَ الَّذِيْۤ اَسْرٰى بِعَبْدِهٖ لَيْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ اِلَى الْمَسْجِدِ الْاَقْصَا الَّذِيْ بٰرَكْنَا حَوْلَهٗ لِنُرِيَهٗ مِنْ اٰيٰتِنَا١ؕ اِنَّهٗ هُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيْرُ۰۰۱
‘পবিত্র মহান সে সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে নিয়ে গেছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার আশপাশে বরকত দিয়েছি, যেন আমি তাঁকে আমার কতিপয় নিদর্শন প্রত্যক্ষ করাতে পারি। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’
বুরাক
মহানবী (সা.) যে জন্তুটির ওপর আরোহণ করে মি’রাজ সম্পন্ন করেন তাঁর নাম বুরাক। এর আকার বিষয়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.)-এর বর্ণনায় আছে, এর চেহারাটা মানুষের চেহারার মতো। পায়ের ক্ষুরটা জন্তুদের পায়ের ক্ষুরের মতো। লেজটা বলদের লেজের মতো। অগ্র-পশ্চাৎ ঘোড়ার মতো। তাকে যখন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে আনা হয় তখন সে লাফালাফি করতে থাকে। ফলে জিবরাঈল (আ.) তাকে ছুঁয়ে বলেন, হে বুরাক! তুমি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে দেখে লাফালাফি করো না। আল্লাহর কসম! তোমার ওপর এমন কোন ফিরিশতা চড়েনি এবং এমন কোন প্রেরিত নবীও সওয়ার হননি যিনি মুহাম্মদ (সা.)-এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে পারেন এবং তিনি আল্লাহর নিকটেও তাঁর চেয়ে মর্যাদাবান হতে পারেন। বুরাকটি তখন কাঁপতে থাকে এবং ঘামে সিক্ত হয়ে পড়ে। বুরাকের দৃষ্টি যতদূর যেত ততদূরে তার পা পড়তো। অতীতে বুরাকটিকে অন্য নবীদের বহনের জন্যও নিয়োজিত করা হয় এবং এতে চড়ে হযরত ইবরাহীম (আ.) সিরিয়া থেকে মক্কায় তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে দেখতে আসেন।
বায়তুল মাকদিসে গমন
পবিত্র মক্কা নগরীর জমজম কূপও মাকামে ইবরাহীমের মধ্যবর্তীস্থান থেকে রাতের একটি ক্ষুদ্রতম সময়ে বুরাক নামক বিদ্যুতের চাইতে তীব্র গতিসম্পন্ন একটি বাহনে চড়ে হযরত জিবরীল (আ.) সমভিব্যবহারে প্রথমে বায়তুল মাকদিসে যান, সেখান থেকে উর্ধ্বারোহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) মি’রাজে অনেক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন যা উম্মতের জন্য চিরকাল শিক্ষা ও আদর্শের উৎস হিসেবে কাজ করবে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মি’রাজে আমি এমন একদল লোকের কাছ দিয়ে গেলাম, যাদের নখ ছিল তামার। তারা এ নখ দিয়ে আপন মুখমণ্ডল ও বক্ষ আঁচড়াচ্ছিল। আমি জিবরীলকে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? তিনি বলেন, যারা মানুষের গোশত খায়; অর্থাৎ একে অপরের গীবত করে এবং পরনিন্দার মাধ্যমে একে অপরের মানহানি করে। এক ব্যক্তি নদীতে হাবুড়–বু খাচ্ছে এবং পাথর ভক্ষণ করছে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? বলেন, এরা সুদখোর।’
এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) এমন লোকদের নিকট দিয়ে অতিক্রম করেন, যাদের অগ্রে-পশ্চাতে তালি লাগানো ছিল। তারা গৃহপালিত পশু ও উটের মতো ঘাস খাচ্ছিল। যাক্কূম, নূড়ি এবং জাহান্নামের পাথর চিবাচ্ছিল। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, এরা কারা? জিবরীল (আ) বলেন, এরা সম্পত্তির যাকাত আদায় করেনি। এরপর তিনি আর এক সম্প্রদায়ের কাছ দিয়ে অতিক্রমকালে দেখেন, একটি পাত্রে রান্না করা ভালো গোশত এবং অপার পাত্রে পচা গোশত। তারা পচা গোশতণ্ডলো ভক্ষণ করছিল। তাদের পরিচয় জানতে চাইলে জিবরীল (আ.) বলেন, এরা আপনার উম্মতের সেসব পুরুষ যাদের গৃহে হালাল ও পবিত্র স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তারা পরনারীর কাছে যায় এবং রাত্রি যাপন করে।
আমি আরও কিছুসংখ্যক লোক দেখলাম তাঁদের ঠোঁট উটের মতো এবং তাদের হাতে মুঠোয় রয়েছে জ্বলন্ত অঙ্গারের ন্যায় ছোট ছোট পাথরের টুকরো। সেগুলো তারা মুখে পুরছে এবং পরক্ষণেই তা মলদ্বার দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাঈল! এরা কারা? তিনি বললেন, ‘এরা এতিমের সম্পদ আত্মসাৎকারী।’
আমি আরেক দল লোক দেখলাম। তাদের পেটের মত বীভৎস আকৃতির পেট আর কখনো দেখিনি। দেখলাম, ফিরআউনের সহযোগীদের যে পথ দিয়ে দোযখে নেয়া হচ্ছে , সে পথের ওপর তারা অবস্থান করছে। তারা তৃষ্ণার্থ উটের ন্যায় ছটফট করছে। আর ফিরআউনের দোযখগামী অনুসারীরা তাদেরকে পায়ের তলায় পিষ্ট করে যাচ্ছে তথাপি সেখান থেকে একটু সরে দাঁড়াবার ক্ষমতাও তাদের নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাঈল! এরা কারা? তিনি বললেন, ‘এরা সুদখোর মহাজন, সাৎকারী।’
অতঃপর কতিপয় নারীকে দেখরাম তাদের স্তন রশি বেধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাঈল! এরা কারা? তিনি বললেন, ‘এরা সেসব নারী, যারা ব্যভিচারের মাধ্যমে অন্যের ঔরসজাত সন্তান স্বামীর সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত করে দেয়।
তিনি এমন এক জাতির নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, যারা ক্ষেতে যেদিন বীজ বপন করছেন, সেদিনই ফসল কর্তন করছেন এবং ফসল কর্তনের সাথে সাথে ক্ষেত পুনরায় ফসল ভরে উঠছে। তিনি জিবরাঈল (আ.)-কে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে জিবরাঈল (আ.) বললেন, এরা আল্লাহর পথে জিহাদকারী, তাদের একটি পুণ্য সাত শত পুণ্যের রূপ নেয় এবং এরা যা খরচ করেছে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় নেয়ামত দ্বারা তার পরিবর্তন সাধন করেছেন।
আরেক সম্প্রদাযের লোকদের অতিক্রম কালে দেখা গেল প্রস্তরঘাতে তাদের মাথা চূর্ণ করা হচ্ছে। অতঃপর তাদের মাথা আগের মত হয়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্য নিরন্তর চালু ছিল। নবী করিম সা. জিজ্ঞেস করলেন, এরা কারা? জিবরাঈল আ. বললেন, ফরয নামাযের ক্ষেত্রে এরা গড়িমসি করত।
তিনি এক কাষ্ঠখণ্ডের নিকট দিয়ে গমন করছিলেন। সেটি পড়েছিল পথের ধারে। তাকে অতিক্রম করার সময় কাঠটি যে কোন কাপড় ছিড়ে ফেলে। তিনি এ কাষ্ঠখণ্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে জিবরাঈল (আ.) বললেন, এই কাষ্ঠখণ্ডটি আপনার সেসব উম্মতের দৃষ্টান্ত যারা পথের ধারে বসে দস্যুবৃত্তি করত।
অতঃপর দেখলেন কিছু লোক এক বোঝা কাষ্ঠ সংগ্রহ করেছে। তবে সেটি বহনের মত শক্তি তাদের নেই। তথাপি বোঝা তারা বড় করে চলছেই। তিনি তাদের পরিচয় জানতে চাইলেন। জিবরাঈল (আ.) বললেন, তারা আপনার উম্মতের সেসব ব্যক্তি যারা মানুষের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারে না, এরপরও অধিক আমানত তার নিজেদের ওপর চাপিয়ে চলছে।
কিছু লোকের জিহ্বা ও ঠোঁট কাঁচি দ্বারা কাটা হয়। এভাবে এ কাজ অব্যাহত ছিল। বিশ্বনবী (সা.) তাদের পরিচয় জানতে চাইলেন। জিবরাঈল (আ.) বললেন, ওরা সেসব বক্তা যারা অপরকে আমল করতে বলত অথচ নিজেরা আমল করত না।
পথিমধ্যে এমন এক প্রান্তর অতিক্রম করলাম যেখানে অসংখ্য খেজুর বৃক্ষরাজি দৃষ্টিগোচর হল। জিবরাঈল (আ.) বললেন, এখানে অবতরণপূর্বক দু’রাকাত নফল নামায আদায় করুন। আমি অবতরন করে নামায পড়লাম। জিবরাঈল (আ.) বললেন, জানেন আপনি কোন্ স্থানে নামায পড়লেন? আমি বললাম, না, তা আমার জানা নেই। জিবরাঈল (আ.) বললেন, আপনি ইয়াসরির অর্থাৎ পবিত্র মদীনায় নামায পড়লেন, যেখানে আপনি হিজরত করবেন। অতঃপর সেখান থেকে পুনরায় যাত্রা শুরু হল। অপর স্থানে এসে পুনরায় জিবরাঈল আ. নামায আদায় করতে বললেন। আমি নেমে নামায আদায় করলাম। জিবরাঈল আ. বললেন, এ জায়গার নাম সীনা উপত্যকা। এখানে ছিল একটি বৃক্ষ। এর নিকটে হযরত মূসা (আ.) আল্লাহর সাথে কথা বলেছিলেন। আপনি সেই বৃক্ষের কাছেই নামায পড়লেন। আবার আরেকটি প্রান্তর অতিক্রম কালে জিবরাঈল (আ.) তথায় নামায পড়তে বললে আমি নেমে নামায আদায় করলাম। জিবরাঈল (আ.) বললেন, আপনি মাদায়েনে নামায আদায় করলেন। এখানে হযরত শোয়াইব (আ.)-এর বাসস্থান ছিল। আবার যাত্রা শুরু হল। আরেক স্থানে পৌঁছে জিবরাঈল (আ.) পুনরায় নামায পড়তে বললেন। আমি নামায পড়লাম। জিবরাঈল (আ.) বললেন, এটা বায়তুল লাহাম, যেখানে হযরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন।
হঠাৎ রাস্তার একদিকে তিনি একটি বৃদ্ধাকে দেখতে পান। তিনি (সা.) বলেন, ইনি কে? হে জিবরীল! তিনি বলেন, চলুন, হে মুহাম্মদ! তিনি চলতে থাকেন। আবার রাস্তার ধারে একটি জিনিস তাঁকে ডাকলো, আসুন, হে মুহাম্মদ! তখন জিবরীল তাঁকে বলেন, চলুন, হে মুহাম্মদ! তাই তিনি চলতে লাগলেন।
তাঁরা বললেন, আসসালামু আলাইকা, হে হাশির (যাঁর পরে কেউ নেই)। তখন তাঁকে জিবরীল (আ.) বলেন, আপনি সালামের জবাব দিন। তাই তিনি সালামের জবাব দিলেন। তারপর তিনি দ্বিতীয় ও তৃতীয়জনের সাক্ষাৎ পেলেন। তাঁদেরকেও তিনি ঐরূপ বললেন। তারপর জিবরীল বলেন, সেই বৃদ্ধা যাকে আপনি রাস্তার ধারে দেখেছিলেন সে হচ্ছে পৃথিবীর সেই অংশ যতটা বয়স এই বৃদ্ধার বাকী আছে। আর সে চেয়েছিল যে, আপনি তার প্রতি আকৃষ্ট হন। সে ছিল আল্লাহর দুশমন ইবলীস। সে চেয়েছিল যে, আপনি তার দিকে ঝুঁকে যান। আর যারা আপনাকে সালাম দিয়েছিলেন তারা হলেন ইবরাহীম এবং মুসা ও ঈসা (আ.)।
আমি যখন বুরাকে চড়ে বায়তুল মাকদিসের দিকে যাচ্ছিলাম তখন ডান ও বাম দিক হতে দু’জন আমাকে ডাক দিল। আমি তাদের ডাকে সাড়া দেইনি। চলার পথে এক অপূর্ব সুন্দরী মহিলাকে দেখলাম। সে আপন বাহুযুগল উন্মুক্ত করে রেখেছিল এবং অপরূপ সাজে সে ছিল সজ্জিতা। সে আমাকে ডাক দিয়ে বলল, মুহাম্মদ এদিকে এসো! আপনাকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করবো। আমি তার কোন জবাব দেইনি। আমি পথে আমাকে আহ্বানকারীদের সম্পর্কে জিবরাঈলকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বলেন, ডানদিকের আহবানকারী ইহুদী। আপনি যদি ওর ডাকে সাড়া দিতেন তাহলে আপনার উম্মত ইহুদী হয়ে যেত। বাম দিকের আহ্বানকারী খ্রিষ্টান। আপনি যদি ওর ডাকে সাড়া দিতেন তাহলে আপনার উম্মত খ্রিষ্টান হয়ে যেতো। আর বাহু যুগল অনাবৃত নারীটি এই পৃথিবী। আপনি যদি ওর ডাকে সাড়া দিতেন তাহলে আপনার উম্মত পরকালের ওপর এই দুনিয়াকে প্রাধান্য দিত।
তারপর বুরাক আমাদের নিয়ে চললো। পরিশেষে আমরা ইয়ামনী দরজা দিয়ে বায়তুল মাকদিস শহরে ঢুকলাম। অতঃপর আমি মসজিদটির কিবলার দিকে এলাম। তারপর তিনি ওখানে বুরাকটি বাঁধলেন যে স্থানে নবীগণ তাঁদের জন্তুগুলো বাঁধতেন। অতঃপর তাঁর কাছে পানি, শারাব এবং দুধ পেশ করা হল। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) দুধটাকে গ্রহণ করলেন। অতঃপর জিবরাঈল (আ.) বলেন, আপনি স্বভাবজাত প্রকৃতিকে পেয়ে গেছেন। আপনি যদি পানিটা পান করতেন তাহলে আপনি ডুবে যেতেন এবং আপনার উম্মতও ডুবে যেত। আর আপনি যদি শরাব পান করতেন তাহলে আপনি পথভ্রষ্ট হতেন এবং আপনার উম্মতও বিভ্রান্ত হয়ে যেত। অতঃপর আমি বাইতুল মাকদিসের মসজিদে আকসায় ঢুকলাম। সেখানে আগে থেকেই হযরত ইবরাহীম (আ.), হযরত মূসা (আ.), হযরত ঈসা (আ.)সহ প্রাক্তন নবী-রাসূলগণ অপেক্ষমান ছিলেন। তারপর জিবরাঈল আমাকে সামনে এগিয়ে দিলেন। পরিশেষে আমি তাঁদের ইমামতি করলাম।
ঊর্ধ্বজগতে যাত্রা
আমি যখন বায়তুল মাকদিসের কর্মসূচি থেকে অবসর পেলাম তখন একটি সিঁড়ি আমার কাছে আনা হল। এর চেয়ে সুন্দর জিনিস আমি দেখিনি। এটাই সিঁড়ি যার দিকে মরণাপন্ন ব্যক্তি চেয়ে থাকে যখন তার কাছে মৃত্যু হাজির হয়। অতঃপর জিবরাঈল আমাকে তাতে চড়িয়ে দিলেন। পরিশেষে আমি আকাশের দরজাগুলোর মধ্যে একটি দরজার কাছে পৌঁছলাম। যার নাম বাবুল হিফাযা তথা সংরক্ষিতদের দরজা। তাতে একজন ফেরেশতা আছে। যার নাম ইসমাঈল। তার অধীনে রয়েছে বার হাজার ফেরেশতা। ওদের মধ্যকার ফেরেশতার অধীনে বার হাজার করে ফেরেশতা আছে।
পৃথিবীর অতি নিকটবর্তী ফেরেশতার নাম ইসমায়ীল। তার সামনে আছে সত্তর হাজার ফেরেশতা। তার প্রত্যেক ফেরেশতার সাথে একলাখ ফেরেশতার বাহিনী আছে। তিনি বলেন, অতঃপর জিবরাঈল আকাশটির দরজা খোলার প্রার্থনা করলেন। বলা হল, কে? তিনি বললেন, জিবরাঈল। আবার বলা হল, আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ। বলা হল, তার কাছে দূত পাঠানো হয়েছে কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর আমাদের জন্য দরজা খোলা হল। এভাবে সপ্তম আসমান পর্যন্ত পৌঁছলাম। আকাশের প্রতিটি স্তরে আমাকে পরিচয় দিতে হয় এবং দ্বার উন্মুক্ত করা হয়।
আসমানের স্তর অতিক্রম করার সময় পূর্ববর্তী মর্যাদাবান পয়গম্বরদের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। প্রথম আসমানে আদম (আ.), দ্বিতীয় আসমানে হযরত ইয়াহইয়া (আ.) ও হযরত ঈসা (আ.), তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসূফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হযরত ইদরীস (আ.), পঞ্চম আসমানে হযরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে হযরত মূসা (আ.) এবং সপ্তম আসমানে হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁকে আন্তরিক ও উষ্ণ সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন। ষষ্ঠ আসমান অতিক্রম করার সময় তিনি হযরত মূসা (আ.)-কে ক্রন্দনরত দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কাঁদছেন কেন? জবাবে হযরত মূসা (আ.) বলেন, আমার উম্মতের চাইতে পরবর্তী উম্মতের লোকেরা অধিক সংখ্যায় জান্নাতে যাবে।
সিদরাতুল মুন্তাহা
‘সিদরাতুল মুন্তাহা’ (سدرة المنتهى) হল আরশের ডান দিকে কুল জাতীয় বৃক্ষের মতো বিশাল এক মহীরুহ। এর ফলগুলো বড় বড় কলসির মত এবং ওর পাতাগুলো দেখতে হাতীর কানের মত প্রকান্ড। ওখানে ৪টি নদী আছে। দুটি অন্তর্মুখী এবং দুটি বহির্মুখী। আমি বললাম, এ দুটি কি? হে জিবরাঈল! তিনি বললেন, অন্তর্মুখী দুটো জান্নাতের মধ্যকার নদী। আর বহির্মুখী দুটি মিসরের নীল এবং ইরাকের ফোরাত নদী। সেখানে পৌঁছে তিনি মহান আল্লাহর অত্যাশ্চর্য নূর-জ্যোতি ও নিদর্শনসমূহ প্রত্যক্ষ করার দুর্লভ সৌভাগ্য লাভ করেন। অসংখ্য ফিরিশতা ও স্বর্ণপতঙ্গ সিদরাতুল মুন্তাহাকে ঘিরে রেখেছে। পৃথিবীসহ সৃষ্টিজগতের সব তথ্য-উপাত্ত ও বিবরণী এ প্রান্ত সীমায় এসে জমা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) এ স্থানে জিবরীল (আ.)-কে আসল অবয়বে দেখেন। এখানেই রয়েছে ‘জান্নাতুল মাওয়া’ নামক ফেরেশতা, শহীদদের রূহ ও মুত্তাকীদের আবাসস্থল। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমি আল্লাহর নূর প্রত্যক্ষ করেছি এবং আমার প্রতি আল্লাহ ওহি প্রেরণ করেন।’ ইবনে হাজর আসকালানী (রহ.), আল্লামা সুয়ূতী (রহ.) ও আল্লামা ইদরীস কান্ধলভী (রহ.) এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) কোন মাধ্যম ছাড়া আল্লাহ তা’আলার সাথে কথা বলেন।’ সেখানে আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে তিনটি নিয়ামত দান করেন, ১. পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, ২. সূরা বাকারার শেষের দিকের আয়াতসমূহ এবং ৩. শিরক থেকে বিরত থাকার সুসংবাদ। তাঁর উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি শিরকের পাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হবেন, আল্লাহ তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন।
অতঃপর আমাকে জান্নাতে নিয়ে যাওয়া হয়। এক যুবতী আমাকে অভ্যর্থনা জানালো। আমি বললাম, তুমি কার জন্য অপেক্ষমান হে যুবতী? সে বললো, আপনার পালকপুত্র যায়দ বিন হারিসার জন্য। মি’রাজ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর মহানবী (সা.) যায়দ বিন হারিসাকে এ সুসংবাদ দান করেন। অতঃপর আমি কতিপয় স্রোতস্বিনী দেখলাম স্বচ্ছ পানির, নির্ভেজাল দুধের ও খাঁটি মধুর, যার স্বাদ ও গন্ধ অপরিবর্তনীয়। রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তার সৎ বান্দাদের জন্য এমন জিনিস তৈরি করে রেখেছেন যা কোন চোখ দেখেনি এবং কোন কান শোনেনি। আর কোন মানুষের মনের কল্পনায়ও তা আসতে পারেনি (…) এখানে একটি ঝর্ণাধারাও আছে। যার নাম ‘সাল্সাবীল’ তা থেকে দ’ুটি স্রোতধারা বের হচ্ছে। একটির নাম ‘কাওসার’ এবং অপরটির নাম ‘নাহ্রুর রহ্মাহ’ বা করুনার ধারা। অতঃপর তাতে আমি গোসল করলাম।
বায়তুল মা’মূর
অতঃপর আমাকে বায়তুল মা’মূরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খিদমতে খাবারের একটি ডিশ উপস্থাপন করা হয়। প্রথমটি শরাবের, দ্বিতীয়টি দুধের এবং তৃতীয়টি মধুর পাত্র। আমি দুধের পাত্রটি ধরে দুধ পনে করলাম। জিবরাঈল (আ.) বললেন, এটাই তো স্বভাবধর্ম যার উপরে আপনি আছেন এবং আপনার উম্মত কায়েম রয়েছেন (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত, ৫২৭ পৃষ্ঠা)।
আমি বায়তুল মা’মুরে পিট ঠেকিয়ে সুন্দরতম পুরুষের বেশে আমাদের আদি পিতা হযরত ইবরাহীম (আ.)-কে দেখলাম। তার সঙ্গে কিছু লোকও ছিল। আমি তাঁকে সালাম দিলাম। তিনিও আমাকে সালাম দিলেন। আমি আমার উম্মতকে দু’টি দলে বিভক্ত দেখলাম। এক ভাগ এমন যাদের দেহ কাগজের মত শ্বেত-শুভ্র কাপড় দ্বারা আবৃত। আর এক ভাগ এমন যাদের দেহে ছাইরং কাপড় রয়েছে। অত:পর আমি বায়তুল মা’মূরে প্রবেশ করলাম। এমতাবস্থায় আমার সাথে সাদা কাপড় পরিহিত লোকেরাও ঢুকলো। তারা একপাশে থাকলো। আমি এবং সঙ্গীরা বায়তুল মা’মূরে নামায আদায় করলাম। তারপর আমি এবং সঙ্গীরা বেরিয়ে এলাম। বায়তুল মা’মূর এমন গৃহ যাতে প্রত্যেক দিন সত্তর হাজার ফেরেশ্তা নামায পড়েন। একবার যারা নামায পড়েন তারপর কিয়ামত পর্যন্ত তারা ফিরে আসার সুযোগ আর পায় না সংখ্যাধিক্যের কারণে।
ছারিফুল আকলাম
‘ছারিফুল আকলাম’ ((صريف الأقلام নামক স্থানটি ‘সিদরাতুল মুন্তাহা’-এর পরে অবস্থিত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, সপ্তম আসমানের উপরে আমাকে আরোহণ করা হলে আমি সেখানে ফেরেশতাদের কলম চালানোর আওয়াজ শুনতে পাই। এখানে ফেরেশতাগণ লাওহে মাহফুয থেকে জীবন মৃত্যু, রিয্ক, ভাগ্য, পরিণতি এক কথায় আল্লাহর নির্দেশাবলি লিপিবদ্ধ করেন।
হযরত আবূ হরায়রা (রা.) বর্ণিত এক হাদীসে জানা যায়, আল্লাহ তা’আলা তাঁকে একান্তে ডেকে বলেন, ‘আমি আপনাকে আমার বন্ধু বানিয়েছি, পৃথিবীর সব মানুষের জন্য বশীর ও নযীর (জান্নাতের সুসংবাদ দানকারী ও জাহান্নামের ভীতি প্রদর্শনকারী) বানিয়েছি; আপনার বক্ষ বিদারণ করে বোঝা হালকা করেছি, আপনার কণ্ঠকে উচচকিত করেছি, আমার তাওহীদের সাথে আপনার রিসালাত ও বন্দেগিকে যুক্ত করেছি, আপনার উম্মতকে শ্রেষ্ঠ উম্মতে রূপান্তরিত করেছি। আপনার উম্মতের কতিপয় মানুষের অন্তরে আমার কালাম উৎকীর্ণ থাকবে; আপনাকে রূহানি দিক দিয়ে প্রথম নবী ও প্রেরণের দিক দিয়ে শেষ নবী বানিয়েছি। আপনাকে সূরা ফাতিহা ও সূরা বাকারার শেষ অংশ দান করেছি। আপনাকে হাউজে কাওসার দান করেছি। আপনাকে উম্মতকে বিশেষভাবে আটটি নিয়ামত দান করেছি: ১. ইসলাম, ২. মুসলমান উপাধি, ৩. হিজরত, ৪. জিহাদ, ৫. নামায, ৬. সাদাকা, ৭. রামযানের রোযা ও ৮. সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ।
তারপর আমার কাছে ওহী করা হল যা ওহী করার। প্রত্যেক দিন ও রাতে আমার উপরে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হল। তারপর আমি নেমে এলাম। পরিশেষে হযরত মূসা (আ.)-এর কাছে পৌঁছলাম। হযরত মূসা (আ.) আমাকে বললেন, আপনাকে কি নির্দেশ দেয়া হল? আমি বললাম, দিন ও রাতে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি বললেন, আপনার উম্মত পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায দিন ও রাতে পড়তে পারবে না। কারণ, আল্লাহর কসম! আমি আপনার আগে লোকদেরকে পরীক্ষা করেছি এবং বণী ইসরায়ীলকে কঠিনভাবে যাচাই করেছি। তাই আপনি আপনার পালনকর্তার কাছে ফিরে যান। অত:পর আপনার উম্মতের জন্য তা হাল্কা করার প্রার্থনা করুন। ফলে আমি ফিরে গেলাম। অতঃপর আমার নামায দশ ওয়াক্ত কমিয়ে দেয়া হল। এমনিভাবে পাঁচবার প্রার্থনা করায় পঞ্চাশ থেকে পাঁচ ওয়াক্ত করা হয়। হযরত মূসা (আ.) বলেন, আল্লাহর কাছে গিয়ে আরো কমিয়ে আনুন। জবাবে বিশ্বনবী (সা.) বলেন, আমার পালনকর্তার কাছে বারবার যেতে লজ্জা লাগে। আমি পাঁচ ওয়াক্তের ওপর সম্মত ও রাজী হয়েছি। যখন আমি আল্লাহ তায়ালা এবং হযরত মূসা (আ.)-এর মাঝে আসা-যাওয়া করছিলাম তখন আল্লাহ আমাকে বলেন, হে মুহাম্মদ এই পাঁচ ওয়াক্ত নামায দিন ও রাতে থাকলো। প্রত্যেক নামাযের জন্য দশ নেকী। তাই যে ব্যক্তি প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়বে তাকে পঞ্চাশ ওয়াক্তের সওয়াব দেয়া হবে।
পবিত্র শবে মি’রাজে রাসূলুল্লাহ (সা.) বেহেশত ও দোযখ প্রত্যক্ষ করেন। তিনি বলেন, জান্নাতের ভূমি বিস্তীর্ণ সমতল এবং এর মাটি মেশকের মতো সুগন্ধিময়। দোযখ ফুটন্ত ঝরনার মতো টগবগে কুণ্ডলীবিশিষ্ট অগ্নিময়। জান্নাতে চারটি নদী প্রবহমান রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মি’রাজ রজনীতে আমি যখন হ্বরত ইবরাহীম (আ.)-এর নিকট দিয়ে গমন করি তখন তিনি বলেন, মুহাম্মদ! আপনার উম্মতকে আমার সালাম দিন এবং অবহিত করুন, জান্নাত সমতল ও উর্বর ভূমি এবং এর বৃক্ষ হচ্ছে,
«سُبْحَانَ اللهِ وَالْـحَمْدُ للهِ وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ».[i]
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমি সপ্তম আকাশে পৌঁছে তাসবীহর আওয়ায শুনলাম। জীবরাঈল (আ.) আমাকে বলেন, ভয় পাবেন না আরশের ডান পাশে লিখিত রয়েছে:
لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللهِ|
তিনি বলেন, ‘মি’রাজের রাত্রিতে আমি জান্নাতের দরজায় লিখিত দেখেছি,
«الصَّدَقَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا وَالْقَرْضُ الْوَاحِدُ بِثَمَانِيَةَ عَشَرَ».
‘দান-খয়রাতের দশণ্ডণ এবং যে কর্জ দেবে তাঁর জন্য আঠারো গুণ সওয়াব।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাঈল! সাদাকাহর তুলনায় কর্জ প্রদান শ্রেষ্ঠ কেন? তিনি বলেন, ভিক্ষুক সর্বদা যাচনা করে, যখন তার কাছে কিছু থাকে তখনও। কর্জ গ্রহণকারী তীব্র প্রয়োজন ছাড়া কর্জ গ্রহণ করে না।
একই রাতে স্বল্পসময়ের মধ্যে পবিত্র মিরাজের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তিনি পবিত্র মক্কার কা’বা প্রাঙ্গণে ফিরে আসেন। এসে দেখেন জগত যেমন চলছিল তেমনি চলছে।’
মি’রাজ দৈহিক না আত্মিক
এ ঘটনা কোন সাধারণ ঘটনা নয়, বরং তা বিস্ময়কর এক অলৌকিক ঘটনা। যা হযরত মুহাম্মদ (সা.) ব্যতীত আর কারো দ্বারা সম্পাদিত হয়নি। আল্লাহ তায়ালা স্বীয় ক্ষমতা বলে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে সশরীরে এবং পূর্ণজাগ্রত অবস্থায় উর্ধ্বলোকে ভ্রমণ করিয়েছেন। সকল সাহাবা, তাবেয়ী এবং সালফে সালেহীনদের বিশ্বাস ও অভিমত এটাই। কেবল দু’তিনজন সাহাবা এবং তাবেয়ীদের অভিমত হল, মি’রাজের ভ্রমণ দৈহিক ছিল না বরং আত্মিক ছিল অথবা অত্যাশ্চর্য স্বপ্ন ভিত্তিক ছিল। তবে বিশুদ্ধ অভিমত এটাই, মি’রাজের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ ঘটনা পবিত্র জাগতিক দেহে জাগ্রত অবস্থায় সংঘটিত হয়েছিল। যদি তা অশরীরি বা স্বপ্নযোগে হতো তাহলে মক্কার মুশরিকরা তা নিয়ে উপহাস করত না এবং বায়তুল মাকদিসের বিবিধ নিদর্শনও তার সামনে তুলে ধরা হত না। কারণ স্বপ্নে দৃষ্ট বিষয় নিয়ে কেউ উপহাস করে না এবং তা নিয়ে অসংখ্য প্রশ্নের অবতারণাও করে না। স্বপ্ন যোগে ইহূদী-খ্রিষ্টানরাও আসমান, দোযখ, বেশেত পরিভ্রমণ করতে পারে। মি’রাজ মূলত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মু’জিযার বহিপ্রকাশ।
আল্লাহ সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে কিনা
মি’রাজের রজনীতে তিনি আল্লাহকে দেখেছেন কিনা এ নিয়ে উলামাগণ ভিন্ন ভিন্ন অভিমত প্রকাশ করেছেন। যারা বলেন, দর্শন লাভ করেছেন, তাদের মধ্যেও মত পার্থক্যও রয়েছে। তিনি কি চর্মচক্ষু দ্বারা দর্শন করেছেন? নাকি অন্তর্চক্ষু দ্বারা? আল্লামা ইদরীস কান্ধলবী (রহ.) এ প্রসঙ্গে বলেন, সংখ্যাগরিষ্ট সাহাবা এবং তাবেয়ীদের অভিমত হল, তিনি চর্ম নয়নে আল্লাহকে দর্শন করেছেন। হকপন্থী উলামাগণ এ অভিমতকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং তা বিশুদ্ধ অভিমত বলে রায় প্রকাশ করেছেন। মুসনাদে আহমদ নামক হাদীস গ্রন্থে সহীহ সনদের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে, এ ব্যাপারে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলে উত্তরে তিনি বলেন, “মি’রাজ রজনীতে আমি আল্লাহকে দেখেছি।’ ইমাম তাবরানী, হাকেম ও তিরমিযী হযরত আনাস (রাযি.) থেকে বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) বলেন, ‘আমি আল্লাহর নুর দর্শন করেছি। অতঃপর আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী তিনি আমার সাথে কথা বলেন।’ ইবনে আব্বাসের অপর রেওয়ায়েতে বোঝা যায়, মি’রাজের রাতে আল্লাহ তায়ালা মহানবী (সা.)-কে চর্মচক্ষু ও অন্তর্চক্ষুর মাঝে এমন এক সমন্বয় সাধন করেছিলেন যে, দু’চোখের দৃষ্টির মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। হাফেয তুরপুসতী ‘আল-মুতামিদ ফিল মুতাকিদ’ গ্রন্থে লিখেছেন, অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা জ্ঞান ও পরিচয় লাভ করা উদ্দেশ্য ছিল না। আল্লাহর জ্ঞান ও পরিচয় সম্পর্কে মহানবী (সা.) পূর্বেই জ্ঞাত ছিলেন। বরং উদ্দেশ্য এটাই ছিল যে, আল্লাহ পাক তার অন্তর ও বাহ্যিক চক্ষুর সমন্বয়ে দর্শন দান করেছিলেন। দর্শনের সময় দু’চোখ একই সঙ্গে দর্শন করেছে। চক্ষু অন্তর থেকেও পৃথক হয়নি, আবার অন্তরও চক্ষু থেকে পৃথক হয়নি।
মহান আল্লাহ শবে মি’রাজের তাৎপর্য অনুধাবন করার তাওফীক আমাদের দান করুন।
সূত্র:
সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদবী, নবীয়ে রহমত, খ. ১, পৃ. ১৪৮
আল-কুরআন, সূরা আল-ইসরা, ১৭:১
আল-কুরতুবী, আল-জামি লি-আহকামিল কুরআন, দারুল কুতুব আল-মিসরিয়া, কায়রো, মিসর (১৩৮৪ হি. = ১৯৬৪ খ্রি.), খ. ১০, পৃ. ২০৭
আস-সুয়ুতী, আল-খাসায়িসুল কুবরা, খ. ১, পৃ. ১৫৬
(ক) আস-সুয়ুতী, আল-খাসায়িসুল কুবরা, খ. ১, পৃ. ১৭২; (খ) আয-যুরকানী, শরহুল মাওয়াহিবুল লুদুনিয়া বিল মানহিল মুহাম্মাদিয়া, খ. ৬, পৃ. ৪১
ইবনে হিশাম, আস-সীরাতুন নাবাওয়ীয়া, খ. ১, পৃ. ৪৫০
ইবনে হিশাম, প্রাগুক্ত, খ. ১, পৃ. ৪৫০
ইবনে হিশাম, প্রাগুক্ত, খ. ১, পৃ. ৪৫১
আস-সুয়ুতী, আল-খাসায়িসুল কুবরা, খ. ১, পৃ. ১৭২
(ক) আস-সুয়ুতী, আল-খাসায়িসুল কুবরা, খ. ১, পৃ. ১৭২; (খ) আয-যুরকানী, প্রাগুক্ত্, খ. ৬, পৃ. ৪১
(ক) আস-সুয়ুতী, আল-খাসায়িসুল কুবরা, খ. ১, পৃ. ১৭২; (খ) আয-যুরকানী, প্রাগুক্ত, খ. ৬, পৃ. ৪১
(ক) আস-সুয়ুতী, আল-খাসায়িসুল কুবরা, খ. ১, পৃ. ১৭২; (খ) আয-যুরকানী, প্রাগুক্ত, খ. ৬, পৃ. ৪১
(ক) আস-সুয়ুতী, আল-খাসায়িসুল কুবরা, খ. ১, পৃ. ১৭২; (খ) আয-যুরকানী, প্রাগুক্ত, খ. ৬, পৃ. ৪১
(ক) আস-সুয়ুতী, আল-খাসায়িসুল কুবরা, খ. ১, পৃ. ১৫৩Ñ১৫৮; (খ) ইবনে হাজর আল-আসকলানী, ফতহুল বারী শরহু সহীহ আল-বুখারী, খ. ১, পৃ. ৫৩
ইবনে জরীর আত-তাবারী, জামিউল বায়ান ফী তাওয়ীলিল কুরআন, খ. ১৫, পৃ. ৫
(ক) আয-যুরকানী, প্রাগুক্ত, খ. ৬, পৃ. ৫; (খ) আস-সুয়ুতী, আদ-র্দুরুল মনসূর ফীত তাফসীর বিল-মাসূর, খ. ৪, পৃ. ২৬০, ২৬২Ñ২৬৪; (গ) ইবনে কসীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, খ. ৩, পৃ. ৭
(ক) ইবনে হিশাম, প্রাগুক্ত, খ. ১, পৃ. ৪৪৭; (খ) ইবনে জরীর আত-তাবারী, প্রাগুক্ত, খ. ১৫, পৃ. ১১
ইবনে কসীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, খ. ৩, পৃ. ১৩
(ক) আস-সুয়ুতী, আদ-র্দুরুল মনসূর ফীত তাফসীর বিল-মাসূর, খ. ৬, পৃ. ১৮৬Ñ১৮৭; (গ) সফীউর রহমান মুবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ১৬৪
আস-সুয়ুতী, আদ-র্দুরুল মনসূর ফীত তাফসীর বিল-মাসূর, খ. ৬, পৃ. ১৮৬
আল-কুরআন, সূরা আন-নাজম, ৫৩:৮Ñ১৫
আস-সুয়ুতী, আদ-র্দুরুল মনসূর ফীত তাফসীর বিল-মাসূর, খ. ২, পৃ. ১২৩
মুহাম্মদ ইদরীস আল-কান্ধলবী, সীরাতে মুস্তাফা, খ. ১, পৃ. ৩০৭
ইবনে হিশাম, প্রাগুক্ত, খ. ১, পৃ. ৪৫৩
(ক) আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত, বয়রুত, লেবনান, খ. ৫, পৃ. ৫৩, হাদীস: ৩৮৮৭; (খ) মুসলিম, আস-সহীহ, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরবী, বয়রুত, লেবনান, খ. ১, পৃ. ১৫৪, হাদীস: ২৭২ (১৬৮); (গ) আত-তাবরীযী, মিশকাতুল মাসাবীহ, আল-মাকতাবুল ইসলামী, বয়রুত, লেবনান, খ. ৩, পৃ. ১৬৩৬, হাদীস: ৫৮৬২ (১)
(ক) ইবনে হিশাম, প্রাগুক্ত, খ. ১, পৃ. ৪৫২Ñ৪৫৩; (খ) আল-বায়হাকী, দালায়িলুন নুবুওয়াত ওয়া মারিফাতু আহওয়ালি সাহিবিশ শরিয়ত, খ. ২, পৃ. ১৩৯; (গ) আস-সুয়ুতী, আদ-র্দুরুল মনসূর ফীত তাফসীর বিল-মাসূর, খ. ৪, পৃ. ২৬৮
(ক) আল-বুখারী, প্রাগুক্ত, খ. ১, পৃ. ৭৯, হাদীস: ৩৪৯; (খ) মুসলিম, প্রাগুক্ত, খ. ১, পৃ. ১৪৮, হাদীস: ২৬৩ (১৬৩); (গ) আত-তাবরীযী, প্রাগুক্ত, খ. ৩, পৃ. ১৬৩৯, হাদীস: ৫৮৬৪ (৩); (ঘ) আয-যুরকানী, প্রাগুক্ত, খ. ৬, পৃ. ৮৮
(ক) আস-সুয়ুতী, আল-খাসায়িসুল কুবরা, খ. ১, পৃ. ১৭৫; (খ) আয-যুরকানী, প্রাগুক্ত, খ. ৬, পৃ. ১০৩
(ক) মুসলিম, প্রাগুক্ত, খ. ১, পৃ. ১৪৮, হাদীস: ২৬৩ (১৬৩); (খ) ইবনে আবু শায়বা, আল-মুসান্নাফ ফীল আহাদীস ওয়াল আসার, খ. ১৪, পৃ. ৩০৪
(ক) ইবনে সাইয়িনুন নাস, ‘উয়ূনুল আসর ফীল মাগাযী ওয়াশ-শামায়িল ওয়াস সিয়র, খ. ১, পৃ. ২৪৬Ñ২৪৭; (খ) ইবনে কাইয়িম আল-জওযিয়া, যাদুল মা‘আদ ফী হাদয়ি খাইরিল ইবাদ, খ. ২, পৃ. ৪৭Ñ৪৮
(ক) ইবনে সাইয়িনুন নাস, প্রাগুক্ত, খ. ১, পৃ. ২৪৬Ñ২৪৭; (খ) ইবনে আবু শায়বা, প্রাগুক্ত, খ. ১৪, পৃ. ৩০৪
(ক) আস-সুয়ুতী, আল-খাসায়িসুল কুবরা, খ. ১, পৃ. ১৬৯; (খ) মুহাম্মদ ইদরীস আল-কান্ধলবী, সীরাতে মুস্তাফা, খ. ১, পৃ. ৩০৩Ñ৩০৪
আস-সুয়ুতী, আদ-র্দুরুল মনসূর ফীত তাফসীর বিল-মাসূর, খ. ৬, পৃ. ২১৩
আস-সুয়ুতী, আদ-র্দুরুল মনসূর ফীত তাফসীর বিল-মাসূর, খ. ৬, পৃ. ২১২Ñ২১৪
আস-সুয়ুতী, আদ-র্দুরুল মনসূর ফীত তাফসীর বিল-মাসূর, খ. ৬, পৃ. ২১৩
(ক) আস-সুয়ুতী, আল-খাসায়িসুল কুবরা, খ. ১, পৃ. ১৬৯; (খ) মুহাম্মদ ইদরীস আল-কান্ধলবী, সীরাতে মুস্তাফা, খ. ১, পৃ. ৩১২Ñ৩১৩
(ক) আস-সুয়ুতী, আল-খাসায়িসুল কুবরা, খ. ১, পৃ. ৩২২Ñ৩২৪; (খ) আস-সুয়ুতী, আল-খাসায়িসুল কুবরা, খ. ১, পৃ. ১৬১; (গ) আস-সুয়ুতী, আদ-র্দুরুল মনসূর ফীত তাফসীর বিল-মাসূর, খ. ৬, পৃ. ১২৩Ñ১২৪