এক অনন্য সাধারণ আলেমে দীন: মাওলানা আবদুল বাসিত বরকতপুরী (রহ.)
(১৯৪৫-২০১৭খ্রি.)
শাহ নজরুল ইসলাম
এক.
বিশ্বখ্যাত ফার্সী কবি শায়খ সাদী (রহ.) বলেছেন, ‘সকল শিশির বিন্দু মুক্তা যদি হতোÑবাজারে বিকাতো তাহা তরমুজের মত’। মুক্তা হওয়া অনেক বড় বিষয়। লাখো আলেমের মধ্যে মানিক মুক্তায় পরিণত হয়েছিলেন মাওলানা আবদুল বাসিত বরকতপুরী (রহ.)। তাঁর মেধা মননশীলতা, অধ্যাবসায়, আমল, আখলাক, চরিত্র-বৈশিষ্ট্য, ভারসম্যপূর্ণ মেজায, সদাচরণ, শালীনতা, ভদ্রতা শরাফত, বাইর-ভেতরের পরিচ্ছন্নতা, আলোকিত চিন্তা-ভাবনা, অন্তর্দৃষ্টি, উদারতা, সহনশীলতা, ইবাদত-বন্দেগীর নিমগ্নতা, শেষ রাতে মা‘বূদের দরবারে সিজদাবনত নৈমিত্তিক হাজিরা দান আর রুনাজারী, নিয়মিত কুরআন মজীদ তিলাওয়াত, জামাতে নামাযের গুরুত্ব, মেহমান নেওয়াযী, দূরদৃষ্টি, বিচক্ষণতা, মালিকের স্মরণে ব্যাকুলতা, স্বচ্ছতা, তাকওয়া-পরহেযগারী, কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা, বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতা, শিক্ষা প্রশাসন ও সংস্থায় নেতৃত্বদান, বাংলাদেশে ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং-এর বিকাশে অবদান এসবের সমন্বয় ঘটেছিল বরকতপুরী হুজুরের মাঝে। সচরাচর একজনের মাঝে এতগুণের সমাবেশ দেখা যায় না। কী শিক্ষকতা, কী মাদরাসার অধ্যক্ষ, কী বোর্ডের সেক্রেটারি, কী ব্যাংকের শরীয়া বোর্ডের চেয়ারম্যান, কী কোন সংকট সমাধানের সালিস, কী দারসে হাদীসের মসনদের শায়খ, কী আরবী সাহিত্যের আসরে অধ্যাপনা, কী গোল টেবিল বৈঠকের আলোচক বা মডারেটর, কী বিষয় ভিত্তিক আলোচনা সর্বত্রই তিনি ছিলেন সাবলীল স্বাচ্ছন্দ্য ও গতিশীল।
আরবী অলঙ্কার শাস্ত্রের কিতাব মুখতাসারুল মা‘আনীতে একটি নীতিকথা আছে ‘শারফুল মাকীনি বিল মাকান’ ব্যাক্তির মর্যাদা তার অবস্থান বা আসন দ্বারা নির্ণিত হয়; এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু পৃথিবীতে কিছু ক্ষণজন্মা কিংবদন্তী মানুষের জন্ম হয় যাদের ক্ষেত্রে এ নীতির উল্টোটা ঘটে। তখন হয়ে যায় ‘শারফুল মাকানি বিল মাকীন’। যাদের কারণে তাদের অবস্থান/আসনের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। এরকমই একজন মানুষ ছিলেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের খতীব, বাংলাদেশের প-িত আলেম মাওলানা উবায়দুল হক রহ., আর এ তবকারই এক জন আলেম ছিলেন-মাওলানা আবদুল বাসিত বরকতপুরী। তিনি যখনে যে আসনে সমাসীন হয়েছেন সে আসনের মর্যাদা ও মহিমা অনেক বেড়ে গেছে।
শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে-‘আচরণের কাক্সিক্ষত পরিবর্তন’ শিক্ষা মানুষের মাঝে ভদ্রতা-শরাফত, সম্ভ্রম ও সভ্যতা তৈরি করে। বহু মানুষ শিক্ষিত হয়, আলেম হয়, কিন্তু সভ্য, ভদ্র, শরীফ হতে পারে না, তার মধ্যে সম্ভ্রম তৈরি হয় না, তার আচরণে কাঙিক্ষত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় না। মানুষ তাদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকে। কিন্তু বরকতপুরী হুজুর শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে ধারণ করেছিলেন। ফলে তাঁর মাঝে শরাফত ছিল পূর্ণ মাত্রায়। বিষয়টি বংশ বা সনদ কিংবা পোষাকের সাথে জড়িত নয়, এটি অনুশীলন ও অভ্যাসের সাথে জড়িত।
দুই.
সিলেটর প্রবীন আলেমে দীন আজাদ দ্বীনি এদারার সাবেক মহাসচিব শায়খুল হাদীস আল্লামা আবদুল বাসিত বরকতপুরী গতকাল ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭ শনিবার সন্ধ্যা ৬.৩০মি. ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন। যার উপস্থিতিতে মজলিস গুলে গুলজার হতো তিনি আজ নীরব, নির্বাক, স্তব্ধ কন্ঠ, আখিরাতের প্রথম মনযিলের যাত্রী। তাঁকে মর্যাদাপূর্ণ বিদায় সংবর্ধনা দিতে সিলেটের ঐতিহাসিক আলিয়া মাদরাসা ময়দানে তাঁর সালাতুল জানাযায় লাখো মানুষের উপস্থিতি তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা, ব্যাক্তিত্ব, গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করে।
জীবন মৃত্যুর বাগঢোর মহামহিম আল্লাহর হাতে এবং আমরা সবাই তাঁর ইচ্ছার কাছে সমর্পিত। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর সংবাদ আসে এবং এতে আমরা শোকগ্রস্থ ও মর্মাহত হই; কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু আমাদের জন্য অপূরনীয় শূন্যতা বয়ে আনে। বরকতপুরী হুযুরের ইন্তিকাল আমাদের কেবল শোক সাগরে ভাসায়নি বরং এক অপূরনীয় ক্ষতি ও শূন্যতা তৈরি করে দিয়েছে। তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে অনেক কিছু লেখার আছে। আমরা ক্রমান্বয়ে লেখার চেষ্টা করবো। মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। আমীন।
লেখক: লেখক, গবেষক, বহুগ্রন্থ প্রণেতা