আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসেম্মলন ২০১৭
ইলমে দীনের গুরুত্ব ও ফযীলত
মাওলানা হাফেয মুহাম্মদ যাকারিয়া আযহারী (দা. বা.)
মুহাদ্দিস, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া ও সম্পাদক, আন-নূর পত্রিকা (ত্রৈমাষিক আরবী পত্রিকা)
الْـحَمْدُ للهِ نَحْمَدُهُ، وَنَسْتَعِيْنُهُ، وَنَسْتَغْفِرُهُ، وَنُؤْمِنُ بِهِ، وَنَتَوَكَّلُ عَلَيْهِ، وَنَعُوذُ بِاللهِ مِنْ شُرُوْرِ أَنْفُسِنَا، وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا، مَنْ يَّهْدِهِ اللهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ، وَمَنْ يُّضْلِلْهُ فَلَا هَادِيَ لَهُ، وَنَشْهَدُ أَنْ لَّا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ، وَنَشْهَدُ أَنَّ سَيِّدَنَا وَمَوْلَانَا مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ، الَّذِيْ أَرْسَلَهُ اللهُ تَعَالَىٰ إلَىٰ كَافَّةِ النَّاسِ بَشِيْرًا وَّنَذِيْرًا، وَدَاعِيًا إِلَى اللهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُنِيْرًا، صَلَّى الله تَعَالَىٰ عَلَيْهِ وَعَلَىٰ آلِهِ وَأَصْحَابِهِ، وَبَارِكْ وَسَلِّمْ تَسْلِيْمًا كَثِيْرًا كَثِيْرًا.
أَمَّا بَعْدُ! فَقَالَ تَعَالَىٰ: [فَلَوْ لَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَآىِٕفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُوْا فِي الدِّيْنِ وَلِيُنْذِرُوْا قَوْمَهُمْ اِذَا رَجَعُوْۤا اِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُوْنَؒ۰۰۱۲۲] {التوبة: ১২২}، وَقَالَ تَعَالَىٰ فِيْ آيَةٍ أُخْرَىٰ: [يَرْفَعِ اللّٰهُ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا مِنْكُمْ١ۙ وَالَّذِيْنَ اُوْتُوا الْعِلْمَ دَرَجٰتٍ١ؕ وَاللّٰهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِيْرٌ۰۰۱۱] {المجادلة: ১১} صَدَقَ اللهُ مَوْلَانَا الْعَظِيْمُ، وَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: مَنْ سَلَكَ طَرِيْقًا يَلْتَمِسُ فِيْهِ عِلْمًا، سَهَّلَ اللهُ لَهُ بِهِ طَرِيْقًا إِلَى الْـجَنَّةِ، وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِيْ بَيْتٍ مِنْ بُيُوْتِ اللهِ، يَتْلُوْنَ كِتَابَ اللهِ، وَيَتَدَارَسُوْنَهُ بَيْنَهُمْ، إِلَّا نَزَلَتْ عَلَيْهِمِ السَّكِيْنَةُ، وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْـمَلَائِكَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيْمَنْ عِنْدَهُ – أَوْ كَمَا قَالَ النَّبِيُّ ﷺ – رواه مسلم في صحيحه (৪ / ২০৭৪) (رقم: ২৬৯৯).
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী দীনী দরসেগাহ, আযীয মাদরে ইলমী আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার দু’দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক বার্ষিক ইসলামী মহাসম্মেলনের মুহতরম সভাপতি, মঞ্চে উপবিষ্ট সম্মানিত শ্রদ্ধাভাজন হযরাতে আসাতেযায়ে কেরাম, দূর-দূরান্ত থেকে আগত সম্মানিত অতিথিবৃন্দ, আমার প্রিয় আযীয ভাইয়েরা, সর্বপ্রথম আল্লাহ পাক পরওয়ারদেগারের শুকরিয়া আদায় করছি, যে আল্লাহ পাক পরওয়ারদেগার প্রত্যেক বছরের ন্যায় এই বছরও এ বৃহত্তম দীনী প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক মাহফিলে আমাদেরকে হাজির হওয়ার তওফীক দান করেছেন। আল্লাহ পাক যে, আমাদেরকে এত বড় একটি বিশাল নেয়ামত দান করেছেন আমরা সকলেই সেই নেয়ামতের শুকর আদায় করি, সবাই বলি আল-হামদুলিল্লাহ।
নির্ধারিত বিষয়বস্তুর ওপর হযরাতে ওলামায়ে কেরাম, বুযুর্গানে দীন প্রত্যেকে আলোচনা করেছেন, বয়ান পেশ করেছেন। ইনশাআল্লাহ আগামীকাল পর্যন্ত বয়ান ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে। আমি নগণ্যকে যে বিষয়বস্তু দেওয়া হয়েছে সে বিষয়বস্তুটি হচ্ছে, ফযীলতুল ইলম বা ইলমের ফযীলত, ইলমের তাৎপর্য, ইলমের গুরুত্ব।
ইলম শিখলে বা অর্জন করলে কী লাভ হয়, কী উপকার হয়, কী সাওয়াব হয়? সে ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য মুরুব্বীরা আমাকে আদেশ দিয়েছেন, তাই আমি আপনাদের সামনে কুরআনে করীমের সূরায়ে তাওবার একটি আয়াত তেলাওয়াত করেছি। সাথে সাথে দু’জাহানের সরদার, মদীনার মুকুট, আকায়ে নামদার, সাইয়েদুল কাওনাইন মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-এর অসংখ্য হাদীস থেকে একটি লম্বা হাদীসের এক অংশ আপনাদের সামনে পাঠ করেছি। আল্লাহ পাক মেহেরবানী করলে, দয়া করলে এবং আপনারা আন্তরিকভাবে দুআ করলে আমি নির্ধারিত বিষয়বস্তুর ওপর সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে কিছু আলোচনা করার জন্য চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
ইলম এটা আরবী শব্দ, আমরা সবাই মোটামুটিভাবে ইলম শব্দের অর্থ কি? কাকে বলে জানি। কী বলেন? আমাদের জানা আছে না? বাংলায় ইলম অর্থ: জ্ঞান, বিদ্যা ইত্যাদি। ইংরেজিতে সেটাকে কহড়ষিবফমব, ঝবহংব বলা হয়।
ইলম অর্জনের গুরুত্ব
কুরআনে করীম এবং রাসূল (সা.)-এর বহু হাদীসের মধ্যে ইলমের ফযীলতের কথা উল্লেখ রয়েছে, ইলম শিখলে কী লাভ হয়, ইহকালে কী লাভ, পরকালে কী লাভ, নিজে আলেম হলে কী লাভ? নিজের ছেলে-মেয়েকে আলেম বা হাফেজ বা মুফতি, মুহাদ্দিস বানালে কার কী লাভ হয় এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। তবে যে ফযীলতের কথা কুরআন এবং হাদীসের মধ্যে বলা হয়েছে সে ইলম দুনিয়ার কোন ইলম বা জ্ঞান নয়। দুনিয়ার ব্যাপারে দুনিয়ার অনেক জ্ঞান রয়েছে। যেমনÑ চিকিৎসা বিদ্যা, কৃষিবিদ্যা ইত্যাদি অনেক বিদ্যা রয়েছে।
কুরআন-হাদীসে যে ইলমের ফযীলতের কথা বলা হয়েছে সেটা পার্থিব ইলমের ফযীলতের কথা বলা হয়নি। কুরআন-হাদীসে যে ইলমের ফযীলত সম্পর্কে বলা হয়েছে সেটা একমাত্র ওহীর ইলম। শ্রোতারা বুঝে থাকলে বলুন, আল্লাহ পাক যে কুরআনে করীম নাযিল করেছেন, সেই কুরআনে ইলমের কথা বলা হয়েছে এবং আল্লাহর রাসূল (সা.) যে হাদীস বর্ণনা করেছেন ওই হাদীসে জ্ঞান বা ইলমের কথা বলা হয়েছে। বড় বড় মুহাদ্দিস, মুফতি ও মুজতাহিদ ইমামগণ কুরআন হাদীস থেকে রিচার্জ ও গবেষণা করে যে ইলমগুলো উদ্ঘাটন করেছেন, সেটাকে ইলমে ফিকহ বলা হয়, আর এখানে সেগুলোর ফযীলতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
আমি ৩টি ইলমের কথা বললাম: ১. ইলমে কুরআন, ২. ইলমে হাদীস, ৩. ইলমে ফিকহ তথা আইনশাস্ত্র। এ তিন ইলম সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (সা.) সরাসরি হাদীসের মধ্যে বলেছেন। হাদীসে আছে,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ، أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ قَالَ: الْعِلْمُ ثَلَاثَةٌ، وَمَا سِوَىٰ ذَلِكَ فَهُوَ فَضْل: آيَةٌ مُحْكَمَةٌ، أَوْ سُنَّةٌ قَائِمَةٌ، أَوْ فَرِيْضَةٌ عَادِلَةٌ رواه أبو داود في سننه (৩/ ১১৯) (رقم: ২৮৮৫).
আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য ও প্রিয় ইলম যা শিখলে আল্লাহ তায়ালা সাওয়াব দান করবেন, আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন, ইহকাল পরকালে আল্লাহ মুক্তি দান করবেন, জান্নাতে স্থান দেবেন, সে ধরণের ইলম হলো তিনটি। যথাÑ
১. আয়াতে মুহকামাত তথা কুরআন শরীফের যে সব আয়াত রয়েছে অর্থাং গোটা কুরআনের ইলম, আর এটি হলো আসমানী ইলম, ঐশী ইলম বা আল্লাহ প্রদত্ত। আমি শিখলে প্রথমে কুরআনের ইলমই শিখব, আর আমার সন্তানকেও তা শিক্ষা দেব।
২. সুন্নাতে দায়িমা তথা রাসূল (সা.)-এর হাদীস ও বাণী, এটা আসমানী ইলম, ধর্মীয় ইলম, এটার ফযিলতের কথা সামনে আলোচনা করব।
৩. আল-ফরিযাতুল আদিলা তথা যে ইলম কুরআন-হাদীসের সমতুল্য। যেগুলো কুরআন হাদীস থেকে গবেষণা করে বের করা হয়।
এ তিন প্রকারের ইলমই হলো প্রকৃত দীনী ইলম। আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, وَمَا سِوَىٰ ذَلِكَ فَهُوَ فَضْلٌ (এই তিন ইলম ব্যতীত বাকী সব ইলম দীনী ইলম নয়। সেসব হলো ঐচ্ছিক বা অতিরিক্ত ইলম)। মোল্লা জালাল উদ্দীন রুমী (রহ.) খুবই চমৎকার বলেছেন,
علم ديں فقہ است وتفسير وحدیث
ہر کہ خواند جز ازيں گردد خبيث
‘ইলমে দীন হচ্ছে তাফসীর, হাদীস ও ফিকহ। আর বাকী যেগুলো রয়েছে সেগুলো দীনী ইলম নয়। আর যারা সেগুলোকে মূল লক্ষ বানিয়ে অর্জন করবে তারা খবীস বা শয়তান হয়ে যাবে তথা ধর্ম থেকে বের হয়ে যাবে।
হ্যাঁ, যারা অন্যান্য ইলম অর্জন করেছে, ডাক্তারি ইলম অর্জন করেছে, ইঞ্জিনিয়ারিং এর ইলম অর্জন করেছে, তবে পাশাপাশি তাতে কুরআনের ইলমও রয়েছে, হাদীসের ও দীনের ইলমও রয়েছে। তাহলে আশা করি সে দুষ্ট হবে না। এখনতো আমাদের দেশে দীনী ইলমের প্রতি গুরুত্ব কমে গেছে। আমরা সন্তানদের কে দীনী ইলম শেখাতে চাই না। আবার অনেকে আছি যে, মাদরাসাকে মহব্বত করি, আলেম ওলামাকে সম্মান করি, কুরআন-হাদীসকে মহব্বত করি। মাদরাসায় চাঁদা ও টাকা পয়সা দিয়ে থাকি, বার্ষিক সভায় অংশ গ্রহণ করে থাকি। কিন্তু যদি বলা হয় আপনার ছেলেকে মাদ্রাসায় ভর্তি করান, তখন বলে, না না। আমার ছেলে মাদ্রাসায় পড়ে মোল্লা হয়ে বেকার হয়ে যাবে। নাউযুবিল্লাহ।
বর্তমান সমাজে আলেমদেরকে বেকার মনে করা হয়, সমাজের বোঝা মনে করা হয়, অথচ আলেমরা সমাজের বোঝা নয়, বরং সমাজের সম্পদ। আলেমরা যদি সমাজে থাকে তাহলে সমাজ ঠিক থাকবে, সংশোধিত থাকবে, দেশ ঠিক থাকবে এবং গোটা পৃথিবীকে আল্লাহ তায়ালা আলেমদের ওসিলায় টিকিয়ে রাখবেন। আলেমরা না থাকলে, ইলম না থাকলে দীন থাকবে না। আর দীনের ফ্যাক্টরি বা কারখানা হলো মাদরাসা। আলেম ওলামা, মুহাদ্দিস, মুফাচ্ছির এখান থেকেই বের হয়। যদি মুফতি, মুহাদ্দিস সাহেব না থাকেন, ইমাম-মুয়াজ্জিন না থাকেন তাহলে আমি আপনি মারা গেলে জানাযা পড়ানোর জন্য কি কোন লোক পাওয়া যাবে? অসম্ভব। আমার স্ত্রীকে আমি যদি তালাক দিয়ে দিই, আমার স্ত্রী আমার জন্য হালাল হবে কি না? আমি কারো সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইলে বৈধ হবে কি না? এসব বিষয়ে আলেমের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
তাহলে বোঝা যায় যে আমাদের সামাজিক কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য ওলামায়ে কেরামের প্রয়োজন আছে। সমাজে আলেম থাকলে সমাজে দীন থাকবে। আর প্রতিটি সমাজে দীন থাকলে গোটা পৃথিবী ঠিক থাকবে। সেজন্য পৃথিবীর যত সৃষ্টিজগৎ রয়েছে, এমনকি সমুদ্রের মাছ, গর্তের পিপিলিকা কোন ডাক্তারের জন্য দোয়া করে? কোন ইঞ্জিনিয়ারের জন্য দোয়া করে? কোন এমপি মন্ত্রীর জন্য দোয়া করে? না। সবাই একমাত্র আলেমদের জন্য দোয়া করে, তাদেরকে ভালবাসে। হুযুরগণ কি গোপনে গোপনে কখনো তাদেরকে ঘুষ দিয়েছে নাকি? কোনদিন চা পান করিয়েছে কি? না না। আসলে গর্তের পিপিলিকা ও সমুদ্রের মাছও বুঝতে পেরেছে যে হুযুরগণ যদি ঠিক থাকেন তাহলে দুনিয়া ঠিক থাকবে। আর দুনিয়া ঠিক থাকলে আমরা শান্তিতে থাকতে পারবো। আর হুযুরগণ না থাকলে দুনিয়া থাকবে না, আমরাও থাকবো না। সুতরাং তারা বেচে থাকার একমাত্র মাধ্যম হলো ওলামায়ে কেরাম।
তাহলে বোঝা যায় ওলামায়ে কেরামের প্রয়োজন রয়েছে। সেজন্য আমরা বলি আপনার ছেলেকে ডাক্তার বানাতে পারেন, ইঞ্জিনিয়ার বানাতে পারেন, অসুবিধা নেই। কিন্তু প্রথমে আপনার ছেলেকে কুরআন হাদীসের জ্ঞান শিক্ষা দিয়ে মাসআলা মাসায়েলে শেখাতে হবে। সেগুলো শিক্ষা না দিয়ে আপনি শুধু তাকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বানাতে অস্থির হয়ে যান। কুরআন হাদীসের যদি কোন ধারনা তার কাছে না থাকে তাহলে সে নাস্তিক, মুরতাদ হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। তাই আমাদের ছেলে-মেয়েকে কুরআন-হাদীস শিক্ষা দিতে হবে। কিন্তু দুঃখের ও আফসোসের বিষয় হচ্ছে, আমরা ইলম শেখার জন্যে, কুরআন-হাদীস শেখার জন্যে কোথাও ভ্রমন করি না। কোন মাদ্রাসা বা হুযুরদের কাছে যাই না, হক্কানী আলেমদের কাছে আমার সন্তানকে পাঠাই না, বরং আমরা নিজের সন্তানদেরকে পাঠাই একদম ভোরে দুনিয়াবী শিক্ষার পাঠশালায়। ছেলে মেয়েদেরকে মা বাবা সাথে করে কে. জি স্কুলে নিয়ে যায়, আবার ছুটির সময় নিয়ে আসে। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, আমার সন্তান মুসলমানের ছেলে এবং নিজেও মুসলমান তাকে কি একটুও আরবী পড়াতে হবে না? একটু কুরআন শরীফ পড়াতে হবে না এই বলে কোন রকম আসরের পরে যখন সাধারণত ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার প্রতি তেমন মনযোগ থাকে না সে সময় পড়ানোর জন্য একজন টিউশনি হুযুর রাখে, ছেলে কুরআন-হাদীসের ইলম শেখার জন্য হুযুরের কাছে যেতে পারবে না; বরং হুযুর ছাত্রের কাছে আসবে।
আচ্ছা বলেন তো, ইলম অর্জনের জন্য ছাত্র হুযুরের কাছে যায় নাকি হুযুর ছাত্রের কাছে আসে? নিশ্চয়ই প্রথমটা। আর যদি তা না হয় তাহলে বোঝা যাবে যে ছাত্রের জ্ঞান অর্জনের তেমন কোন প্রয়োজন নেই বরং শিক্ষকের জ্ঞান শিক্ষা দেওয়া অতি দরকার,
হাকিমুল ইসলাম কারী তৈয়ব (রহ.) নিজ কিতাবে হযরত ইমাম মালেক (রহ.) এর ঘটনা উল্লেখ করে লিখেছেন যে, একদিন ইমাম মালেক (রহ.)-কে তৎকালীন বাদশাহ হারুনুর রশীদ অনুরোধ করলেন যে, আপনি আমার ঘরে এসে আমার দুই ছেলেকে একটু পড়াবেন, ছেলে আপনার কাছে যাবে না, আপনি আমার ঘরে এসে তাদেরকে পড়াবেন। ইমাম মালেক রহ. ছিলেন হাদীসের গ্রন্থাকার, তিনি একটা হাদীসের কিতাব রচনা করেছেন যেটা আমাদের মাদরাসাসমূহে দাওরায়ে হাদীসে (মাস্টার্সে) পড়ানো হয়, যার নাম মুওয়াত্তা ইমাম মালেক (রহ.)। বাদশাহ হারুন বললেন, আমি বাদশা, রাষ্ট্রপ্রধান, তাই আপনি আমার বাড়িতে আসবেন আমার ছেলে আপনার কাছে যাবে না। ইমাম মালেক রহ. তাৎক্ষণিক উত্তর দিলেন যে, এটা কোন দিন হতে পারে না, উস্তাদ কোন দিন ছাত্রের কাছে গিয়ে পড়াতে পারে না, বরং ছাত্রকে জ্ঞানের পিপাসু হয়ে কিতাব নিয়ে ওস্তাদের দরবারে যেতে হবে। তখনই সেই ছেলেটি আলেম, মুফতি, মুহাদ্দিস ইত্যাদি হবে। ঘরে গিয়ে পড়ালে সে ছাত্র কোনদিন মুফতি, মুহাদ্দিস হবে না। তাদেরকে শুধু টিউশনি হুযুর দিয়ে ঘরে গিয়ে পড়ালে তারা কোনদিন মুফতি হবে না এবং অতীতে হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত কেউ দেখাতে পারবে না। তাহলে এসব হওয়ার জন্য নিজ বাড়ি ঘর ত্যাগ করে মাদরাসায় যেতে হবে অথবা কোন হক্কানী আলেমের ক্লাসে গিয়ে তার সংস্পর্সে বসে সেখান থেকে ইলম অর্জন করতে হবে।
এখন আরও কিছু জ্ঞানী ব্যক্তি দেখা যাচ্ছে যারা ঘরে বসে বসে দিবা-রাত্রি টিভির বিভিন্ন চ্যানেল দেখে এবং বিভিন্ন ইসলামী পোগ্রাম দেখে ইন্টারনেট দেখে এবং সে ওখান থেকে বিভিন্ন তাফসীর শিখে, হাদীস শিখে এবং নিজেকে বড় পণ্ডিত বলে দাবি করে এবং নিজেকে বড় গবেষক বলে মনে করে। সে একথাও বলে থাকে যে আরে সব জ্ঞান তো ইন্টারনেটের মধ্যে চলে গেছে। মাদরাসায় আলেমদের কাছে কিছুই নেই। আলেমরা কিছুই জানে না। আলেমদের কাছে যেতে হবে না। আমি বসে বসে নেট দেখি, অনেক কুরআন-হাদীসের জ্ঞান অর্জন করতে পারি। আল্লাহ পাক ইন্টারনেটের মাধ্যমে, টেলিভিশনের মাধ্যমে, কম্পিউটারের মাধ্যমে ইলম শিখাতে পারতেন না? কুরআন হাদীস শিখতে পারতেন না? কুরআন নাযিল করতে পারতেন না? কুরআন বোঝাতে পারতেন না? আল্লাহ কম্পিউটার এর সাহায্যে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কুরআন বোঝাতে পারতেন না? শুধু তাই নয়, নাযিলকৃত কিতাবকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য একজন উস্তাদ প্রেরণ করেছেন। তাহলে বলুন তো ইলম শিখতে হলে কিসের দরকার? উত্তর শিক্ষকের দরকার। আল্লাহর রাসূল (সা.) সেজন্য হাদীসে বলেছেন,
وَإِنَّمَا بُعِثْتُ مُعَلِّمًا لِأُتَمِّمَ مَكَارِمَ الْأَخْلَاقِ.
আল্লাহর হাবীব (সা.) বলেছেন, আল্লাহ পাক আমাকে সারা জগতের জন্য শিক্ষক বানিয়ে প্রেরণ করেছেন। উত্তম চরিত্র তাদেরকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য শুধুমাত্র ইন্টারনেটের গবেষকদের আলোচনা ও বক্তব্য শুনে আপনি মুত্তাকী পরহেযগার আলেম হতে পারবেন না। এর জন্য একটি আদর্শ থাকতে হবে। সে জন্য রাসূল (সা.) যেখানে সাহাবাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষার পাশাপাশি রাসূল (সা.) বলেছেন, وَصَلُّوْا كَمَا رَأَيْتُمُوْنِيْ أُصَلِّيْ (তোমরা নামায পড়, যেমনিভাবে আমাকে নামায পড়তে দেখেছ।) নামায কিভাবে কায়েম করবে? যাকে كيفيت صلاة বলা হয়। নামায আদায়ের পদ্ধতি যাকে বলা হয়। এটা কোথায় থেকে শিখব? এসব শুধু নেট থেকে শিখা যাবে না। এর পদ্ধতি শিখার জন্য একটি আদর্শ থাকতে হবে। আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা. কে উত্তম আদর্শ বানিয়ে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর যেসব ছাত্র বা শীর্ষ ছিলেন তাদেরকে সাহাবী বলা হয়। তাদেরকে মুফতি উপাধিতে ভূষিত করা হয়নি, তাদেরকে হাফেজ, কারী, মুহাদ্দিস ও মুফাসসির হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়নি, বরং উপাধি দেওয়া হয়েছে সাহাবী। বোঝা গেল মুফতী, মুহাদ্দিস ও মুফাসসির হওয়া সবকিছুর চেয়ে বড় হলো উস্তাদের সুহবত। এজন্য উস্তাদের সুহবত অর্জন করতে হবে। এই জ্ঞানার্জনের জন্য ঘর থেকে বের হতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে হক্কানী আলেম ওলামার ওয়ায-নসীহত শ্রবণ করার তওফীক দান করুন।
অনুলিখন: মুহাম্মদ তালহা
আদব বিভাগ, জামেয়া পটিয়া ২০১৭