মূল: মুবাশ্শির নাযির
ভাষান্তর: খন্দকার মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ
পূর্বপ্রকাশিতের পর
যদিও মুসলিম উম্মাহর এমন সন্তান বরাবরই আছেন যারা এ-ধরনের বানোয়াট ও বিভ্রান্তিকর বর্ণনার কালো পর্দা ঠিকই ভেদ করেছেন যুগেযুগে যাতে হযরত ওসমান (রাযি.), হযরত আলী (রাযি.), হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-সহ অন্যান্য সাহাবীর মুসলিম মনীষীর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নিন্দাবাদ করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও বর্ণনাগুলো ইতিহাসের গ্রন্থাবলিতে সংযোজন করে দেওয়া হয়েছে। মোটের ওপর কথা হলো, আমরা এটা বলতে পারি না যে, ‘এসব ইতিহাসগ্রন্থ সম্পূর্ণ মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে রচিত’। কারণ এসব ইতিহাসগ্রন্থে বনী উমাইয়া বিশেষত হযরত ওসমান, হযরত মুআবিয়া ও ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিকের ইতিবাচক অবদানের কথাও উল্লেখ আছে। কেবল এটুকু বলার আছে, এসব গ্রন্থে ওইসব ব্যক্তিত্ববর্গের নামে বাস্তবতা বর্জিত ও বিভ্রান্তিকর তথ্য সংযোজন করা হয়েছে।
তথ্যবিকৃতি ও প্রপাগা-ার দ্বিতীয় কারণ ধর্মীয়। যুগটি ছিলো মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান বিভক্তির ও ফেরকাবন্দির। সে সময় শিয়া জনগোষ্ঠী ছিলো সমধিক সুসংগঠিত। খারেজিগণ শেষ নিঃশ্বাস নিতে থাকলেও মুসলমানদের মাঝে তারা অস্তিত্বমান ছিলো। একটি গ্রুপ ছিলো যাদের নাচেবী বলা হয়, ওরা নিজেদেরকে ‘শিয়ানে ওসমান’ হিসেবে পরিচয় দিতো। গ্রুপটি হযরত আলী (রাযি.) ও তার বংশধরদের প্রতি বৈরিতা পোষণ করতো। এসব উপদল ও শ্রেণীর বাইরে মুসলমানদের মৌলিক আকিদা-বিশ্বাসে অবিচল একটি বড় অংশ ছিলো যাদেরকে ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআ’ বলা হয়।
উপরিউক্ত মতাবলম্বী শ্রেণীগুলোর বিভক্তির বুনিয়াদ ছিলো ‘ইতিহাস’। এসবের পরও মুসলমানরা সাধারণত মিলেমিশেই থাকতো; এসব ফেরকাবন্দির বিভেদরেখা ততটা স্পষ্ট হয়ে উঠতো না। শিয়াদের একটি সর্বসম্মত নীতি ছিলো যাদের অনুসরণের স্বার্থে শিয়া বর্ণনাকারীগণ নিজেদের মতবাদ গোপন রাখতো। ফলে ইতিহাসবিদগণ পরস্পরের সঙ্গে সহজ-সরলভাবে তথ্য বিনিময় করতেন। লব্ধ তথ্য পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ছড়িয়েও দিতেন নির্দ্বিধায়, অসঙ্কোচে।
মতবাদ, মতাদর্শ ও শ্রেণীভেদ বিচারের আলোকে যখন ইতিহাসের তথ্যকে মূল্যায়ন ও যাচাই করা হলো, দেখা গেছে অনেক ইতিহাস লেখক এমনসব তথ্য সংযোজন করে দিয়েছেন যা স্রেফ তার মতাদর্শকে শক্তি যোগানো এবং তার বিপক্ষকে রদ করার জন্যই বানানো হয়েছে। আপনি চোখে যে রঙের চশমা পরবেন সবদৃশ্যই আপনার কাছে সেই রঙের মনে হবে; কাজেই লোকেরা ইতিহাসকে যখন স্ব স্ব মতবাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেখেছে এর ব্যাখ্যাটাও তারা নিজেদের সুবিধামতোই করে নিয়েছে। ফলে ইতিহাসের বাস্তব ও সঠিক বর্ণনার ক্ষেত্রেও এর একটি প্রভাব প্রতিফলিত হয় এবং ঘটনাকে কমবেশি পরিবর্তন ও রঙ চড়িয়ে বর্ণনার এক প্রবণতা গড়ে ওঠে। যেহেতু তথ্য আর বর্ণনাকে নানানভাবে পরিবর্তন করে উপস্থাপনার রীতিটা সবমহলেই ছড়িয়ে গেছে। তাই শিয়া, খারেজিদের বর্ণনা মেইনস্ট্রিম (মূলধারার) মুসলমানদের লেখা গ্রন্থে ঢুকে পড়েছে।
হিজরি তৃতীয় শতকে ইতিহাসের হাল
যেমনটি আমরা আগেই বলেছি, সাহাবাযুগের বড় বড় ঘটনার বর্ণনা আমরা ধারাবাহিক গরিষ্ঠতাসম্পন্ন (তাওয়াতুর) সূত্রে পেলেও সেসব ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা মিলছে একক রিপোর্ট ও বিচ্ছিন্ন সূত্রের বরাতে। ‘মুতাওয়াতির’ বা ধারাবাহিক গরিষ্ঠতাসম্পন্ন সূত্রের বর্ণনা বিষয়ে ইতিহাসবিদদের কোনো মতান্তর নেই তবে একক সূত্রে রিপোর্ট বা তথ্য সম্পর্কে ইতিহাসবিদদের মাঝে মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। এ ধরনের বর্ণনার অধিকাংশই হিজরি দ্বিতীয় শতকের কতিপয় ইতিহাস লেখক কর্তৃক সংকলিত এবং তারা এতথ্যগুলো দিয়ে ইতিহাসগ্রন্থ রচনা করেছেন। হিজরি তৃতীয় শতকে যখন বড় বড় ইতিহাসগ্রন্থের সংকলন প্রস্তুত হয়ে গেছে তখন হিজরি দ্বিতীয় শতকের এসব গ্রন্থ তার অংশে পরিণত হয়েছে। এ যুগে গ্রন্থ মুদ্রণের পদ্ধতি ছিলো হাতের লেখায়; কাজেই হাতের লেখা নতুন গ্রন্থ রচিত হবার পর পুরনো গ্রন্থ অপ্রয়োজনীয় (ঙনংড়ষবঃব) হিসেবে পরিত্যক্ত বিবেচিত হয়।
হিজরি তৃতীয় শতকের ইতিহাসগ্রন্থ অধিকতর গুরুত্ব বহন করার কারণ হলো, হিজরি প্রথম শতকে সংঘটিত ঘটনাবলি সম্পর্কিত সবচেয়ে পুরনো তথ্যগুলো হিজরি তৃতীয় শতকে রচিত গ্রন্থসমূহে মেলে। কাজেই এসব গ্রন্থ সম্পর্কে আমাদের কাছে বিস্তারিত তথ্য থাকা দরকার। নবীযুগ বা সাহাবাযুগের ইতিহাসগবেষক মাত্রই হিজরি তৃতীয় শতকের ইতিহাসগ্রন্থসমূহকেই উপাত্ত হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এমনকি পরবর্তীকালে রচিত ইতিহাস-গ্রন্থাবলির সূত্র ও ভিত্তি হিজরি তৃতীয় শতকের গ্রন্থগুলোই। সাধারণভাবে এসব গ্রন্থকে চারভাগে ভাগ করা যায়:
১. বংশ তালিকাবিষয়ক গ্রন্থ
এ জাতীয় গ্রন্থ ও রচনাবলির উদ্দেশ্য হলো, বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের বংশধারা ও নসবনামা আলোচনা করা। আরব্যদের মাঝে বংশধারা-বিষয়ক শাস্ত্র অত্যধিক গুরুত্ব বহন করে এবং এর ভিত্তিতে গোত্রীয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা হতো বলেই তাদের কাছে বংশসূত্র বিষয়টির গুরুত্ব একেবারে প্রাক-ইসলামি যুগ থেকেই বরাবরই অসামান্য। আমাদের দেশে তো বড় বড় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি যেমন চৌধুরী, সিকদার, তালুকদার প্রভৃতি বংশীয় লোক কেবল তারাই যতেœর সাথে পূর্বপুরুষের বংশ তালিকা সংরক্ষণ করে। কেউ কেউ আবার জলসা জমিয়ে পূর্বসূরীদের কীর্তিগাঁথা লোকজনদের শোনায়। তবে বিষয়টা আমাদের সমাজে এতো ব্যাপকভাবে নেই। অন্যদিকে আরবে বংশধারা সম্পর্কে যার যত বেশি পা-িত্য সমাজে সে ততবেশি। বলে রাখা ভালো, বংশধারা-বিষয়ক শাস্ত্রে কেবল পূর্বপুরুষদের নামের তালিকা মুখস্থ রাখা নয় বরং গোত্রের প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের জীবন, অবদান ও কীর্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।
ফলে খুবই গুরুত্বে সঙ্গে আরবদের বংশধারা-বিষয়ক শাস্ত্রের (ইলমুল আনসাব) তথ্যসম্ভার ধারাবাহিকভাবে বিন্যস্ত এবং পরবর্তী প্রজন্মের হাতে বিশ্বস্ততার সঙ্গেই পৌঁছুতে থাকে। বংশধারার বর্ণনা, জীবনী বয়ান ছাড়াও এ-জাতীয় গ্রন্থের আরেকটি বিশিষ্টতা হলো, এতে বিয়েশাদি-সম্পর্কিত তথ্যাবলি লিপিবদ্ধ করা হয়। ফলে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে বৈবাহিক সম্বন্ধের অবস্থা থেকে তাদের মাঝে বিদ্যমান হৃদ্যতা ও সম্প্রীতির মাত্রাটা আন্দাজ করা যায়। আমাদের ইতিহাসবিদগণ বনী হাশিম ও বনী উমাইয়ার মাঝে বৈরিতা-বিষয়ে বিস্তারিত যে বয়ান হাজির করেছেন বংশধারা শাস্ত্রের আলোকে দেখলে তার চরিত্রটা বুঝতে বুঝতে পারা অনেকটাই সহজ হয়ে উঠবে।
‘ইলমুল আনসাব’ বা বংশধারা-বিষয়ক শাস্ত্রের বিখ্যাত গ্রন্থ আহমদ ইবন্ ইয়াহইয়া আল-বালাজুরীর (২৭৯Ñ৮৯৩ হি.) কর্তৃক রচিত ‘আশরাফুল আনসাব’ লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এটা বংশধারা-বিষয়ক গ্রন্থ হলেও এতে ইতিহাসের প্রচুর তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। কারণ লেখক গ্রন্থটিতে আলোচিত প্রত্যেক ব্যক্তির বিস্তারিত জীবনী তুলে এনেছেন। বর্তমানে গ্রন্থটি প্রায় পাঁচশ’ পৃষ্ঠার তের খ-ের আলাদা আলাদা ভলিয়মে প্রকাশিত হয়েছে। লেখক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশ বর্ণনা থেকে শুরু করেছেন আর প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধারাবাহিকতায় তাঁর একেকজন আত্মীয়ের জীবনী আলোচনা করেছেন। এরপর তাঁর চাচা আবু তালিব ও আব্বাসের জীবনী আলোচনা করেন। তারপর বনী উমাইয়া, বনী যোহরা, বনী তামিম, বনী মাখযুম, বনী আদীসহ কুরাইশের অন্যান্য শাখাগোত্রের লোকজনের জীবন সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন।
তিনি নিজের এই বিখ্যাত গ্রন্থটি সাজিয়েছেন এভাবে যে গোত্র আত্মীয়তার বিবেচনায় রাসুলের যত কাছের তাকে আলোচনার ধারাক্রমে তত আগে রেখেছেন। বালাজুরীর আগে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকে একই বিষয়ে মুসআব জুবাইরী (১৫৬-২৩৬ = ৭৭৩-৮৫১)-এর গ্রন্থ ‘নাসাবু কুরাইশ’। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। তিনিও কুরাইশ গোত্রের শাখাসমূহের মাঝে পারস্পরিক আত্মীয়তার সম্বন্ধ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি হযরত জুুবাইর (রহ.)-এর বংশধর ছিলেন, হযরত ইমাম মুসলিম তার কাছ থেকে অনেক বর্ণনা গ্রহণ করেছেন। গ্রন্থটির আরেকটি হলো, এখানে কেবলই বংশধারা-বিষয়ক আলোচনা স্থান পেয়েছে কোনো ইতিহাস বয়ান করা হয়নি। ফলে গ্রন্থটির নিরপেক্ষতা স্বীকৃত। পরে চতুর্থ শতকে ইবনে হাযাম (৩৮৪Ñ৪৫৬ = ৯৯৪Ñ১০৬৪)-এর লেখা ‘জামহারাতু আনসাবিল আরব’ গ্রন্থটিও এ বিষয়ে বিশেষ মর্যাদা ও গুরুত্ব বহন করে।
২. শ্রেণীবিন্যাসগত (তাবাকাত ) পর্যালোচনা গ্রন্থ
তাবাকাত-বিষয়ক গ্রন্থসমূহেও বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী আলোচিত হয়। যেখানে পরোক্ষভাবে তাদের সময়ের ইতিহাসের নানা তথ্যও উঠে আসে। তবে এ জাতীয় গ্রন্থের বিন্যাসধারা হলো, বয়স বা মেধা আর গুণপনা বিচারে স্তর-ক্রমে (অমব এৎড়ঁঢ়/চববৎ এৎড়ঁঢ়) জীবনী আলোচনা। যেমন রাসুলের (সা.) দাওয়াতে প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবিরা প্রথম স্তরের। হিজরতের পর বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হবার মধ্যবর্তী সময়ে ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবিরা দ্বিতীয় স্তরের। বদর-ওহুদের মধ্যবর্তী সময়ে ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবীদের তৃতীয় স্তরে গণ্য করা হয়। এভাবে ইতিহাসে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বড় বড় ঘটনার মধ্যবর্তী সময়ে ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবিদের একেক স্তর হিসেবে সাজানো হয়েছে। মক্কা বিজয় ও রাসুলের ইন্তেকালের মধ্যবর্তী সময়ে যারা ইসলাম গ্রহণ করেন তাদেরকে সাহাবায়ে কেরামের শেষ স্তর হিসেবে গণ্য করা হয়। তাদের পরে শুরু হয় তাবেঈনদের স্তর।
এই আঙ্গিকে লেখা সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ মুহাম্মদ ইবনে সা’দের ‘আত-তাবাকাতুল কুবরা’। ইবনে সা’দ যদিও বড় ইতিহাসবিদ কিন্তু তিনি মুহাম্মদ ইবনে ওমর আল-ওয়াকিদীর (মৃ. ২০৭-৮২২) শাগরেদ; যাকে হাদিসবিশারদগণ নিতান্ত দুর্বল বর্ণনাকারী (দয়ীফ) সাব্যস্ত করেছেন। কাজেই ওয়াকিদীর সূত্রে ইবনে সা’দ কর্তৃক আনীত কোনো বর্ণনাই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ইবনে সা’দ স্তরের পর স্তর সাহাবী-তাবেঈনদের জীবনী আলোচনা করেছেন। এর পাশাপাশি তিনি নগরভিত্তিক (অধিবাসী) ব্যক্তিবর্গের জীবনী আলোচনা করেছেন।
‘তাবাকাত’-বিষয়ক গ্রন্থ বলতে বোঝানো হয়েছে, যে গ্রন্থে এক বা একাধিক বৈশিষ্ট্যে পরস্পরে সাদৃশ্যপূর্ণ। হোক তা বংশমর্যাদা, জন্ম, জ্ঞানগত যোগ্যতা প্রভৃতিতে- কোনো শ্রেণীর লোকদের শ্রেণীবিন্যাস সম্পর্কিত আলোচনা করা হয়েছে এমনভাবে যাতে যারা তাদের সমপর্যায়ের নয় তাদেরকে সহজে আলাদা করা যায়।
[চলবে]
(মাসিক আত তাওহীদ, নভেম্বর ২০১৭)